গত বছরের শেষ সময়টায় ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দুই বড় জোটের সংঘর্ষে নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে চলছিল অগ্নিযুদ্ধ এবং নির্মম সন্ত্রাস। পেট্রল বোমা মারা হচ্ছিল সাধারণ পাবলিক বাসে, নিরীহ প্রাণী গরুর ট্রাকে, নিহত হওয়ার করুণ কাহিনীগুলো বাড়ছিল। রাস্তার পাশে থেমে থাকা বাসে ও গাড়ীতে ঘুমিয়ে পড়া বাস কর্মচারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল। ফিশ প্লেট খুলে পাবলিক ট্রেন এক্সিডেন্ট করিয়ে মারা হচ্ছিল সাধারণ নিরীহ পাবলিককে। সে এক ভয়ঙ্কর সময় ছিল জাতির জীবনে।
আন্দোলন এদেশে বা দুনিয়াতে বহুভাবে হয়। ফ্রান্সে একদিনে হাজার গাড়ীও পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু একজন মানুষও পুড়েনি। এদেশেও বহুবার রেল অবরোধ হয়েছিল, লাইন খুলে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, রেল চলবে না, কিন্তু গোপনে ফিশ প্লেট খুলে রেল এক্সিডেন্ট করানোটা মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ানক অপরাধ। যে ক্লান্ত ড্রাইভার গাড়ীতে ঘুমিয়ে ছিল, তাকে পুড়িয়ে মারা মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ানক অপরাধ ছিল। এ অপরাধগুলো মসজিদে, ঈদের জামাতে, মার্কেটে, কোন দরগার অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করার মত ভয়ানক অপরাধ। এ অপরাধগুলো আত্মঘাতি হওয়ার মত ভয়ানক অপরাধ। ভীরু, কাপুরুষ, নির্দয়-নির্মম মনের অধিকারী অপরিণামদর্শীদের কাজ। যাকে প্রতিপক্ষ ভাবা হচ্ছে তাকে কিছু করতে না পেরে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে যে কিংবা যারা এটা করে তারা মানুষের মন থেকে উঠে যায়, এটা তারা ভাবে না বা প্রাপ্তির তীব্র লড়াইতে সাধারণ ব্যাপক মানুষ যেন গণনার বিষয়ই না। এসবের ফল হয়েছিল ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে এবং এরপর বিরোধী শিবির আন্দোলন আর চালাতে পারেনি। ব্যাপক জনসমর্থন না থাকলে কোন আন্দোলন সাধারণত সফল হয় না। মানুষ সরকার বিরোধী যতই হোক, আন্দোলনের কৌশল ছিল তালেবানী নির্মমতার কৌশল, সেজন্য জনগণ তাতে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নামার আহবান প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং নির্লিপ্ত থেকেছিল। কারণ জনগণের কাছে স্পষ্ট ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে সরলে ভাল কেউ আসবে। বরং মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
কেন বার বার এদেশে পাঁচ বছর পর পর এরকম আন্দোলন চলে? এর একমাত্র কারণ ক্ষমতা। ক্ষমতা থাকলে অনেক কিছু করা যায়। রাজনীতিকে বিশাল লাভের বিষয় করে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি ফুটপাতের দোকান থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা পায় সরকারি দলের লোকরা। কাল ক্ষমতা পরিবর্তন হলেই এর নিয়ন্ত্রণ যাবে আরেক দলের কাছে। তারাই সরকার পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রাখে। সঙ্গী হয় নতুনভাবে যারা এসব দোকানগুলো পাবে, তারা। সরকার ঘনিষ্ঠ কারো হয়তো কয়েকটি লাইসেন্স বাগিয়ে অর্জন করে শত কোটি টাকা। একটি ব্যাংকের লাইসেন্স না-কি বিক্রি হয় একশ' কোটি টাকা, একটি ভিওআইপি লাইসেন্স ত্রিশ কোটি টাকা, একটি সমুদ্র জাহাজের মাছ ধরার লাইসেন্স দুই কোটি টাকা, বাণিজ্যিক জাহাজের লাইসেন্স পাঁচ কোটি টাকা। কেউ তা না পেয়ে দীর্ঘকালের নীতিগত অবস্থান পরিবর্তন করে হয়ে যায় সরকার বিরোধী। কোন সংস্থার নির্বাহী পদগুলোও সেরকম লাভজনক, সরকার পক্ষের সুশিলরা অনেকে তা পায়। জেলা উপজেলায় সাধারণ কর্মীরা টেন্ডারের ও সরকারি অন্যান্য সরবরাহের সকল নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তারা বড় বড় বাড়ী করে ও গাড়ী চালায়। চাঁদপুরের এক বকলমী ইউপি চেয়ারম্যান রাতারাতি কিনে ফেলে কোটি টাকার গাড়ী (লোকে বলে মন্ত্রীর মত গাড়ী কিনেছে)। কারণ বালি সরবরাহের সকল নিয়ন্ত্রণ যে তার হাতে। তিনি মন্ত্রীর লোক ছিলেন। এভাবে রাজনীতি বিশাল লাভজনক বিষয় হয়ে গেছে। প্রতি পাঁচ বছর পর একদল বেনিফিশিয়ারীর সে রাজ্য ধরে রাখা এবং আরেকদলের সে রাজ্য দখল করার লড়াই শুরু হয়ে যায়। হিরুইন খোড়ের কাছে যেমন টাকা দিলে যে কোন কাজ এমনকি খুনও অবিচলভাবে করে আসে, নেশাটা তার প্রধান, মানুষ বা দেশ সমাজ তার কাছে গৌণ, এই বেনিফিশিয়ারীদের হাতে তেমনি। তারা রাজনীতির কথা বলে আসলে নিজেদের দলকে ধরে রাখার একটি কনফিউশান সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি করে মাত্র।
দুর্নীতি করার মধ্যে তারা যে আর্থিক ও অস্ত্র শক্তি, রাষ্ট্র শক্তি অর্জন করে তা সমাজের জন্যও হয়ে যায় আগ্রাসী। কেউ তাদের সমালোচনা করার সাহস করে না। ফেস বুকেও তাদের ভয়ে ফেক আইডি খুলে নেয়। তাদের কাছে পুলিশ, প্রশাসন, আইন ব্যবস্থা সব জিম্মি হয়ে যায়, সব যেন তাদের দাসে পরিণত হয়ে যায়। সব তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা কারো জমি দখল করলে শক্তিতে বা আইনে তাদের থেকে তা উদ্ধার করা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। সমাজে এরকম টাকা যত বাড়তে থাকে তত সমাজ বিপজ্জনক ও অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠে। টাকাওয়ালারা কোন মন্ত্রীকেও জনসম্মুখে শাসায়। টাকার জোরে আদালতের রায়ও কেনা হয় বলে জনমনে কোন কোন রায়ে ধারণা জন্মে। কার্ল মার্ক্স যেমন বলছিলেন, কোন প্রাপ্তি যদি তিনশ পারসেন্ট লাভের বিষয় হয়, তখন কোন ব্যক্তি জীবনের উপরও রিস্ক নেয়, মানে মরিয়া হয়ে উঠে। সেখানে আদর্শ বলে আর কিছু থাকে না।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বা যা-কিছুই বলা হোক, দুর্নীতির কাছে সব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ইমাম যদি সঠিক না হন তবে পেছনে নামায পড়া মুসল্লিদের মনে প্রশ্ন জাগেই। তখন সরকারের পক্ষে বা বিরোধী পক্ষে, কোথাও মানুষ স্বস্তি পায় না, আস্থা পায় না। সুতরাং যতকিছুই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, আসল জায়গায় সমাধান করা না হলে এ পরিস্থিতি যে সামনে আরো ভয়ঙ্কর হবে, তা বলাই বাহুল্য। আর তার জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করা ছাড়া অন্যকোন পথ নেই। আইনের শাসন নিশ্চিত হলেই গণতন্ত্রও নির্ভেজাল হয়ে উঠবে। তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরো আইন করা বা ক্ষমতার বিন্যস্ত আর কিভাবে করা যায়, তা করতে সকলে উদ্যোগী হবে, টেন্ডার দুর্নীতি না হওয়ার টেকনোলজি ব্যবহার করে, চাকরিতে ব্যক্তির কোন প্রভাব না পড়ার পদ্ধতি করা হবে, পদোন্নতি ও বদলিতে সরকারের ব্যক্তিগত প্রভাব না থাকার আইন তৈরি হবে, দুর্নীতি করার কোন সুযোগ কোথাও থাকবে না। তখন মৌলবাদও গণতন্ত্রের কায়দা কানুনের কাছে পরাজিত হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদেশের দুই জোটের দুই প্রধান নেত্রী ক্ষমতায় থাকলে প্রত্যেকটি ক্ষমতার মেয়াদে দুর্নীতি আগের চেয়ে বাড়ে। তারা কি এইসব দুর্নীতিবাজ বিরাট বাহিনীর কাছে অক্ষম, অপারগ, না-কি তারাই আসলে উপরে যা-ই বলেন নীচে দলের দুর্নীতিপরায়ন বেনিফিশিয়ারীদের আর্থিক ও সন্ত্রাসী সমর্থককে বাড়িয়ে তোলার শীর্ষ ভূমিকা পালন করেন! তা যদি হয়, তবে এর সমাধান জনতার রোষানলের কাছে বাস্তিল দুর্গ পতনের মত কেবলমাত্র সামাজিক বিপ্লবে ছাড়া সম্ভব না।