মার্চ মাস, আমাদের স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসেই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির সব পেশার নারী-পুরুষ মেতে উঠেছিল মুক্তির নেশায়। এর বিপরীতেও ছিল বেশকিছু সংখ্যক বর্বর পাকিস্তানি দোসর। অতঃপর ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদ আর আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা! আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে নানা বয়স, ধর্ম ও পেশার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশ নিয়েছেন। কেউ বা যুদ্ধের মাঠে শহীদ হয়েছেন। কেউ বা মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন, হয়েছেন নির্যাতিত। আর যাঁরা আজও সেই গৌরব বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরা কেমন আছেন? এমনই এক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নাট্যকার মান্নান হীরা লিখেছেন 'লাল জমিন'। নাট্যকার এ নাটকে সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন তেরো ডিঙ্গিয়ে চৌদ্দ ছুঁই ছুঁই এক কিশোরীর মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধোত্তর তার সংগ্রামী জীবনের কাহিনি। ১৫ মার্চ শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও থিয়াটার হলে প্রদর্শীত হলো 'লাল জমিন'। নাটকটিতে এককভাবে অভিনয় করেছেন মোমেনা চৌধুরী। নাটকটি প্রযোজনা করেছেন শূন্যন আর নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী।
নাটকটিতে উঠে আসে চৌদ্দ বছর ছুঁই ছুঁই কিশোরীর দু'চোখ জুড়ে মানিক বিলের আটক লাল পদ্মের জন্য প্রেম। তেমনি এক কিশোরী, তার কৈশোরেই শোনে বাবা-মায়ের মধ্য রাতের গুঞ্জন। শুধু দুটি শব্দ কিশোরীর মননে জেগে রয়—মুক্তি, স্বাধীনতা। ঐ বয়সে কিশোরী এক ছায়ার কাছ থেকে প্রেম পায়, সাড়া দেয় কি সে! বোঝে না কিশোরী। বাবা যুদ্ধে চলে যায়। অগোচরে কিশোরী নানা কৌশলে যুদ্ধে যাবার আয়োজন করে, সশস্ত্রযু্দ্ধ। সে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে যায়। কিন্তু স্বল্প-বয়সের কারণে তাকে বার বার ফিরে যেতে হয়। ফিরে এসে মায়ের কাছে বায়না ধরে যুদ্ধে যাবার জন্য । তার মা-ও কিছু বলে না। অতঃপর কিশোরী তার কৈশোরের সেই ছায়া প্রেমের সম্মুখে দাঁড়ায়, কিশোরী তার সেনাপতিকে চিনতে পারে। তারপর এক গভীর রাতে হয় তার যুদ্ধ যাত্রা। সে এবং পাঁচ যুবতী, স্বপ্নময় সেনাপতি ও বেশ কয়েকজন পুরুষ যোদ্ধা নিয়ে গঠিত দলটি লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগেই তাদের নৌকায় আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা। কিশোরীর চোখের সামনেই নিহত হয় তার ছায়া-প্রেম, তাঁর সেনাপতি। আর পুরুষ যোদ্ধাদের কেউ শহীদ হন, কেউ নদীর জলে হারিয়ে যান। অতঃপর রাজাকারেরা ওই পাঁচ যুবতীসহ ও কিশোরীকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের জীবনে ঘটে নানা তিক্ত ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। চৌদ্দ বছরের কিশোরীর ধবধবে সাদা জমিন যুদ্ধের নয় মাসে হয় রক্তে রাঙা। কিশোরীর এ অভিজ্ঞতা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রশ্নমুখর অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়। আর কিশোরী পরিণত হন নানান সংগ্রামের সাথে জড়িয়ে এক সংগ্রামী নারীতে।
নাটকটিতে নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তীর অনুপম নির্দেশনার ছাপ চোখে পড়ে। মুগ্ধ হল ভর্তি দর্শকের অনেকেই ফিরে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেরে সেই পুরোনো দিনগুলোতে। আর যারা দেখেনি সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল সব দিনগুলো তারা নড়েচড়ে বসে। কতটা আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ভিতরে ছিল তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানুষ-জীবন সব। কতটা বিভত্সতা সৃষ্টি করেছিল নরপশু পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসর রাজাকারেরা!
সুদীপ চক্রবর্তী ও তার সহযোগী আব্দুল মুনিম তরফদারের মঞ্চ পরিকল্পনায়, আতিকুল ইসলাম জয়, আতিকুর রহমান, নিলা সাহা ও মির্জা শাখেছেপ শাকিবের সুনিপুণ আলোর ব্যবহার এবং জুয়েল মিজি ও তানভীর সানির নেপথ্য থেকে দৃশ্য সৃজনে নাটকটি যখন শেষ হয়, মুগ্ধ দর্শকেরা নাটক দেখে ইতিহাস পাঠের সুখানুভুতি অনুভব করে। অনেক দর্শককে বলতে শোনা যায়, এইসব কুলঙ্গার রাজাকারদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।
জুলফিকার চঞ্চল, রামিজ রাজুর সংগীত পরিকল্পনায় নাটকটিতে রাধারমন, মুকুন্দ দাস ও মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে সুর সংগ্রহ ও অনুসরণে বারী সিদ্দিকী, রামিজ রাজু ও নীলা সাহার কণ্ঠের গান। নাকটটিতে পোশাক পরিকল্পনায় ছিলেন ওয়াহিদা মল্লিক জলি ও তার সহযোগী মোসাম্মত্ মমতাজ। মিলনায়তন ব্যবস্থাপনা ছিলেন নভেরা রহমান ও মিলন । লাল জমিনের এটি ৫১তম প্রদর্শনী।