
অতীতের ভুলগুলোকে ফুল করে নতুন আশার প্রাণোচ্ছ্বাসে কল্যাণ ও নবজীবনের আনন্দধারার রঙে নিজেকে রঙিন করার দিন পহেলা বৈশাখ। রবি ঠাকুরের চিরন্তন আগামী গান 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো'—যেন আনন্দের দোলা লাগায় মনের চোর কুঠরীতে। কী জানি কী হয়, অবাক বিস্ময়ে সমস্ত কর্মযজ্ঞকে পেছনে ফেলে বাঙালিরা পথে নামে নতুন বর্ষকে বরণ করে নিতে। ধর্ম, বর্ণ আর সংস্কার মানুষের মানুষে যে ভেদাভেদের জন্ম দিয়েছে নষ্ট সময়ে, সেই ভ্রান্ত সময়ের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হাতে হাত রাখে সব বাঙালি। এমন প্রাণের উত্সবে কে থাকে দুয়ার বন্ধ করে, কে করে নিঃসঙ্গ অশ্রুপাত! মনের কালো মেঘ নিমেষেই উধাও হয় বৈশাখী আনন্দ ঝড়ের তাণ্ডবে। কত না উদ্যোগ, কত না কর্মপন্থা বৈশাখকে স্বাগত জানানোর জন্য। বাহারি রঙের মাঝে সব মানুষই তথাকথিত সংস্কারের বেড়ি উপেক্ষা করে লৌকিকতার ঢঙে। বৈশাখ যেন সবাইকে এনে দেয় তারুণ্য। সবুজ কচি পাতার পেছনে দিনের প্রথম সূর্যরশ্মি সর্বস্তরের মানুষকে ছুঁয়ে যায় পুণ্য আলোতে। গ্রাম, শহর আর আদিপাড়ার সকল ধর্ম-বর্ণের সর্বস্তরের মানুষ এক সাথে পালন করে এই প্রাণের উত্সব। হূদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ব্যপ্ত হওয়া স্বপ্নময় ধ্বনি যেন পূর্ণতা পায় নতুন বছরের আগমনীতে। বৈশাখ একই সাথে প্রেম আর দ্রোহের—যেখানে রোদ্দুরের কোমলতায় বৈশাখ হয় মঙ্গলময়। তপ্ত দুপুরে বৈশাখ কখনও কখনও নিসর্গের মায়ায় শীতল হয় বিমূর্তক্ষণের ভালোবাসার অশ্রুতে। প্রেমের দহনে হয় অঙ্গার। সময়ের ব্যবধানে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারাতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বৈশাখের আনন্দঘন কোলাহল ঠিকই ছুঁয়ে যায় নাগরিক কিংবা আটপৌরে সব কিছুতেই। বাঙালি বা বাংলাদেশি নামের যে বিতর্ক বা ব্যবধানই করা হোক না কেন বৈশাখ সবাইকে এমন এক উত্সবের রঙে রঙিন করে যেখানে খুব ক্ষীণ হয়ে যায় এ ধরনের মতপার্থক্য। এ উত্সবের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলা বর্ষপঞ্জি আর মাটি সংলগ্ন উত্পাদনশীলতার কাব্য। হিন্দু সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বাংলা ১২টি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌরপঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। এক সময় নববর্ষ ঋতুধর্মী উত্সব হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। বর্ষের সাথে কৃষি আর কৃষির সাথে ঋতুর ঘনিষ্ঠতাই এর মূল কারণ। মূলত কৃষিকাজের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবর তার সভাসদ জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরজীর পরামর্শে হিজরী চন্দ্রাসন ও বাংলা সৌরসনের উপর ভিত্তি করে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ১০ বা ১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। আর সেটা কার্যকর হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের তার সিংহাসন আরোহনের সময় থেকে। প্রথমে 'ফসলি সন' নামে অভিহিত হলেও পরে তা পরিচিতি পায় 'বঙ্গাব্দ' নামে। মুঘলদের সূচনার পর বৈশাখ প্রথাকে পরিপূর্ণতা দিতে কালে কালে তার সারথী হয়েছে কখনও জমিদার, তালুকদার আবার কখনোবা ভুঁইয়া কিংবা অন্য ভূ-স্বামীরা। চৈত্রসংক্রান্তিতে বাংলার কৃষকরা ভূ-স্বামীদের পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে খাজনা পরিশোধ করার পরের দিন নববর্ষে তাদের ঘরেই মিষ্টিমুখ করত। ক্রমান্বয়ে পূণ্যাহই হয়েছে হালের হালখাতা বা গদিসাইত। পুরোনো হিসেব-নিকেষ চুকিয়ে নতুন খাতা খোলার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রেতা সাধারণদের আপ্যায়ন করে মিষ্টি আর নানান উপঢৌকন দিয়ে। আর হিন্দু ব্যবসায়ীরা তাদের হালখাতাকে সৌভাগ্যের নিদর্শন স্বরূপ রাঙায় সিঁদুর রঙে। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীরাও চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে আনন্দে মেতে উঠে আদিবাসী ঐতিহ্যবাহী 'বৈসাবি' উত্সবে। পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় এই উত্সবকে ত্রিপুরারা 'বৈসুক', মারমারা 'সাংগ্রাই' ও চাকমারা 'বিজু' নামে আখ্যায়িত করে থাকে। মূলত এই তিন নামের আধ্যক্ষরের দিয়েই 'বৈসাবি' শব্দের উত্পত্তি। সেই আদিকাল থেকে বছরের শেষ দু'দিন আর নতুন বছরে প্রথমদিন এই তিনদিন মিলেই বর্ষবরণ উত্সব 'বিজু' পালন করে আসছে পাহাড়িরা। তিনভাগে বিভক্ত এই উত্সবের প্রথম দিনকে বলা হয় 'ফুল বিজু'। এই দিন শিশু-কিশোররা পাহাড়ি ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। চৈত্রসংক্রান্তিতে নানা সবজি দিয়ে উপাদেয় নিরামিষ 'পাজন' রান্না করা বৈসাবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া পিঠা, মিষ্টি আর দই তো আছেই। শুধু পাহাড়েই নয়, ভাটি ও সমতল অঞ্চলের গ্রাম্যবধূরা চৈত্রের শেষ দিবসে তৈরি করে 'আমানি'। একটি বড় হাঁড়িতে অনেকটুকু জলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয় আম ও চাল। পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয় একটি স্বপত্র আমের ডাল। নববর্ষের প্রথম প্রহরে বাড়ির গৃহিণীরা সবাইকে জাগিয়ে তুলে খেতে দেয় সেই ভেজানো চালের 'অমৃত'। আর বিশ্বাস থেকে জন্ম নেওয়া সংস্কার—আমডালের শীতল জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় শরীরে। সেই সাথে পান্তা ইলিশ, দই-চিড়া, সবজি ও বড় মাছের তরকারি ও মিষ্টি তো আছেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন পোশাক কেনা ও পরার ধুম লাগে। বছরের প্রথম দিনটি ভালো থাকার অর্থ হলো, সারা বছর ভালো থাকা—সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে প্রতিটি বাঙালি নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই সাধ্যমতো আয়োজন করে বৈশাখকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। অতিথির গমনাগমনে ব্যস্ত থাকে প্রতিটি বাঙালি বাড়ির চৌকাঠ। নববর্ষের নব হর্ষকে আরও প্রাণবন্ত করতে গ্রামে গ্রামে লোকজ মেলার আয়োজন করা হয়। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির মাঝে পূজা-পার্বণ কিংবা লোকজভিত্তিক মেলা পুষ্টি পেলেও সার্বজনীনতা লাভ করেছে বৈশাখী মেলা। হস্তশিল্প, মৃিশল্প, কৃষিজাত ও কারুপণ্যসহ বিবিধ পণ্যের কেনাবেচায় মেলা প্রাঙ্গণ যেমন পায় উত্সবমুখরতা তেমনি চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা, তিলের খাজা, নিমকি, মুড়লি প্রভৃতি বাহারি খাবারের ব্যঞ্জনা জিভে এনে দেয় জল। শুধু পেটের ক্ষুধা বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের চাহিদা পূরণই নয়, মনের ক্ষুধা মেটাতে মেলা প্রাঙ্গণে জুড়ে অনুষ্ঠিত হতে থাকে যাত্রা, কবিগান, পালাগান, জারিগান, গাজীর গান, আলকাপ, বাউল, মারফতি, মুর্শিদিসহ রাধাকৃষ্ণ, লাইলী-মজনুর আখ্যানও। বৈশাখের আনন্দে বৈচিত্রময় নানান ধরনের খেলা উত্সবে যোগ করে ভিন্নমাত্রা। এর মধ্যে একসময় খুব প্রচলিত ছিল মুন্সিগঞ্জের গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই ও পায়রা উড়ানো। এই খেলাগুলো কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলেও ঐতিহ্য নিয়ে এখনও টিকে আছে পুরোনো ঢাকার ঘুড়ি ওড়ানো উত্সব, চট্টগ্রামের বলীখেলা, রাজশাহীর গম্ভীরা ও বিভিন্ন অঞ্চলের নৌকা বাইচ ও মোরগ লড়াই। এ ছাড়া আদিবাসীদের মধ্যে পানিকে পবিত্র ও শুদ্ধতার প্রতীক ভেবে নিয়ে মেতে উঠে 'পানি খেলা' উত্সবে। বৈশাখী মেলায় শিশুদের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় নাগরদোলা, বায়স্কোপ, সার্কাস, পুতুল নাচের আয়োজন। মিশ্র সংস্কৃতি আর নব্য সভ্যতার শহর ঢাকার বৈশাখী উত্সব শুরু হয় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। এই আয়োজন ছায়ানট নিরবচ্ছিন্নভাবে করে আসছে ১৩৭২ বঙ্গাব্দ বা ১৯৬৫ সাল থেকে। ছায়ানটের বর্ষবরণ উত্সব কালের পরিক্রমায় বিস্তৃতি লাভ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভযাত্রা, বকুলতার প্রভাতী অনুষ্ঠান, টিএসসি ও সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রবীন্দ্র সরোবর, ধানমন্ডি লেক ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, নজরুল একাডেমিসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নববর্ষ উদযাপনের জন্য আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠানের। লালপেড়ে সাদা শাড়ি, কপালে লালটিপ, হাতে কাচের চুড়ি আর খোঁপা বা গলায় বেলী ফুলের মালার সৌরভ—এ যেন চিরায়ত বাঙালি ললনার প্রতিচ্ছবি। বৈশাখে সেই নারীর সাথে বাহারি পাঞ্জাবি পরা পুরুষের নান্দনিক সম্মিলন ঘটে সমস্ত ঢাকার রাস্তা জুড়ে। রমনায় কলাপাতা কিংবা সানকিতে পান্তা-ইলিশ আর হরেক রকমের ভর্তা যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও নাগরিক ব্যস্ত মানুষকে মুড়ে দেয় বাঙালিয়ানার মোড়কে। হাত, মুখ, কপালে আল্পনা এঁকে বৃদ্ধা-যুবা সবাই অংশ নেয় চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়। হাতে ফেস্টুন আর মুখে মুখোশ থাকলেও সবার কণ্ঠে থাকে রবি ঠাকুরের হূদয়গ্রাহী অজেয় সেই গান 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো'। বৈশাখ এনে দেয় স্বাধীনতা আপন আকাশে চিত্রকর্ম আঁকার। ধর্ম-বর্ণ ও সংস্কারহীন সার্বজনীন এই উত্সব আমাদের বাঙালিত্বের তীব্র অহংকার। আমাদের ঐক্যবোধের শিখা। যে শিখার দহনে কালে কালে পূণ্য হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। আর এই প্রজন্মই বুকটান করে দাঁড়ায় অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, মুগ্ধ হয় বাংলার রূপ দেখে। ভালোবাসে এ দেশের মাটি আর মানুষকে।
ছবি এমএইচ মিশু