গল্প শুনতে তোমাদের নিশ্চয় খুব ভালো লাগে? আর সে যদি হয় রূপকথার রাজ্যের প্রেতপুরীর অট্টহাস্য? যে মেয়েটার গল্প বলছি, সে ও গল্প শুনতে দারুন ভালোবাসতো, বয়সটাও ঠিক তোমাদের মতনই হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ির কাজের লোকটার কাছে ভাই-বোনেরা মিলে সবাই গল্প শুনতে বসত। সবাই তাকে 'হাজরার মা' বলেই ডাকত। কত যে গল্পের ভান্ডার ছিল তার কাছে! ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী থেকে শুরু করে সাগরতলের কাহিনি। ছড়া শুনাতেও কম যেতেন না হাজরার মা। আর এভাবেই মেয়েটা কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেত গল্প শুনতে শুনতে। মুগ্ধ হয়ে শুনত যে হাজরার মা'র ছড়া। একদিন হল কি? মেয়েটা ভাবল এত সুন্দর সুন্দর গল্প যদি বইয়ের মতন ছাপা হত! কত ছেলেমেয়েরাই তো দেখতে পারত। যেই ভাবা সেই কাজ। সদ্য শৈশবে পা দেওয়া সেই মেয়েটা লিখতে বসে গেল, শোনা গল্প সুন্দর করে লিখে ফেলল সে। লেখার পর খামে ভরে পাঠিয়ে দিল মক্তব নামে এক শিশু পত্রিকায়। ঠিক এখন তোমরা যেমন কচি কাঁচার আসরে লেখা পাঠাও। গল্পটা নিশ্চয়ই অনেক ভালো হয়েছিল। সে জন্যই ছাপা হয়ে গেল কলকাতার সেই পত্রিকায়। ছাপার হরফে নিজের লেখা দেখার আনন্দের সাথে আর কি কিছুর তুলনা চলে? ছোট্ট সেই মেয়েটাও সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। গল্পটার নাম শুনলেই জানি পড়তে ইচ্ছে করবে, 'সোনার কাঠি ও রাজপুত্তুর'। পত্রিকা হাতে নিয়েই সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে লাগল। মজার কথা হচ্চে, সে যখন গল্পটা নিয়ে হাজরার মা'র কাছে গেল, হাজরার খুশি হবে কই? মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। বল কি ? মেয়েলোকের নাম কাগজে ছাপা হয়ে গেল? এখন আবার সেটা সারা দুনিয়ার মানুষ দেখবে? তোমরা শুনে যতই হাসাহাসি করনা কেন, প্রায় একশ বছর আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের এমন একটা সমাজেই বাস কর করতে হত। তোমাদের মতন এত্ত এত্ত সুযোগ সুবিধা তো তাদের ছিল না। থাক সেসব ভারী ভারী কথা, নিশ্চয়ই জানতে চাইছ, কে সেই মেয়েটা? কেন এত আগ্রহ ভরে তার গল্প শুনলে? এবার বলে দেই, তিনি তোমাদের অনেকের প্রিয় কবি হোসনে আরা। তার 'জবর ডাক্তার' কবিতার 'সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার, খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে, চেয়ারেতে রাতদিন বসে গোনে দুই তিন, পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে!' এই লাইনগুলো শোন নি এমন ছেলেমেয়ে খুঁজে পাওয়া ভার। তোমাদের অনেকের বাবা-মাও শৈশবে এই ছড়াটা শিখেছেন। তারা যখন ছোট এই ছড়াটা চতুর্থ শ্রেনীর পাঠ্যবইতেও ছিল। যাক সে কথা, আজ তোমাদের এই কবির কথা শোনাব। তোমাদের কবি এই জন্যই বলেছি যে, আমাদের দেশের যে ক'জন কবি শিশুসাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছিলেন, তাদের মাঝে প্রথমদিকেই বলতে হয় তার নাম। শৈশব থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছোটদের নিয়ে ভাবতেন। তাদের জন্য কত যে ছড়া লিখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগের কথা, কবি হোসনে আরা ১৯১৬ সালে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। সুর করে মাথা দুলিয়ে 'পুথি' পড়তে দেখছ নিশ্চয় তোমরা? হোসনে আরার বাবা মুন্সি এবাদুল্লাহ ছিলেন সে সময়কার নামকরা পুথি সাহিত্যিক। তার চাচা ছিলেন জ্ঞানতাপস ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বুঝতেই পারছ কত বড় পরিবারে জন্ম তার। পরিবারেই একটা সাহিত্যিক ঘরানার বাতাস বইত। মেয়ে বড় হতে থাকল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে সময়ের কথা বলছি তখন মেয়েদের স্কুলে যাওয়া অনেক ঝক্কির ব্যাপার।ভুল বুঝিয়ে মেয়েদের রাখা হত অন্ধকারে। তাদেরকে বলা হত মেয়েদের জন্য পড়াশোনার কোনও প্রয়োজন নেই, পড়াশোনা মহাপাপ। বোঝ অবস্থা! তবুও হোসনে আরা এই বিপত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। পড়াশোনাটা তার শিখতেই হবে। মেয়ের আগ্রহে বাবা সাই দিলেন, পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায় চাচার বাসায়। চাচা ডঃ শহীদুল্লাহ পন্ডি ব্যক্তি, তার মেয়েদেরকেও তিনি লেখাপড় শেখান। কিন্তু সেই ব্যবস্থা বড়ই অদ্ভুত, তোমাদের মত ব্যাগভর্তি রঙ্গিন বই নিয়ে স্কুলে বন্ধুদের সাথে পড়তে যাওয়া না। হোসনে আরা আর তার চাচাত বোনরা যে মৌলভীর কাছে পড়ত, তিনি বসতেন পর্দার ওপারে। একবার ভেবে দেখ, তুমি পড়ছ আর তোমার শিক্ষককে দেখতে পাচ্ছ না, তিনি অন্যপাশ থেকে তোমাকে শেখাচ্ছেন। এমনই নিরস পড়াশোনা করেই কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা হয়েছিল তার। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হোসনে আরাকে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সাথে। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার ও একুশে পদক পাওয়া এই সাংবাদিক ছিলেন উদার মনের মানুষ। তিনি নিজেও সাহিত্যচর্চা করতেন, দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার প্রধান সম্পাদকও ছিলেন তিনি। তো হোসনে আরা পুতুল খেলার বয়সে বউ হয়ে আসলেন শশুর বাড়িতে, তার বিপুল আগ্রহ দেখে স্বামী তাকে পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য করতেন। হোসনে আরা স্বামির অনুপ্রেরনায় লিখতে শুরু করলেন। সাংসারিক ব্যস্ততার মাঝেও বালিকা বধু হোসনে আরার মন পড়ে থাকত লেখালেখিতে। 'হাসি' ছন্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা ছাপা হত তখন তার। হোসনে আরার প্রথম কবিতা ছাপা হয় দৈনিক আজাদের 'মুকুলের মাহফিল' এ। সময়টা তখন ১৯৪৯ সাল, আর সেই বছরই কিন্তু তার প্রথম ছড়ার বই 'ফুলঝুরি' বের হয়। এই বইতেই তার বিখ্যাত ছড়া 'জবর ডাক্তার' সংকলিত ছিল। আরও অনেক মজার মজার ছড়া ছিল, তোমরা চাইলে এখনও সংগ্রহ করতে পার বইটি। এভাবেই হোসনে আরার পরিচিত বাড়তে থাকল শিশুদের মাঝে, তারা উন্মুখ হয়ে বসে থাকত হোসনে আরার ছড়া পড়ার জন্য। একে একে তার অনেকগুলো বই বের হয়, 'খেয়াল খুশি', 'হল্লা', 'টুংটাং' ও 'হট্টোগোল' সেই সময়কার সাড়া জাগানো বই। 'মিছিল' নামে বড়দের জন্যও একটা কবিতার বই আছে তার। এই কবিতাগুলো থেকেই বোঝা যায়, তিনি কত বলিষ্ঠ মনের অধিকারী ছিলেন। 'মুকুল' পত্রিকাতেও নিয়মিত লেখা বের হত তার। আর মাত্র ষোল বছর বয়সেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, গান্ধিজী তখন ব্রিটিশদের বাংলার মাটি থেকে দূরে সরাবেনই। ব্রিটিশরাও নাছোড়বান্দা, তারা ১৪৪ ধারা জারি করে দিল, মানে কেউই রাস্তায় বেরুতে পারবেন না। ১৯৩২ সালের কথাম হোসনে আরা কথা শুনলেন না, দেশের জন্য কোনও বাধাই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। হোসনে আরা সব বাঁধা পেরিয়ে মিছিল থেকে ছত্রভংগ হয়ে একাই পতাকা হাতে চলে এলেন কলকাতার গড়ের মাঠের সেই মনুমেন্টের সামনে। কী সাহসিকতার পরিচয়ই না তিনি দিয়েছিলেন সেদিন। আর পুলিশ তো আর সে কথা শুনবে না, ১৪৪ ধারা ভংগ করার অপরাধে তাকে ধরে নিয়ে গেলেন। ছয়মাস জেলখানায় আটক থাকতে হল তাকে। তিনিই প্রথম বাঙালি নারী যে জেল খেটেছিলেন কোনও আন্দোলন করতে যেয়ে, এই জন্যই অনেকে তাকে নারী জাগরনের পথিকৃতও বলে থাকেন। হোসনে আরা এর পরেও ৫২'র ভাষা আন্দোলনে , আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান থেকে অবদান রাখেন। একাত্তরে তিনি নিজের হাতে কাপড় বুনে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, রেডক্রসের মাধ্যমে তা পৌঁছে দেয়া হত। আরও অভিনবভাবে তিনি সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন যোদ্ধাদের। স্বামী মোদাব্বেরও অনেক সহায়তা দিয়েছেন তখন। তারা এক বুদ্ধি বের করলেন। তোমরা যেই পেনসিল দিয়ে লেখ, তেমন কয়েকটা পেনসিল দুই টুকরো করে এক টুকরো রেখে দিতেন নিজের কাছে, অন্য টুকরো থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। বিভিন্ন জায়গাতে বিপদে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা যদি এই পেন্সিলের টুকরো দেখাতে পারতেন, হোসনে আরা যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন।
পারিবারিক জীবনেও অত্যন্ত সুখী ছিলেন হোসনে আরা। তার চার পুত্র ও এক কন্যা। তাদের নিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছিল তার সুখের সংসার। কবি হোসনে আরা ১৯৯৯ সালের ৩০ শে মার্চ আমাদের ছেড়ে চলে যান। তিনি আর কোনওদিন শিশুদের নিয়ে অপূর্ব ছন্দের অবতারনা করবেন না। তোমাদের এই প্রিয় কবি ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার আর ১৯৯২ সালে শিশু একাডেমি পুরষ্কারে ভুষিত হন। তিনি হয়তো নেই, তবুও তার সৃষ্টির্র মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।