মো. আব্দুর রহিম
সমাজের প্রয়োজনে, মানুষের কল্যাণে রচিত হয় আইন। রচিত আইনটি তখনই কল্যাণকর হয় যখন সেটি সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হবে। বলা হয় আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু আজকে যেন এ কথাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে যে, আইনের চোখে অনেক মানুষ অসমান। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান আইনের অপপ্রয়োগ, অপ্রয়োগ ও অসমপ্রয়োগ যেন বারবার সে কথাই প্রমাণ করে।
আমাদের পোশাক শিল্পের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (BILS) এবং কতিপয় শ্রমিক সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ২২ বছরে তৈরি পোশাক কারখানায় ভবন ধসে কিংবা আগুনে পুড়ে কমপক্ষে ৭০০জন শ্রমিক মারা যায়। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে, যেখানে কমপক্ষে ১১২জন শ্রমিক নিহত হয়। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো কতিপয় তদন্ত প্রতিবেদনে তাজরীন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ার হোসাইনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তবুও এ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। চলতি বছরের ২৬শে জানুয়ারি ঢাকার স্মার্ট এক্সপোর্টে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৮জন শ্রমিক নিহত হয়। তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলে হয়ত স্মার্ট এক্সপোর্টের ঘটনাটি ঘটত না।
যাই হোক, মজার ব্যাপার হলো, স্মার্ট এক্সপোর্টে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৮জন শ্রমিকের প্রাণহানিতে এর মালিককে গ্রেফতার করা হলেও ১১২ জনের প্রাণহানির ঘটনায় তাজরীন ফ্যাশনের মালিককে গ্রেফতার করা হয়নি। বিশ্লেষকরা অভিযোগ করেছেন তাজরীন ফ্যাশনের মালিক বিজিমইএ (BGMEA) এর সদস্য হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মনে করা হয় জাতির বিবেক। জ্ঞান চর্চার নিরাপদ আশ্রম মনে করা হয় এই অঙ্গনকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সেই অঙ্গন হয়ে উঠেছে মানুষ হত্যার নিরাপদ আশ্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কত মায়ের বুক খালি হল। আজ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠিত একটি হত্যাকান্ডেরও সঠিক বিচার হয়নি। বড়জোর সংগঠন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার। মানুষ হত্যার বিচার বহিষ্কারাদেশ! হত্যাকারীরা আইনের ঊর্ধ্বে কারণ তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অন্যতম সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে "ধূমপান এবং তামাক ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) অ্যাক্ট, ২০০৫" পাস করেন। আইনটিতে বলা হয় জনসংযোগস্থলে (public place) ধূমপান নিষিদ্ধ। আইনটি লঙ্ঘনকারীকে ৫০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু হতাশার বিষয় এই যে, এত জনগুরুত্বপূর্ণ একটি আইন কাগুজে আইনই রয়ে গেছে। যত্রতত্র লংঘিত হচ্ছে আইনটি কিন্তু কোন কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কালেভদ্রে রিকশাওয়ালা, পোশাক শ্রমিক এ ধরনের শ্রেণী-পেশার মানুষদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় স্ব-স্ব স্থানের প্রভাবশালীরা।
আইন তো প্রণয়ন করা হয় সবার জন্য, তবে তা প্রয়োগ করা হবে সাধারণ মানুষের জন্য। তারাও যদি কষ্ট করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সাথে বাম হাতের কাজটি সেরে ফেলতে পারেন তবে তারাও হয়ত পার পেয়ে যেতে পারেন। আবার আইনের জটিল জটিল ধারার ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার নজিরও কিন্তু কম নেই। একজন অধূমপায়ী সাধারণ মানুষ যখন পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে আইন থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করতে না পেরে নিজের নাক-মুখ চেপে ধরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন তাকে ভাবা হয় আনস্মার্ট (Unsmart)। তার দিকে কি রকম যেন এক বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টিতে তাকানো হয়। এ যেন কাগুজে আইনের ছত্রছায়ায় আইন ভঙ্গকারীদের স্বর্গরাজ্য।
আপনি যদি ধর্ষিতা হয়ে থানায় মামলা নিয়ে যান তবে আপনার মামলা নেয়া হবে না। কারণ আপনার ধর্ষক গ্রামের মাতব্বরের ছেলে। আবার আপনার বাড়িঘর কেউ পুড়িয়ে দিলে কিংবা জমি দখল করলে তার সুষ্ঠু তদন্ত হবে না কারণ আপনি কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য।
সব অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সমাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ অধ্যাপকের কাছে একাডেমিক ক্যালেন্ডার লিখিত নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, কাগজে-কলমে তো অনেক কিছুই লেখা থাকে, আমরা কয়টা মেনে চলি? তিনি হয়ত তার দীর্ঘ জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই সে জবাবটা দিয়েছিলেন। তার সেদিনের জবাবের সারমর্ম আমি বুঝতে পেরেছিলাম এ রকম, কাগজে-কলমে যা লেখা থাকবে তার উল্টো অর্থ বুঝতে হবে। এই উল্টো অর্থ আবার সবাই নিতে পারবে না। আপনি যদি বিজিএমইএ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী কিংবা সদস্য না হন অথবা স্থানীয় কোন প্রভাবশালী না হন তবে উল্টো অর্থ নিতে পারবেন না। কাজেই অর্থ নির্বাচনের সময় আপনাকে খুব সতর্ক হতে হবে।
আমাদের সমাজে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বিদ্যমান। তবে আশার আলো হলো এই যে, আইনের চোখে অসমান হয়ে যারা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়েছেন তারা কিন্তু সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়