'থামে না তবুও তার পা দু'খানি, আবার দৌড়ায়, যেন পথ নেই আর'—এই ভূখণ্ডের মানুষের দৌড় আর থামে না। সমাজ, রাজনীতি, বিশ্বায়ন, বিবর্ণ প্রকৃতির কান্না দেখে আহা বলেই কি শেষ? শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের দাগ-তামাশা দর্শকদের কিছু অতি জরুরি কথা বলে দেয়। প্রথাগত সৌন্দর্য নির্মাণ নিরাময় অযোগ্য ক্ষত। বাংলাদেশের শিল্পকলায় ব্যঙ্গ চিত্রভাষা নির্মাণের চলতি ধারা পাল্টে শিল্পের চরিত্রের মুখাবয়ব ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুষ্টক্ষত চিহ্ন তুলে আনেন অবলীলায়। এ প্রদর্শনীর ২৪টি কাজ আমাদের সমাজ, ব্যক্তিজীবন, বাংলার প্রথাগত জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রযুক্তির যুক্ত হওয়া প্রধান হয়ে ওঠেছে। স্থূল কালো রেখার বিপরীতে সাদা জমিনের ক্যানভাস দর্শকদের সামনে বিষয়গুলো গোচরীভূত হয়। এ প্রসঙ্গে শিল্পী শিশির মনে করেন, 'ছবির বিষয়গুলো এখানেই শেষ নয় এর বাকী অংশগুলোর জন্যে দর্শক ভাবতে থাকবেন। সৃষ্টি হওয়া শিল্পকর্ম আর সৃষ্টি না হওয়া শিল্পকর্মের সাথে, চিন্তার সাথে যুক্ত করার জন্যেই বড় আকৃতির ক্যানভাস।' ১নং ছবিটি তিনটি ভাগে ভাগ করা, তিনটি ক্যানভাস এক হয়ে চিত্রতল তৈরি হয়েছে। স্থূল রেখার চলাচলে নির্মিত বিষয়ে উঠে এসেছে মানুষ ও পরিবেশ। তাওয়ায় জ্বলছে জ্যান্ত মোরগের কর্তিত মাথা। সিসি ক্যামেরা, হা করে পাখির ঠোঁট এগিয়ে আসছে বিড়ালের লেজের দিকে, বিড়াল দাঁড়িয়ে আছে শায়িত মানুষের দেহের ওপর। আনন্দে উদ্বেল মানুষের উর্ধ্বমুখী অবস্থান। অস্থির মানুষের নানাভঙ্গি স্থির কখনও অস্থির মানুষের নিত্য মুখোমুখি করে হা করে দাঁতাল মানুষ। জন্তু আর মানুষের মাঝে কোনো ভেদ নেই। হা করা মানুষের সাথে সখ্য গড়ে ওঠেছে প্রাণীকূলের। মানুষের মুখে দণ্ডায়মান টিকটিকির মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে জোড়ায় জোড়ায় নারী পুরুষের বাহারী পাদুকা।
বড় দুটি ক্যানভাসের একটির চেয়ে অন্যটির কাজের ধরন আলাদা। ১৪নং ছবিটিতে স্থূল ও অসি সূক্ষ্ম রেখায়, বিষয়ে আলোছায়া ত্রিমাত্রিক রূপ সৃষ্টি করেছেন। দৌড় দেওয়া কুকুরের মুখে মানুষের কাটা পা। মাথাহীন শায়িত মানুষের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীর দৃষ্টিতে আতংক। মানুষের সাথে প্রকৃতি বিষণ্নতা একাকার হয়ে আছে। এ আলামত আমাদের নিত্য দেখা। শিশির ভট্টাচার্য্য তাঁর ছবিতে স্বপ্ন বোনেন না। বাস্তবকে অতি বাস্তব রূপ দিয়ে দর্শকদের কাছে হাজির করেন। এ দুটিতে ছবিতে শিল্পীর কোনো স্বাক্ষর নেই। প্রসঙ্গত শিল্পী বলেন, 'আমি ছবির শেষ চাই না, একাজগুলো অসমাপ্ত কাজ হিসেবেই প্রদর্শিত হচ্ছে। আর অনেক কাজেই আমার কোনো স্বাক্ষর বা নাম লেখা নেই এটি কোনো কোনো ছবিকে বিরক্ত করে।
শিশির ভট্টাচার্য্যের এ প্রদর্শনীতে শিল্পী রঙিন জমিনে কিছু কাজ রেখেছেন। বিষয়ে ঐক্য রেখে জমিনের রঙের ভিন্নতা ছবির বক্তব্য দর্শকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। চিত্র নির্মাণের ব্যাকরণ বলে কোনো দর্শক ভাবনা তাড়িত হলে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিল্প নির্মাণ ও বিষয় উপস্থাপনায় নতুন আঙ্গিক তৈরিকে শিল্পকলার উত্তরণ বলতে পারি। শিশির ভট্টাচার্য্য আমাদের শিল্পকলায় যুক্ত করেছেন নতুন চিত্রভাষা। যাতে ছবি ও সমাজ দর্শন, মানবিক হাহাকার থেকে শুরু হয়ে অসীম নীলিমায় ওড়তে থাকা পাখির ডানায় জমতে থাকা ক্ষোভ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। দুুর্বোধ্য চিত্র নির্মাণের দর্শক মতকে শিল্পীর তোয়াক্কা করার খুব প্রয়োজন নেই। শিল্প বিপণনযোগ্য বা ড্রইংরুম সাজগোজের উপকরণ হওয়া জরুরি নয়। একুশ শতকের চিত্রভাষায় শিল্প সৃষ্টির ব্যাকরণ সংকটের সমাধান পেয়েছি আমরা। শিশির ভট্টাচার্য্য আমাদের শুধু শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেন না হাজির করেন সুপ্ত বিবেক, বোধের মস্তকে ঠুকে দেন মস্ত এক পেরেক। ঢাকা আর্ট সেন্টারে 'দাগ-তামাশা' শেষ হবে আগমী ২৪ মার্চ।