'অ্যাই রুবা, আমার বন্ধু, ফজল মাহমুদ, কবিতা লিখত, ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের সেরা ছাত্র, একজন উদাসীন তরুণ, গতকাল আত্মহত্যা করেছে।'
ওপাশে রুবার উষ্ণ নিশ্বাস মোবাইলে ফোঁস ফোঁস করে ভেসে আসছে।
'অ্যাই, তুমি কথা বলছ না কেন? আমি আমার বন্ধুর জন্য শোক করছি। আচ্ছা রুবা, কোনো উদাস দুপুরে নিঃসঙ্গ কোকিলের ডাক শুনেছ! ফজল কি শুনেছে? শুনে না থাকলে একটি অতৃপ্তি নিয়ে ওর মৃত্যু ঘটেছে। আমি ফজলকে করুণা করেছি।'
ফজল, পৃথিবীর আলো-বাতাস গ্রহণকারী একজন মানুষ তোমার জন্য কাতরতা অনুভব করছে। জীবনের সঙ্গে আমাদের এই যে সম্পর্কের সূত্র, তার সঙ্গে আমি বিরোধিতা করি।'
শব্দহীনতায় আমার খুব কষ্ট হয়। ফজলের মৃত্যুর শীতলতায় কাতর যুবক।
ওপাশে রুবা মুঠোফোনে কান রেখে ইতিউতি তাকায়। চোখের সামনে রাত্রির গাঢ় অন্ধকার, তারাজ্বলা আকাশের বিশালতা। নিজের নিশ্বাস মুঠোফোনে আঘাত খেয়ে সমুদ্রের মতো শোঁ শোঁ আওয়াজে ফিরে আসছে।
'তোমাকে নিয়ে আমার খুব ভয়। শুধু তোমাকে নিয়ে নয়, মানুষকে নিয়ে, এমন কি আমাকে নিয়েও। এই যে "আমি" নামক মানুষটির অসুস্থ অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। তবু এ অস্তিত্বে তোমার সুগভীর
বিস্তার। আহ! রুবা, অনিন্দ্যসুন্দর জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে তোমার প্রবেশ। আর এ কারণে আমার ভয়। সীমাবদ্ধ বেঁচে থাকার মধ্যে আমাদের সম্পর্ক অনন্তকালের নয়। তবুও অতৃপ্তি, হাঁ-পিত্যেশ কার জন্য? রুবা, প্রিয় রুবা আমার, আজকাল মানুষের মৃত্যু আমাকে ভাবিয়ে তোলে। মানুষকে করুণা করতে ইচ্ছে করে।'
এক নাগাড় মুঠোফোনে কথা বলে তালহা। ওর কণ্ঠস্বর ক্লান্ত মনে হয়।
ও-প্রান্ত থেকে মৌনতা ভঙ্গ করে রুবা বলে, 'কোন মানুষের জন্য?'
নিঃশব্দ মুঠোফোন। দু-পাশেই কোনো সাড়াশব্দ নেই। যেন নিরন্ধ্র এক গহ্বরে অনন্তকালব্যাপী ঘুমিয়ে আছে।
'আমি মানুষটার জন্য। যার প্রতি অঙ্গ দুর্নিবার এক উন্মাদনার মধ্যে রুবা নামক নারীর হূদয় উষ্ণতার জন্য কাঙালের মতো প্রতীক্ষা করে।'
'আমি করি না। জগতের কোনো নারী প্রতীক্ষা করে না। নিয়ম নেই। এক জীবনের দায়ভার।'
'আমার ফজলের জন্য কষ্ট হচ্ছে। তাহমিনার জন্য। ও মেয়েটি ফজলকে স্বপ্ন দেখাতে পারেনি।'
পথ হাঁটছে তালহা। ফজলুল হক হলে সাকিব থাকে। অফিস থেকে বেরিয়ে হলে সাকিবকে না পেয়ে লিটন হলের মাথায় এলেই গেটের কাছে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে দেখা; কবরে শুয়ে আছেন। সাধক মানুষ। ঘুমান। তালহার হঠাত্ ইচ্ছে হয় তাঁকে শুনিয়ে বলে, 'বেশ তো, জ্ঞানতাপসের নামাবলিতে মগ্ন আছ, বাপু। ফজল তো পারেনি। ওর কাঁচা বাঁশে ঘুণ ধরেছে। কিছুই হজম করতে পারেনি। না প্রেম না কবিতা। একজন মানুষের মৃত্যু হলো।'
দোয়েল চত্বরে পেরোনোর সময় মেডিকেল কলেজের দিকে তাকায়। মনে পড়ে, মহিলা হোস্টেলের সাত নম্বর রুমে তাহমিনা থাকত। ফজল সব প্রথা ভেঙে তাহমিনার রুমে বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মন্ত্রসিদ্ধ প্রেমিক নতজানু, কৃপাভিক্ষা দাও।
টিএসসির দিকে হাঁটতে থাকে তালহা। বাংলা একাডেমীর সামনে আসতেই তালহার মনে হলো, এটা কী মাস? নভেম্বরের শেষ। রাতে হালকা শীত পড়ে। ওর মনে হলো, ওর জ্বর আসছে। চোখে কোনো রং নেই। শুধু ধূসরতা। স্বাধীনতা উদ্যানের সবুজ চত্বরে সবুজ নেই। শুধু ধূসরতা। এখন কি পাতাঝরার দিন?
এ সময় মুঠোফোন বেজে ওঠে।
'অ্যাই, তুমি কোথায়?'
তালহা জবাব দেয়, 'বাংলা একডেমীর সামনে।'
'আমি লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে "মোগল হেরেম" পড়ছি।'
তালহার ভীষণ মন খারাপ। রুবা এখন 'মোগল হেরেম' পড়বে কেন? রাজা-বাদশাহদের লাম্পট্যের কাহিনি পড়তে ওর ভালো লাগবে? ভাবতেই তালহা হতাশ হলো! ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে ওর হাতে সিলিভিয়া প্লাথের 'দ্য বেল জার' থাকলেই বেশি আপন মনে হতো। অথবা হেমিংওয়ের পরাজিত না হবার আত্মত্যাগ।
'সিঁড়িতে বসে মানুষ ফিকশন পড়ে। তুমি পড়ছ লাম্পট্য কাহিনি।'
ও-পাশ থেকে রুবা বলে, 'তুমি কী বলছ?'
'বলছি, পুরোনো লাইব্রেরির এই রাস্তা দিয়ে আমি এবং ফজল অসংখ্যবার পদচিহ্ন রেখে গেছি। তখন না ফজল না তাহমিনা—কেউ কাউকে বুঝতে চায়নি। এখন যদি তাহমিনা প্রশ্ন করে, ফজল শুদ্ধ প্রেমিক নয়। এক রৈখিক লজিক টিকবে না। পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে নারীর কাছে একজন পুরুষ চাইতেই পারে। ফজল কিছু চায়নি।'
রুবা বলে, 'আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। গেট দিয়ে ঢুকছ। দূর থেকে তোমাকে কবি কবি দেখাচ্ছে। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ।'
লেনের বাঁক ঘুরতেই সিঁড়িতে রুবাকে দেখে তালহা। মুঠোফোন বন্ধ করে রুবার পাশে বসে। পাশে পার্সের সঙ্গে রাখা জনাথন উইলিয়ামের 'দ্য মোগল হেরেম'।
'আজ কয় তারিখ, তালহা?'
'সাতাশ নভেম্বর। কেন?'
'তুমি কি তোমার জীবনের মহামূল্যবান সময়টুকু মনে রাখবে না?'
'কিছুই মনে রাখতে চাই না।'
'আমি হ্যামলেটের কুটিলতাটুকু বুঝি। তারচেয়ে বরং চারুকলার সামনে ফুচকা খেয়ে তোমার জন্মদিন সেলিব্রেট করি।'
অনেকটা অবাক হয় তালহা। রুবা তালহার হাত ধরে লাইব্রেরির গেট পেরিয়ে চারুকলার দিকে হাঁটতে থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খায়। দুজনে কথা বলে না। চলমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। পরস্পর চোখের দিকে তাকায় না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নামছে।
'তুমি কি আমার সঙ্গে টিএসসির দিকে যাবে?'
তালহা কোনো কথা বলে না। বাধ্য প্রেমিকের মতো রুবার সঙ্গে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকে। রুবা তালহার হাত ধরে পথ হাঁটছে। তালহার তুলনায় রুবা বেশ খাটো। তালহা পাঁচ ফুট সাত। সুঠাম শরীর। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে মতিঝিলে এক ইন্ডেটিং ফার্মে যোগ দিয়েছে। আগামী স্বপ্নাচ্ছন্ন।
'তুমি তাহমিনার কথা বলছিলে?'
তালহা একটু আনমনা। রুবার কথা কিছুই শুনতে পায়নি। নজরুলের মাজার পেরিয়ে টিএসসির কাছে চলে আসে। জসীমের ক্যাফেতে দুটো স্যান্ডউইচ, দু-কাপ কফির জন্য কুপন কেনে রুবা। তালহা যন্ত্রের মতো রুবার আচরণবিধি দেখে।
'আজকের দিন আমার জন্য খুব দুঃখের দিন। আজ ফজলের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম।'
'মৃত্যু অনিবার্য। ও নিয়ে এত ভাবতে হয় না। সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্যতা থাকতে হয়। জাপানিরা হারিকিরি আত্মহত্যা করে বীর খেতাব পাবার জন্য। তুমি কী জানো, এ পৃথিবীতে যত আত্মহননের ইতিহাস, তা প্রেমকে কেন্দ্র করে। হারিকিরির মধ্যেও প্রেম-উপাখ্যান আছে।'
তালহা নীরবে স্যান্ডউইচ খায়। ক্যামন কলকলিয়ে কথা বলছে রুবা। তালহার অনুভূতির মধ্যে শূন্যতার বসবাস। হু হু করা বাতাস বুকের ভেতর একাকী করে দিচ্ছে।
'আমি তাহমিনার জন্য শোক প্রকাশ করছি।'
হঠাত্ করে তালহার মনে হলো, রোকেয়া হল থেকে শামসুন্নাহার হলের মুখ পর্যন্ত যেসব নরনারী দাঁড়িয়ে আছে, তারা যেন এক-এক জন সারিবদ্ধ তাহমিনা। কবি ফজল মাহমুদ হেমন্তের এই মিষ্টি সন্ধেবেলায় নিয়ন সাইনের নিচে দাঁড়িয়ে সহস্র বুক তৃষ্ণা নিয়ে কাতর।
কফিতে মুখ দিয়ে বলে, 'ফজল কীভাবে আত্মহত্যা করল?'
মেডিকেল হোস্টেলের সাত নম্বর রুমে ফজল তাহমিনার সঙ্গে শেষ কথা বলে। সায়দাবাদ গিয়ে বাস ধরে কুমিল্লায় চলে যায়। যাওয়ার পথে ন্যায্যমূল্যের বিষের দোকান থেকে এক বোতল এনড্রিন কিনে নেয়। তারপর একদিন মধ্যরাতে বিষপানে আত্মহত্যা করে। সংবাদপত্রে আত্মহত্যা নিয়ে যে রিপোর্ট, তা ওর ডায়েরির তিন দিন আগের লেখা। কোথাও তাহমিনার নাম নেই।
'তাহমিনার কথা কিছু লেখেনি? রুবা প্রশ্ন করে।'
'তাহমিনা শুধু কাঁদছে।'
অনেকক্ষণ ওরা দুজন কোনো কথা বলল না। একসময় তালহার হাত ধরে টিএসসি পেরিয়ে মেডিকেলের দিকে হাঁটতে থাকে রুবা। রুবাকে ভয়ানক বেদনার্ত মনে হচ্ছে। নিঃশব্দে পথ হাঁটে ওরা। শহীদ মিনারের সামনে এসে সিঁড়িতে বসে পড়ে। তালহাকে শান্ত-শিষ্ট অবোধ বালক মনে হয়।
রুবা নিজকে ভাবে, কাতর নারী।
'তালহা, আমার তাহমিনার জন্য কষ্ট হচ্ছে। আমি লজিক দেখাত পারি। ফজল উন্মাদ। শিল্পপ্রেমিক। সবকিছুই ওর পক্ষে সম্ভব।'
'আমার শুধু ফজলের জন্য কষ্ট হচ্ছে।' ভীষণ মৌন কণ্ঠ তালহার।
'ফজল মাঝে মাঝে এসে জন্মভিক্ষা করত নবীন প্রেমিকের মতো। ফজল অতীত, তাহমিনা বর্তমান।'
ওভাবেই অনেক সময় কেটে যায়। পরস্পর টুকরো টুকরো কথা হয়।
'আমার অনার্স ফাইনাল ডিসেম্বরের তিন তারিখ। কিছুই পড়া হয়নি' রুবা বলে।
'আমি পরশু রাতের গাড়িতে চিটাগাং যাব অফিসের কাজে।'
'ফিরবে কবে?'
'দু-দিন পর।'
'সি-বিচে যেয়ো না, এক সঙ্গে যাব।'
'আচ্ছা।'
আবার সিঁড়ি থেকে রাস্তায় নামে ওরা। রুবা রিকশাকে শাহবাগের দিকে যেতে বলে। রিকশায় রুবা পেছনে হাত দিয়ে তালহাকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'আজকে আমি তোমাকে একটা জিনিস দিব, যা আমি এক জীবন সঞ্চয় করে রেখেছি।' বলেই খুব লম্বা করে ওর ঠোঁটে চুমু খায়। তালহা হতভম্বের মতো রুবার দিকে তাকায়। রুবা পাগলের মতো ওর ঠোঁট কামড়ে ধরে। যেন এক আদিম তৃষ্ণার্ত মানবী।
রুবা বলে, 'তুমি একমাত্র তুমিই। আমি তাহমিনা হতে চাই না।'
আর এ সময় তালহার দু-চোখ বেয়ে জল গড়ায়। রিকশা টিএসসি পেরিয়ে শাহবাগের দিকে এগোতে থাকে।