অদ্ভুত এক ফরম্যাট; মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যেতে পারে খেলার গতিবিধি। আর এই পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারেন যে কেউ। তারপরও সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই ঘরানার ক্রিকেটে আলাদা করে চোখ রাখতে হবে কয়েকজনের দিকে। ইত্তেফাকের পাঠকদের জন্য তেমন কয়েকজনের কথা লিখেছেন এ কে এম মুজিব।
শহীদ আফ্রিদি
এই আছে; এই নেই - গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে এমনই ছিল তার ফর্ম। কিন্তু যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণেই বোলারদের জীবন করে দেন বিভীষিকাময়। তার মতো আগে কাউকে দেখা যায়নি, সামনেও আর কাউকে দেখা যাবে কি না সন্দেহ। আর ফরম্যাটটার নাম যখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট, তখন শহীদ খান আফ্রিদিকে হালকা ভাবে দেখবে এমন বোকা ক্রিকেটে কেউ নেই। সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা এই ক্রিকেটার ৭০ ম্যাচে পেয়েছেন ৭৩ টি উইকেট। রানটা নিয়মিত না আসলেও এর মধ্যেই ঢুকে গেছেন এক হাজার রানের অভিজাত ক্লাবে। চারটি হাফ সেঞ্চুরিসহ করেছেন ১০৪৪ রান। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আলাদা করেই মনে রাখবে তার নাম। ২০০৭ সালের প্রথম বিশ্বকাপেই হয়েছিলেন সিরিজ সেরা। সেবার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে কান্না নিয়েই দেশে ফিরতে হয় পাকিস্তানকে। কিন্তু দু'বছর পর আর এমন হতাশ হতে হলো না। বিশ্বকাপ জয়ের সাথে সাথে টুর্নামেন্ট সেরাও হলেন শহীদ আফ্রিদি। এবার সামপ্রতিক সময়ের পারফরম্যান্সও আফ্রিদিরই পক্ষে।
ক্রিস গেইল
তার মিস হিটও নাকি ছয় হয় - আসলেই কি তাই? টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যার সর্বোচ্চ রান ১১৭ তার ক্ষেত্রে এরকম কিছু বলা হলে সেটা না মেনে উপায় নেই। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই ক্রিস গেইলের ব্যাটে এসেছিল এই ঝড় ইনিংস। এরপর বয়ে গেছে অনেক কাল। সময় গড়িয়ে এবার আয়োজিত হচ্ছে টুর্নামেন্টটির পঞ্চম আসর। এর মধ্যে আরও পরিণত হয়ে উঠেছে গেইলের ব্যাট। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করাটা এখন তার জন্য রীতিমতো ডাল ভাতের ব্যাপার। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), বিগব্যাশ, টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট সব জায়গাতেই প্রতিপক্ষ বোলারদের জন্য এক জীবন্ত দানব হয়ে ওঠেন এই গেইল। ৩৭ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৩৩.২১ গড়ে করেছেন ১০৯৬ রান। গতবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা। এবারও শিরোপার জন্যই গেইলের ব্যাটের দিকেই চেয়ে থাকবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
বিরাট কোহলি
বিশ্ব ক্রিকেটে বিরাট কোহলির আবির্ভাব ঘটে এই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দিয়েই। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে তার পারফরম্যান্স দিল্লীর এই ক্রিকেটারকে সুযোগ করে দেয় ভারতীয় দলে। আর সময়ের ব্যবধানে সেই বিরাট কোহলিই এখন ভারতীয় জাতীয় দলের অন্যতম সেরা পারফরমার। সর্বশেষ এশিয়া কাপের আসরে নিয়মিত অধিনায়ক মহেন্দ সিং ধোনির ইনজুরিতে দলপতির দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে করেন ম্যাচ জেতানো এক সেঞ্চুরি। টুর্নামেন্টের বাকিটা সময়ে কোহলির ব্যাট হাসেনি। ভারতও ফাইনালের আগেই বাদ পড়ে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর দিয়ে আবারও বাংলাদেশে আসছেন তিনি। এবার অধিনায়কত্বের বাড়তি চাপ থাকবে না। এবার কি ২১ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে চারটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৫৮৭ রান করা এই ব্যাটসম্যানের? সময়ই উত্তর দেবে এই প্রশ্নের!
কুমার সাঙ্গাকারা
টেস্ট আর ওয়ানডে মিলিয়ে যার ২৪ হাজারের কাছাকাছি রান তার ক্রিকেটীয় দক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। লঙ্কান ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারাও এই জাতীয় সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। আর ফরম্যাটটার নাম যখন টি-টোয়েন্টি, সেখানেও তিনি থাকবেন অনেকের চেয়ে এগিয়ে।
সর্বশেষ বাংলাদেশের বিপক্ষে যে চট্টগ্রামে যে দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন সেখানে দুই ইনিংস মিলিয়ে করেছিলেন ৪৮ রান। কিন্তু শেষ ম্যাচে তার ৩৭ রানের ইনিংসের সুবাদেই খাদের কিনারা থেকেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে শ্রীলঙ্কা। ৩৬ বছর বয়সী সাঙ্গা অনেক কাল ধরেই দলের হয়ে খেলেছেন এমন অনেক নায়কোচিত ইনিংস।
টি-টোয়েন্টি জমানায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র ১৩ জন ক্রিকেটারই পৌঁছেছেন এক হাজার রানের অভিজাত ক্লাবে। তাদের একজন হলেন কুমার সাঙ্গাকারা। ৫০ ম্যাচে ৩২.৭৭ গড়ে তিনি করেছেন ১৩১১ রান। ক্যারিয়ারে আছে সাতটি হাফ সেঞ্চুরি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৮ রান করেছিলেন নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে।
কুমার সাঙ্গাকারা এগিয়ে থাকবেন আরও এক দিক থেকে। সামপ্রতিক সময়ে প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে শ্রীলঙ্কা সবগুলো ম্যাচেই ছিল অপরাজিত। সর্বশেষ তারা এশিয়া কাপ জয় করে দেশে ফিরেছে। আর এই সময়ে লঙ্কান দলের অন্যতম সেরা নায়ক হলেন কুমার সাঙ্গাকারা। তাই তার দিকে নজর না রেখে উপায়ও নেই!
সাকিব আল হাসান
সামপ্রতিক সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, দারুণ একটা বিপদের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। অফ ফর্মে আছেন দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ তারকা। এর মধ্যেও যারা আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নজর কাড়তে পারেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন সাকিব আল হাসান। টি-টোয়েন্টি'র অল রাউন্ডারদের র্যাংকিংও সেই কথাই বলছে। টি-টোয়েন্টি অল রাউন্ডারদের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে আছেন ২৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। বোলারদের র্যাংকিংয়েও আছেন ষষ্ঠ অবস্থানে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) খেলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে। সেখানে কলকাতা দলটির হয়ে শিরোপা জয়েও ছিলেন দলের অন্যতম নায়ক। কদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশে। সেখানেও পারফরম্যান্সটা ছিল বলার মতো। ক্যারিবীয় প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটে বার্বাডোজের হয়ে ছয় রান দিয়ে পেয়েছিলেন ছয় উইকেট। সব ধরনের টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে এটা দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার। বাংলাদেশের হয়ে ২৮ ম্যাচে ৩৬ উইকেট আর ৪৪৩ রান করা এই ক্রিকেটারের দিকে এবারও তাকিয়ে থাকবেন স্বাগতিক দর্শকরা।
বেন্ডন ম্যাককালাম
পৃথিবীর যেকোন বোলিং লাইন আপের সামনে যেকোন সময়ই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তার ব্যাট। কিন্তু, তারপরও কি বলা যায় ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান? টেস্ট আর ওয়ানডে পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন টি-টোয়েন্টির ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। আর এটা বলা যে মোটেই বাহুল্য নয় সেটা পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। ৬৪ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই ব্যাটসম্যান অপেক্ষায় আছেন টি-টোয়েন্টি জমানার প্রথম দুই হাজার রানের ক্লাবের সদস্য হবার। ৩৬.২৭ গড়ে তিনি করেছে ১৯৫৯ রান। করেছেন সর্বোচ্চ ১২ টি হাফ সেঞ্চুরি আর দুটি সেঞ্চুরি। অনেক দিন ধরে ফর্মে ছিলেন না। ভারতের বিপক্ষে ক'দিন আগে শেষ হওয়া সিরিজ দিয়ে আবারও ফর্মে ফিরেছেন। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম করেছেন ট্রিপল সেঞ্চুরি। এবারও ব্ল্যাক ক্যাপস অধিনায়ককে আটকানোর জন্য আলাদা করেই ছক আঁকবে বিপক্ষ দলের বোলাররা!
লাসিথ মালিঙ্গা
অদ্ভুত এক বোলিং অ্যাকশন নিয়ে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এক আলোচিত চরিত্র তিনি। ২০০৪ সালে অভিষেকের পর অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন লঙ্কান বোলিং লাইন আপের অন্যতম মূল ভরসা। তিনি হলেন সেপারামাডু লাসিথ মালিঙ্গা। ইনজুরি আর সংক্ষিপ্ত পরিসরের ক্রিকেটকে আরও বেশি সময় দেয়ার জন্যই ২০১১ সালে এসে টেস্ট ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় জানান। এরপর থেকে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিই তার ধ্যান-জ্ঞান। আর সেখানে যে তিনি দারুণ ফর্মে আছেন সেটা বলাই বাহুল্য। সর্বশেষ এশিয়া কাপ ক্রিকেটে ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। ফাইনালে ৫ টি উইকেট নিয়ে বল হাতে প্রায় একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন আপকে। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীও তিনি। চার ম্যাচে পেয়েছেন মোট ১১টি উইকেট।
বাংলাদেশে আসার আগে খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। সেখানে খেলেন মেলবোর্ন স্টারসের হয়ে। এছাড়া খেলেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ক্রিকেটে। সেখানে তার দল ছিল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স।
সব মিলিয়ে লাসিথ মালিঙ্গার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারটা বেশ সমৃদ্ধ। ৫০ ম্যাচ খেলে ২১.৬১ গড়ে পেয়েছেন ৬০ টি উইকেট। আর ক্যারিয়ারে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন একবারই। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে সেই পারফরম্যান্সটা আসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পালেকেল্লেতে।
কুমার সাঙ্গাকারার মতো ঠিক একই কারণে এগিয়ে থাকবেন লাসিথ মালিঙ্গা। বাংলাদেশের কন্ডিশন আর উইকেটের ধরন সবই এখন তার নখদর্পণে। সাথে পারফরম্যান্সটাও হয়েছে মন মতো। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পঞ্চম আসরকে সামনে রেখে বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে তাকে নিয়ে ছক কাটা শুরু করে দিয়েছেন!
সাঈদ আজমল
আস্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটু বেশি দেরি করেই অভিষেক ঘটে তার। ২০০৮ সালে যখন অভিষেক হয় তখন বয়স হয়ে গেছে ৩১। কিন্তু তাতে তো আর হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন সাঈদ আজমল। ফলাফল মাত্র চার-পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেই তিনি হয়ে উঠেছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা স্পিনারদের একজন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি আছেন আরও এক ধাপ এগিয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, তিনি এই ফরম্যাটের সেরা খেলোয়াড়। ৫৯ ম্যাচে ৮১ উইকেট নিয়ে তিনি টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার। সদ্য শেষ হওয়া এশিয়া কাপে পেয়েছেন ১১ টি উইকেট। তবুও পাকিস্তানকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননি। এবার সেই হতাশা মুছে ফেলতে মুখিয়ে থাকবেন সাঈদ আজমল!