কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে
কত মানুষের ধারা,
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে
সমুদ্রে হল হারা।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে নানা জাত, গোষ্ঠী ও বর্ণের মানুষের বসবাস। ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তারা পালন করে। সেই অর্থে সংস্কৃতি বৈচিত্রের অপার ও মোহনীয় সম্পদ ভাণ্ডার রয়েছে পাহাড়ি জুম্ম জাতির মধ্যে। এ দেশের নাগরিক, এ জাতিরই অংশবিশেষ জুম্ম জাতির সকল সম্পদরাজি আমাদেরই সম্পদ। বিপুল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময় সম্পদও আমাদেরই সম্পদ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম ২১.২৫ - ২৩.৪৫ উত্তর দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। বস্তুত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অসংখ্য পাহাড়-পর্বত অধ্যুষিত অঞ্চলই পার্বত্য চট্টগ্রাম বলে পরিচিত। অঞ্চলটির সর্বমোট আয়তন ২৩ হাজার ১ শত ৮৪ বর্গকিলোমিটার এবং দেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ জুড়ে বিস্তৃত। আশির দশকের প্রথমার্ধে প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি স্বতন্ত্র জেলায় ভাগ করা হয়। এর উত্তর-পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও মিজোরাম, দক্ষিণে মায়ানমার, পূর্বে লুসাই পাহাড় এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা। অগণিত উঁচু-নিচু পাহাড়, উপত্যকা ও খাঁড়ির মধ্যে ১৩৬০ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন পর্বত শৃঙ্গটি সর্বোচ্চ। বান্দরবানে অবস্থিত দুই শৃঙ্গের নাম তাজিং ডাং। শতকরা ৯০ ভাগ এলাকাই পাহাড় বেষ্টিত এবং ঘন সবুজ অরণ্যানীতে আচ্ছাদিত প্রাকৃতিক অঞ্চল। চির সবুজ, সম-পত্রঝরা, বাঁশ ঝাড় ও ঘাস বন—এই ৪ ভাগে বিভক্ত পার্বত্য এলাকার ৮৬.৩ ভাগই বনাঞ্চল। মোটমাট ১৪টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তথা অদিবাসীর বসবাস এ অঞ্চলে এবং এরা প্রায় একশতটি গোত্রে বিভক্ত। এগুলো যথাক্রমে—চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঙ্কঙ্গা, বম, খেয়াং, লুসাই, ডাক, লুমি, মুরং, পাঙন, রাখাইন, চাক ও গুর্খা। সম্প্রদায়গুলো বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। প্রকৃতির শীতল কোলে আশ্রিত বলে ধর্মের চেয়ে প্রকৃতি-কেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠান সংখ্যাধিক। সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রতিটি সম্প্রদায়। ভাষা, পোশাক-আশাক, বাড়ি-ঘর, সামাজিক বিধি-বিধান, ধর্ম, সংস্কৃতি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণতই ভিন্ন। এমনটি পৃথিবীতে সত্যিই বিরল। জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
দুটি প্রাকৃতিক ও একটি কৃত্রিম হরদ রয়েছে, নাম যথাক্রমে বাইনখিয়ং ও বগাকাইল এবং কাপ্তাই লেক। আর নদী রয়েছে ৪টি। এগুলো হলো কর্ণফুলি, সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও ফেনী। জলপথের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩শ কিলোমিটার।
পাহাড়ি ভূমি চাষাবাদের জন্য খুব উপযুক্ত নয়। তবে পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকার সমতল ভূমিতে তুলা, ধান, চা ও তৈল বীজের চাষ হয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যবাহী তাঁতের কাপড় এবং বাঁশ ও বেতের নানা ধরনের উপকরণ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সুনিবিড় এবং অচ্ছেদ্য। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পর্যায় যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে উদ্ভিদ তথা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাকে জুম্ম জাতিও বলা হয়, জুম্ম পদ্ধতিতে এরা চাষাবাদ করেন বলে। পাহাড়ে-বনে-জঙ্গলে বাস করে বলে এরা বুনোও নয়, জংলীও নয়। এরা আদিবাসী, অনেকেই আদিম অধিবাসী। খ্যাতনামা লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় যেমন বলেছেন, 'আদিবাসীরাই এ দেশের আদিম অধিবাসী। যখন আর্যভাষীরা ছিল না তখন আদিবাসীরা ছিল। ... বনে বাস করলেই কেউ বনমানুষ হয় না। তাদের বুনো বলা বা মনে করা অন্যায়। মুনি-ঋষিরাও বনে বাস করতেন।' পাহাড়ি জুম্ম জাতির প্রধান সাংস্কৃতিক উত্সব বৈসাবি বা বিজু। ১৩ হাজার ১শ ৮১ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সহজ-সরল মানুষ বাঙলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে বৈসাবি উত্সব উদযাপন করে। পাহাড়ি অঞ্চলের ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনায় নানামুখী আয়োজনের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় এই ঐতিহ্যবাহী উত্সবটি পালন করে। পাহাড়ের সবুজ অরণ্যানী এ সময়টায় মুখরিত হয়ে ওঠে। কর্ণফুলী, শঙ্খ, মাতামুহুরী ও ফেনী নদীর কোল ঘেঁষে পাহাড়ি মানুষের প্রাণের বন্যা বয়ে যায়। প্রভাত বেলায় স্নান অতঃপর ফুল সংগ্রহ, তারপর বিহারে (বৌদ্ধ বিহার, উপাসনালয়) সমবেত হয়ে জগতের সকল প্রাণীর জন্য কল্যাণ কামনা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতার পর ভোজ পর্ব। দিনের শেষে সাঁঝ বেলাতে নৃত্য-গীত ও পানাহার। এই হলো বৈসাবি উত্সবের একনজরে দিনমান কার্যক্রম। ঐতিহ্যবাহী থামি পোশাক-আশাক গায়ে চাপিয়ে গরাইয়া বা বোতল নৃত্যের ছন্দ ও তাল সৃষ্টি করে মোহনীয় পরিবেশ। স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত পানীয় চক পান করে উপস্থিত সকলে হয়তো একে একে যোগ দেয় নৃত্যে-গীতের গতিময়তার ছন্দে। পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে বৈসাবি উত্সবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ব্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য প্রতীক্ষা ও প্রস্তুতি চলে। মূল অনুষ্ঠান একদিন তথা ১ বৈশাখে হলেও এর আগে দুদিন ও পরে দুদিন ওই পাঁচ দিন নানা আচারে মুখরিত হয় পাহাড়বাসী মানুষ। মোটামুটি পুরো সপ্তাহজুড়েই আনুষ্ঠানিকতার ঘনঘটায় উদ্বেলিত হয় তারা। অন্তত এ সময়টা দৈন্য, অভাব, ক্লেশ ভুলে গিয়ে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলে বেহিসেবি হয়ে ওঠে।
পাহাড়ি জুম্ম জাতিগুলোর প্রাণের উত্সব বৈসাবি মূলত প্রকৃতি-নির্ভর। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদরাজিকে অবলম্বন করেই এই উত্সব আয়োজিত এবং পরিচালিত। প্রকৃতির সঙ্গে মৌলিকতার এবং অকৃত্রিমতার সম্বন্ধ আছে। বলাবাহুল্য, অকৃত্রিম উপকরণের মধ্যে শরীর, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানের যোগসূত্র আছে। এই বিচারে বৈসাবি উত্সবের যাবতীয় আয়োজনে নির্মল উপাদান সংযুক্ত। ধরা যাক, সকালে জলে অবগাহনের মধ্য দিয়ে দেহকে শুচিস্নিগ্ধ করা হয়। পাহাড়ের শরীর বেয়ে ফুটে থাকা নানা জাতের ফুল সংগ্রহ করলে স্বভাবতই মন পবিত্র ও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। অতঃপর বিহারের মিলনমেলায় কুশল বিনিময় এবং সমগ্র সম্প্রদায়ের কল্যাণ কামনা নিজেদের ভেতরে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করে। ওইদিন প্রস্তুতকৃত ভোজন দ্রব্যের মধ্যে যেন সমগ্র পাহাড়-প্রকৃতি নিবেদিত হয়। এই উত্সবের মূল যে আকর্ষণ বা আইটেম তা হলো যাবতীয় শাক-সবজির তরকারি। এই রান্নায় এক নীরব প্রতিযোগিতা কাজ করে গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর মধ্যে। কোন বাড়িতে কত বেশি জাতের সবজি সংগ্রহ এবং সহযোগে এই আইটেমটি প্রস্তুত করতে পারে—এই নিয়ে প্রতিযোগিতা! ভাবখানা, সংখ্যায় যার যত বেশি সবজি পরিবেশন হবে, সে জিতে গেল। অথবা তার আভিজাত্য প্রকাশ পেল।
আমরা বৈসাবি অনুষ্ঠান উপভোগ করতে একদা রাঙামাটি আশ্রয় নিয়েছিলাম। শহরের আনন্দ বিহারে অবস্থান করলেও নববর্ষের সূচনা দিন কাটালাম রাঙাপানি গ্রামে। শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে। একে একে যাবতীয় অনুষ্ঠানমালায় সম্পৃক্ত থেকে স্বচক্ষে দেখার আগ্রহে এই ব্যবস্থা। বিহার প্রধান ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো, যিনি ভান্তে বলেই সমধিক পরিচিত এবং সম্প্রদায়ের সকলে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এই সম্বোধনেই তাকে ডেকে থাকে। ভান্তের আমন্ত্রণে আমাদের সেখানে যাওয়া এবং রাঙাপানিও নিয়ে যান তিনি। রাঙাপানি সম্পর্কে দুকথা বলার আগে পুরোনো প্রসঙ্গ শেষ করি। মধ্যাহ্ন বেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারের সকলের সঙ্গে সাক্ষাত্ এবং আহার পর্ব। খাদ্য উপকরণের মধ্যে তিনটি পর্ব। প্রথমে চক জাতীয় পানীয়, এরপর ফল-ফলারী এবং সবশেষে প্রধান একটি সবজি তরকারির সঙ্গে একেক সবজির আলাদা কয়েক পদের তরকারি। মাছ-মাংস এবং রুটি বা খিচুরি। এসব পরিবেশিত হতে থাকে একে একে যার সবগুলোই পাহাড়ের কোল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এক বাড়িতে আমরা ৫৬টি সবজির তরকারি পেলাম। গুনে গুনে ৫৬। অবিশ্বাস্য এবং বিস্ময়করই বটে। ওই রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। সকল শাক-সবজিতেই কম-বেশি ঔষধি গুণ বিদ্যমান। বিদ্যমান অ্যান্টিবডি ও রোগ-বালাই প্রতিরোধক ক্ষমতা। বছরের প্রথম দিন সবজিরাশির গুণাগুণ শরীরে সারা বছরের জন্য সঞ্চয়ের ভাবনা থেকে এর চল শুরু হয়েছে। জানালেন স্থানীয় একাধিক বয়সী মানুষ।
এক এক করে পরিচয় হয়ে যায় পাহাড়ি মানুষ ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে। সাঁঝ বেলা ঘনিয়ে এলে পানীয় ও নৃত্য-গীত। জুম্মদের প্রবাদ, প্রবচন, গীত, হিতোপদেশ, গীতিকাব্য, নাতিকাব্য ইত্যাদি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তবে এগুলোর বেশির ভাগই প্রকৃতি, সমাজ, প্রেম ও ঈশ্বরের বন্দনায় ভরপুর। বিষয়ের বিভাজন অনুযায়ী আলাদা আলাদা নামও রয়েছে। যেমন, গোজেনের লামা, উবাগীত, বারোমাসী, বা-না, কাট্টনের ডাক ইত্যাদি। পরিবেশিত গীতের বিষয়বস্তু হিসেবে আমরা যেটুকু বুঝতে সমর্থ হয়েছে, সেটা হলো—সারা বছর আমরা সকলে মিলেমিশে ভালো থাকব, পাহাড় ও প্রকৃতি রক্ষা করব, জীবের সেবার মধ্য দিয়ে আমরা নিরন্তর ঈশ্বরের সেবা করব। এগার শতকের সবিশেষ উল্লেখযোগ্য চাকমা কবি শিবচরণ প্রচুর গীত রচনা করেছেন। সাত খণ্ডে গোজেনের লামা লিখেছেন। এখনও এই উপকরণের কিছু কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। এমনি একটি লামার কিয়দংশের উল্লেখ এখানে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। 'অপার পানি সাগরে, ত্রিশ তিন জাতি ভাজ পড়তুম গই অগরে। ভজে মানেই লোক এই কালে, যমে ন ধরিব ওই কালে। যে বর মাগে সে বর পায়, গোজেনে বর দিলে ন ফুরায়। গোজেনে মেইয়া উদ নেই, বুঝি পারি কে ভেই সেই। পরম বৃক্ষে ভর দিয়া, বুঝি পারি কে ভোর মেইয়া? সকল জীবে দয়া হোক, চিত্তে মনে একা হোক।' ঐতিহ্যবাহী লোকজ নাচ-গান এবং নানা বৃক্ষের পাতা, বাকল বা মূলের রসে বানানো পানীয়ের স্বাদ আস্বাদনে পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতির মানুষরা বরণ করে নববর্ষকে, নতুন বছরকে।
কাপ্তাই লেকের পানি রঙিন (নীল) বলেই হয়তো গ্রামের নাম রাঙাপানি। অদূরেই বলা যায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা শহর থেকে। ১৯৭৪ সালে এ গ্রামে মনোঘর নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পথচলা শুরু হয়েছে। চারদিকে ৭-৮ কিলোমিটার জুড়ে জুম চাষ এবং মাঝে মাঝে অনেকটা অস্থায়ী গুচ্ছ ঘরবাড়ি। বস্তুত জুম চাষের ফসল জীবজন্তুর কবল থেকে রক্ষার জন্য এ রকম বসত গড়ে বাড়ি তৈরি হয়েছে। এগুলোর মাঝেই মনোঘর। অনাথ ও অসহায় দরিদ্র পরিবারের পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের আশ্রয় ও শিক্ষাকেন্দ্র হলো মনোঘর। মনোঘর শব্দের অর্থ হচ্ছে পাহাড়ি ঘর। বৌদ্ধ ভিক্ষু, সামাজিক উদ্যোক্তা ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের উদযোগে ১৩৪.৮ একর জমির ওপর বর্তমানে মনোঘর দাঁড়িয়ে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর ভেন. প্রজ্ঞানন্দ একজন অকৃতদার, সজ্জন এবং সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি। তিনি মনোঘর এবং ঢাকায় বসবাসরত আদিবাসী ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও আবাসনের জন্য মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত বনফুল আদিবাসী স্কুল ও কলেজ—এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পেছনে জীবন ব্যয় করে প্রায় বার্ধক্যের কোঠায় পা রেখেছেন। মনোঘরে গিয়ে যে কেউ বলবেন বুঝি এটি একটি পল্লী। ঠিক মাঝ বরাবর একটি পুকুর। চারদিকে ঘরবাড়ি, স্থাপনা। ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক ঘর ছাড়া স্কুল, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল, চারুশিল্প কেন্দ্র, পালি কলেজ, আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র, মানবাধিকার সচেতনা কেন্দ্র, দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি ভবন রয়েছে।
বিগত সাড়ে তিন দশকে মনোঘরের অর্জন কম নয়। বরং নিভৃত জনপদে বাইরের সহায়তা ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ স্থানীয় উদ্যোগ ও তত্পরতায় চলমান এ প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য ঈর্ষণীয় বলতেই হবে। এ যাবত ৩৩ হাজার অসহায় ছেলেমেয়ে মনোঘর থেকে লেখাপড়া শেষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরও প্রায় ১ হাজার ছেলেমেয়েকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে লেখাপড়ার যোগান দেওয়া হয়েছে মনোঘর থেকে। বর্তমানে মনোঘর শিশু সদন নামে সুপরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার পেছনে একটি ঐতিহাসিক প্রেরণা অলক্ষ্যে কাজ করেছে। সেটা বিবৃত করে এই বয়ান শেষ করা যাক।
ষাট দশকের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকার মানব বসত, প্রকৃতি, পরিবেশ ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেয়। জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের নিমিত্ত কাপ্তাইয়ের এই বাঁধের ফলে ৫৪ হাজার একর জমি জলমগ্ন হয়। প্রায় এক লাখ আদিবাসী মানুষ ঘরবাড়ি ও সহায়-সম্বল হারিয়ে উন্মূল হয়ে পড়ে। বিনা নোটিশে প্রায় ২০ হাজার মানুষের সলিল সমাধি হয় অথবা অনাহারে মারা যায়। সরকারের অপরিকল্পিত ও দায়সারা পুনর্বাসন কার্যক্রম বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কোনো উপকার করেনি। ওই সময়ে বোয়ালখালি দাসাবল বৌদ্ধ রাজবিহার এবং পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম আশ্রয়হীন ক্লিষ্ট শিশুদের খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিত্সা সেবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি, ভিক্ষু ও সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ধর্ম ও মহামতি বুদ্ধের বাণী বলে প্রচার করেন—জলে জমি নিয়েছে, সম্পদহারা করেছে। শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন কর, তা কখনও হারাবে না, কেউ অপহরণও করতে পারবে না। সেবা ও শিক্ষার এই পথ বেয়েই মনোঘরসহ পার্বত্যাঞ্চলে বর্তমানে ব্যাপক শিক্ষাদীক্ষার প্রসার ঘটেছে। ঢাকার মিরপুর পর্যন্ত যা বিস্তৃত হয়েছে। নগর সভ্যতা থেকে দূরে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থেকেও তারা আলোকিত। সমাজ ও জীবনকে তারা নিরন্তর আলোকিত করে চলেছে।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক