তিনি নিজে বলেন—আমি চীনা ক্রিকেটের জন্য নীল আর্মস্ট্রং!
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখে তিনি সাবেক টেস্ট তারকা, এশিয়ায় ক্রিকেট বাঁশি নিয়ে ঘুরতে থাকা এক জাদুকর! কিন্তু আমাদের কাছে তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু; আমাদের জন্য তিনি আর্মস্ট্রং-কলম্বাসের চেয়েও বেশি কিছু; তিনি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তার কারণেই বিশ্ব মানতে বাধ্য হয়েছিল, বাংলাদেশও টেস্ট খেলতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের সেই সেঞ্চুরিয়ান, দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবং বিস্ময়কর রেকর্ডের অধিকারী কোচ আমিনুল এখন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের উন্নয়ন কর্মকর্তা। এখন তিনি চীন, নেপাল, হংকংয়ের মতো দেশে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত পালন করছেন। এরই মাঝে চলতি এশিয়া কাপের টুর্নামেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। ইত্তেফাকের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে নিজের নতুন এই ভূমিকার অভিজ্ঞতার কথা বললেন এবং সবচেয়ে বেশি করে বললেন বাংলাদেশের ব্যর্থতা নিয়ে। বাংলাদেশের ব্যর্থতার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণও চিহ্নিত করেছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
শীর্ষ ব্যাটসম্যান, অধিনায়ক, কোচ; মাঠের সব ভূমিকার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। কর্মকর্তা হিসেবেও অনেকদিন ধরে কাজ করছেন। এশিয়া কাপ সামলানোর অভিজ্ঞতাটা কেমন লাগছে?
আসলে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলছি, এবার আমি পঞ্চম এশিয়া কাপ খেলছি! খেলোয়াড় হিসেবে এর আগে চারটি এশিয়া কাপ খেলেছি। আর এবার কর্মকর্তা হিসেবে খেলছি। এটাকেও আমি আসলে এশিয়া কাপের আরেক মাত্রার অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখছি।
খেলোয়াড় হিসেবে যখন এশিয়া কাপে অংশ নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এবারের মূল পার্থক্যটা কোথায়?
পার্থক্য হল, আগেরগুলোতে শুধু খেলেছি। এবার বুঝতে পারছি, আমাদের সেই খেলাটা আয়োজনের জন্য পেছনে কতো শত কাজ করতে হয়। খেলার সময় শুধু খেলাটার কথা ভাবলে চলতো। এখন শত দিক নিয়ে ভাবতে হয়। তখন আমাকে শুধু বোলারদের নিয়ে ভাবলে চলতো। এখন বিভিন্ন ধরনের মানুষকে নিয়ে ভাবতে হয়। সত্যিই অনন্য একটা অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশের প্রসঙ্গে একটু বলুন। আপনার উত্তরসুরীদের পারফরম্যান্সে নিশ্চয়ই হতাশ?
আসলে ২০১১ এশিয়া কাপই আমাদের একটা প্রত্যাশার মাত্রা তৈরি করে দিয়েছিল। এর আগ পর্যন্ত আমরা অংশগ্রহণের জন্যই অংশ নিতাম। খেলতাম; কিন্তু এটা ভাবতাম না যে, আমরা ফাইনাল খেলবো বা চ্যাম্পিয়ন হবো। গত এশিয়া কাপের পর থেকে কিন্তু আমরা চিন্তা করতে শুরু করলাম—আমরা চ্যাম্পিয়নও হতে পারি। কার্যত চ্যাম্পিয়ন তো হয়েই গিয়েছিলাম। এরপরও আমরা টানা ওয়ানডে ভালো খেলে গেছি। ফলে সেবারের সেট করে দেয়া বেঞ্চমার্ক অনুযায়ী, এবারের এশিয়া কাপটা ছিল আমাদের জন্য অন্যরকম একটা টুর্নামেন্ট। যেখানে আমরা ফাইনাল খেলবো বা চ্যাম্পিয়নশিপ লড়বো; এরকম লক্ষ্য নিয়ে শুরু করেছিলাম। খুব সামান্য কিছু জায়গায় পিছিয়ে পড়ায় আমরা সেটা পারলাম না। কারণ হিসেবে কেউ বলছেন ভাগ্যের ব্যাপার। আমি ভাগ্যের কথা বলি না; কারণ, ভাগ্য তো নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়।
সে ক্ষেত্রে আপনি তো নিশ্চয়ই কারণগুলো বুঝতে পেরেছেন। আমরা বার বার এই কাছে গিয়ে কেন হেরে যাচ্ছি; এটার কারণ কী, একটু বলবেন?
এই ব্যাপারে আসলে কথা বলাটা খুব স্পর্শকাতর। আমি নিজে কোচিং করাই, তাই কোচিং নিয়ে বললে কেউ ভাবতে পারে, এতো কেন টার্গেট করে বলছি। কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যি যে, বাংলাদেশ কিন্তু এখন ক্রিকেট দল হিসেবে কলেজ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছে। কিন্তু দলের শিক্ষকরা এখনও কলেজ পর্যায়েরই রয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। এখন আমরা সেই শিক্ষকদের, মানে কোচিং স্ট্যাফকে যদি আপগ্রেড না করি, তাহলে এই ঘটনাগুলো ঘটতে থাকবে—আমরা অল্পের জন্য হেরে যাবো, এইরকম টান টান সময়ে সেরা সিদ্ধান্তটা নিতে পারবো না, প্রতিপক্ষ সম্পর্কে চূলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রস্তুতি নেয়া হবে না, সময়ের সুবিধাটা নিতে পারবো না, ক্রিকেটারদের ট্যালেন্টের সেরাটা বের করে আনা যাবে না।
একেবারে মাঠের পারফরম্যান্সের কথা যদি বলেন; ক্রিকেটে ঘাটতিটা কোথায় ছিল বলে মনে হয়?
ক্রিকেটীয় দিক থেকে যে ব্যাপারটা দেখলাম, ব্যাটিংটা মোটামুটি ধারাবাহিক থাকলেও বোলিং ও ফিল্ডিং মধ্যম মানের ছিল। একমাত্র সাকিব ছাড়া আর কোনো বোলার ছিল না যাকে যে কোনো সময় এসে দলের জন্য বল করে দিতে পারে। সাকিবই এ ক্ষেত্রে অধিনায়কের একমাত্র অপশন ছিল। ব্যাটিং বেশ ভালো হয়েছে, বিশেষ করে পাকিস্তানের বিপক্ষে, এটা মানতে হবে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, মিডল অর্ডারে মুশফিকের মতো কেউ আর নেই, যে কিনা শেষ পর্যন্ত নিয়মিত কন্টিনিউ করে যাবে। এটা টেকনিক্যালি খুব দরকার।
এই ব্যাপারে আপনি ঘরোয়া ক্রিকেটের কথাও বলছিলেন মাঝে। সেখানে এরকম শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই কমে যাওয়ায় খেলোয়াড়রা এই পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না...
হ্যাঁ, ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। আবার একটু উদাহরণ দিয়ে বলি—আপনি যখন ক্লাস নাইনের অংক পরীক্ষায় বসবেন, তখন আপনাকে ওই অংকগুলো জানতে হবে। ক্রিকেটেও আপনি এই ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে চাইলে, আপনাকে অনেকবার এই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট যেভাবে চলে, এর যে অবকাঠামো; সেখানে এখন ওই পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা খুব একটা হই না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও আমরা হয় খুব সহজে হেরে যাই, না হয় সহজে জিতে যাই। ফলে ওই ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের খুব বেশি ক্রিকেটারের পরিচয় নেই। এটা আমি বলবো, শুধু দলের ক্ষেত্রে নয়, ব্যক্তিগত খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে সত্যি।
ব্যক্তিগত পর্যায়ের ব্যাপারটা কেমন?
যেমন ধরুন, স্লগ ওভারে কিভাবে বল করতে হবে। এটা কিন্তু আপনি শুধু তাত্ত্বিকভাবে জেনে মাঠে করতে পারবেন না। দশ হাজার বার কাজটা করতে হবে। ম্যাচে করতে হবে, নেটে করতে হবে। আমি তো দেখি, আমাদের বোলাররা নেটে খুব একটা বলই করে না। নেট বোলাররা বল করে ব্যাটসম্যানরা নক করে।