খরা, বন্যা, জলমগ্নতা ও লবণাক্ততা সহনশীল জাত পেয়েছে কৃষকেরা
ডায়বেটিক রোগীদের জন্য ডায়বেটিক ধান, জিংক সমৃদ্ধ জাত বাংলাদেশেই প্রথম
পুষ্টি যোগ করে ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
রোপণের পরই পানিতে তলিয়ে গেছে ধান ক্ষেত। একটানা ১৫ দিন ডুবে থাকায় গাছ পচে সব চারা। ভয়ানক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কৃষকের মাথায় হাত। আবার চারা রোপণ করতে হবে। আবারও মহাজনের কাছে গিয়ে চড়া সুদে নিতে হবে ঋণ। এ তো গেল এক চিত্র।
প্রকৃতির অন্যরকম বৈরিতায় কৃষকের একই রকম দুর্দশা হয়। যেমন বীজ বোনা হয়েছে বেশ আগে। এরপর তীব্র খরায় জমি চৌচির। সহসা পানিরও ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ধান গাছ শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। জমির দিকে তাকিয়ে কৃষকের কষ্টের কান্না।
কয়েক বছর আগেও ধান চাষ করে প্রকৃতির নানা বৈরিতার কারণে গ্রাম-বাংলার কৃষকদের মাঝে-মধ্যেই এ রকম দুর্গতিকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে হতো। কিন্তু সে হতাশার চিত্র এখন আর নেই। যে কোন পর্যায়ে ১৫ দিন পানিতে ডুবে থাকার পরও বা জমি ফেটে চৌচির হলেও ধান গাছের ক্ষতি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের গবেষণার সাফল্য হিসেবে উদ্ভাবিত হয়েছে বন্যা বা খরা সহিষ্ণু জাতের ধান।
শুধু তাই নয়, লবণাক্ততা, অতিরিক্ত ঠাণ্ডার মতো প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলার মতো ধানের জাতও উদ্ভাবন করা হয়েছে। আর এসব নতুন উদ্ভাবিত জাতের ধান এখন কৃষকের নাগালে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) দুইশ' বিজ্ঞানী কৃষকদের কাছে ধানের উন্নত ও টেকসই জাত পৌঁছে দিতে কাজ করছেন। ব্রি লবণাক্ততা সহনশীল ৭টি, আকস্মিক বন্যা মোকাবিলার ২টি, খরা সহনশীল ৩টি, মঙ্গা মোকাবিলার ২টি, জিঙ্ক সমৃদ্ধ একটি, সর্বাধিক ফলনের ৪টি এবং সুগন্ধি ও রপ্তানি উপযোগী ৩টিসহ ৬৫টি জাত উদ্ভাবন করেছে।
একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যদিকে মাটির উর্বরতা ও আবাদি জমি হরাসের ফলে ধান উত্পাদনে যে চ্যালেঞ্জ চলছে তার সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। এর মাধ্যমে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেশের ধান উত্পাদন। এ প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় সব প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলার ধান এখন বাংলাদেশে রয়েছে। আরো বহুগুণ সম্পন্ন ধানের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০-৫১ সালে দেশে চালের মোট উত্পাদন ছিল ৬২ লাখ টন। বীজ ও অপচয় বাবদ শতকরা ১০ ভাগ বাদ দেয়ার পর চালের নীট প্রাপ্যতা ছিল ৫৫ লাখ ৮০ হাজার টন। লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২১ লাখ। ওই বছরে খাদ্যশস্যের ঘাটতির পরিমাণ ছিল সাড়ে ১১ লাখ টন। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৫ দেশে চালের উত্পাদনের পরিমাণে তেমন বেশি পরিবর্তন হয়নি। চাল উত্পাদনের বার্ষিক পরিমাণ ছিল এক কোটি ৭ লাখ টন। ওই সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এখন ২০১৩-১৪ বর্ষে এসে ধানের উত্পাদন ৩ কোটি ৪০ লাখ টন। ১৯৭১ থেকে ২০১৪ এই ৪৩ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। অন্যদিকে একই সময়ে ধানের উত্পাদন বেড়েছে তিনগুণ।
ব্রি'র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) আলমগীর হোসেন বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমরা ধান গবেষণায় এগিয়ে আছি এবং প্রথম সারিতে রয়েছি। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
শুধু দেশে নয়, ব্রি উদ্ভাবিত জাত উন্নত ও প্রতিকূল পরিবেশ খাপ খাইয়ে ফলন দিতে পারে এমনটা নিশ্চিত হবার পর পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, মায়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম, ঘানাসহ আফ্রিকার ২০টি দেশে সেসব ধান আবাদ করা হয়।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়াও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৪টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। যা কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে।
ডায়াবেটিক ধান: ডায়াবেটিক রোগীদের কথা বিবেচনায় ব্রি দুটি ধানের জাত বিআর ১৬ এবং বিআর ২৫ উদ্ভাবন করেছে। এসব জাতের ধান নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স গুণসম্পন্ন। এ ধরনের খাবার ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য নিরাপদ।
মঙ্গা মোকাবিলার জাত: ১৯৯৭ সালে আগাম রোপা আমন ধানের জাত হিসেবে ব্রি ধান-৩৩ উদ্ভাবন করা হয়। উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুরে আমন মৌসুমে অন্য ধানের চেয়ে এই ধান এক মাসের বেশি আগে পাকে। এ কারণে এ ধানের চাষাবাদে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সে অঞ্চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অর্থাত্ কার্তিকে মঙ্গা (হাতে কাজ না থাকার কারণে বেকারত্ব) মোকাবিলা সম্ভব হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
সর্বাধিক ফলনের জাত: সর্বাধিক ফলনের জন্য সারাদেশে ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধান কৃষকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। আমন মৌসুমে অনুরূপ সফলতার নজির সৃষ্টি করেছে বিআর ১১। সময়ের চাহিদার প্রেক্ষাপটে এই জাতসমূহের পরিপূরক হিসেবে সম্প্রতি উদ্ভাবন করা হয়েছে ব্রি- ৫৫, ব্রি- ৫৮ এবং ব্রি-৪৯ জাতের ধান।
বন্যা পরবর্তী সময়ের উপযোগী জাত: ব্রি ধান ৪৬। এ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি ৪.৭ টন। চালের আকৃতি ও গুণগত মানের কারণে কৃষকদের কাছে এটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
লবণাক্ত এলাকার উপযোগী জাত: উপকূলীয় এলাকায় চাষাবাদের উপযোগী (লবণাক্ততা সহিষ্ণু) ধানের জাত ছিল না। ব্রি ২০০৩-২০০৭ সালের মধ্যে ৩টি লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করে। এগুলো হলো ব্রি-৪০, ব্রি-৪১ ও ব্রি-৪৭। ব্রি-৪০ জাতের ধান চারা ও থোড় অবস্থায় ৮ ডিএস/মিটার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। ৩০-৫০ দিনের চারা এক হাঁটু পরিমাণ পানিতে সহজেই রোপণ করা যায়। ব্রি-৪৭ ধানের চাষাবাদের ফলে এ অঞ্চলে ধান চাষে নতুন জাগরণ শুরু হয়েছে। যেখানে পানির লবণাক্ততার মাত্রা ৪ ডিএস/মিটার, সেখানে অনায়াসে বোরো মৌসুমে এ জাতের আবাদ করা যায়। এছাড়া চারা অবস্থায় এই জাতের ধান ১২-১৪ ডিএস/মিটার এবং বাকি জীবনকাল ৬ ডিএস/মিটার লবণাক্ততা সহ্য করতে সক্ষম। পরবর্তী সময়ে উদ্ভাবন করা হয়েছে ব্রি ৫৩ ও ব্রি ৫৪। আমন মৌসুমের এ দুটি জাতের বিশেষত্ব হলো এগুলো চারা ও প্রজনন অবস্থায় ৮-১০ ডিএস/মিটার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
সুগন্ধি ধান: সুগন্ধি ধান ব্রি ধান ৫০ (বাংলামতি)। প্রথমবারের মতো বোরো মৌসুমের উপযোগী একটি সুগন্ধি ধানের জাত উদ্ভাবনে সফল হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণত আমন মৌসুমে সুগন্ধি ধানের চাষ হয়ে থাকে। এটি বোরো ধানের জাত । এর জীবনকাল ১৫৫ দিন। ফলন হেক্টরে ৬.৫ টন। এ ধানের চালের আকার-আকৃতি পাকিস্তান ও ভারতীয় বাসমতি চালের চেয়ে উন্নত এবং ফলনও হেক্টরে ১ টন বেশি।
অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকার উপযোগী জাত: ব্রি-৪৪ জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে চাষযোগ্য রোপা আমন ধানের জাত। বিআর১১-এর মতোই এ ধান স্বাভাবিক রোপা আমনে চাষ করা যায়, তবে অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকায় যেখানে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত জোয়ারের পানি আসে সেখানে চাষের উপযোগী। লম্বা হওয়া সত্ত্বেও কাণ্ড শক্ত থাকায় সহজে হেলে পড়ে না।
জলমগ্ন ধান: ব্রি ৫১ ও ব্রি ৫২—রোপা আমনের এ দুটি জাতের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো ১৪ দিন জলমগ্ন থাকার পরও বেশি ফলন দেয়।
জিংক সমৃদ্ধ জাত: সর্বাধিক আলোচিত ধান ব্রি-৬২। এর কারণ এটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ আগাম জাত। মানব দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা অনুপুষ্টির চাহিদা পূরণ করবে এ জাত। বায়োফর্টিফাইড পদ্ধতিতে বিশ্বে এরকম ধানের জাত এই প্রথম উদ্ভাবিত হলো। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আমাদের দেশি ধানের জাত জিরা কাটারি এবং ব্রি-৩৯ এর সংকরায়ণ করে এটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। দুটি ধানের জাতের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এদের জৈব গুণ উন্নত ও সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশে জিংক সমৃদ্ধ যেসব সনাতন জাত (উদ্ভাবিত নয়) পাওয়া যায় সেগুলোর সর্বোচ্চ গড় মাত্রা ১৪ থেকে ১৬ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। কিন্তু ব্রি-৬২ এর গড় পিপিএম মাত্রা ২০ থেকে ২২ পিপিএম। অর্থাত্ এটি মধ্যম মাত্রার জিংক সমৃদ্ধ জাত। ব্রিতে অধিকতর জিংক সমৃদ্ধ আরেকটি জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে যাতে জিংক রয়েছে ২৪ পিপিএম।
ভিটামিন এ: আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্রি-২৯ জাতে ভিটামিন 'এ' সংযোজন করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্যে আয়রন ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ কৌলিক সারি চিহ্নিত করা হয়েছে। ধানে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট সংযোজনের এ প্রযুক্তি অদূর ভবিষ্যতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করতে পারে এমনই আশার কথা জানিয়েছেন কৃষকরা।
প্রকাশনা শাখার প্রযুক্তি সম্পাদক ও প্রধান এম এ কাসেম বলেন, প্রযুক্তি উদ্ভাবনই নয়, সে সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য একাধিক প্রকাশনা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
ব্রি-র মহাপরিচালক বিজ্ঞানী জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, আমরা প্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছি। পাশাপাশি অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশের আরো ধান উদ্ভাবনের পথে রয়েছি। শুধু জলাবদ্ধতা সহ্য নয়, একই সাথে পোকামাকড় যাতে আক্রমণ করতে না পারে এবং ফলন অতীতের চেয়ে বেশি হয়, এমন বহুমুখী গুণাগুণ সম্পন্ন ধান উদ্ভাবন করা হবে।