বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সাথে যাত্রাগানের একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বহুকাল আগে থেকে। গ্রামীণ জনপদে বৈশাখী অনুষ্ঠানমালায় যাত্রাগান প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। যাত্রা বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হিসেবে যাত্রা আমাদের দেশে আবহমানকাল হতে সামাজিক ও লোকশিক্ষা এবং নির্মল আনন্দদানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি পুরাণ, ইতিহাস, লোকগাঁথা ও নীতিশিক্ষাদানের বিষয়টিও যাত্রার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে যাত্রা কেবল বাংলাভাষা এবং আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশই নয়। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাথে এর রয়েছে অন্যতম প্রধান যোগসূত্র। যাত্রা তাই গ্রামীণ মানুষের কাছে যেমন তেমনি শহরের মানুষের কাছেও উপভোগ্য একটি বিনোদন মাধ্যম। এককথায় যাত্রা পারিবারিক শিল্প মাধ্যম। পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করা যায় বলে এর কদরও সংস্কৃতির অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে বেশি। বহু বছর আগে থেকে চর্চিত হয়ে আসা বাংলা যাত্রাগানের একটি নিজস্ব নিয়ম-নীতি রয়েছে। পেশাদার যাত্রাদলে মৌসুমভিত্তিক হিসেব করা হয়। দুর্গাপূজার সপ্তমীতে মৌসুম শুরু হয়ে শেষ হয় বাংলা ৩০ চৈত্রে। কিন্তু নববর্ষের সাথে এর সম্পর্ক গড়ে ওঠায় এখন আর চৈত্র চলে গেলেও যাত্রা শেষ হচ্ছে না। শহর থেকে দূরে গ্রামে-গঞ্জে বৈশাখী মেলানুষ্ঠানে যাত্রাগানের ঐক্যতান বেজে উঠতে শুনা যাচ্ছে। বরাবরের মতো এবারও বাঙালি তার ভেতরে লালিত সংস্কার আর সংস্কৃতির মিশেলে পালন করতে যাচ্ছে বাংলা নববর্ষ-পহেলা বৈশাখ। বৈশাখের প্রথমদিন ঘিরে গান-বাদ্যি আর উত্সব আমেজে মেতে ওঠা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখ বাংলা সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় অসামপ্রদায়িক উত্সব। দিনটিকে বরণ করে নিতে আকুল হয়ে আছে গোটা জাতি। সারাদেশেই লোকজ উত্সবে, প্রাণে প্রাণে মহামিলনে, সবাই কণ্ঠ মিলিয়ে গাইবে: "এসো হে বৈশাখ, এসো"। পেশাদার যাত্রাদলেও বৈশাখের তাত্পর্য তুলে ধরে গান-বাজনা ও পালা মঞ্চায়ন হবে। এবার বৈশাখী যাত্রাগানের বড় আয়োজন হচ্ছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানা ফাঁসিতলায়। এখানে সার্কাস, পুতুল নাচ ও বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজনের সাথে পৃথক পাঁচটি যাত্রার আসর বসবে। প্রতি রাতে ৫টি প্যান্ডেলে প্রযোজিত পালাগুলো দর্শক উপভোগ করতে পারবেন বিপুল উত্সাহ ও উদ্দীপনার সাথে। আদি ভোলানাথ অপেরা, নিউ ভোলানাথ অপেরা, আদি বঙ্গশ্রী অপেরা, চৈতালী অপেরা, পদ্মা অপেরা, প্রতিমা অপেরা, নিউ রাজমহল অপেরা, আনন্দ অপেরা, আদি রংমহল অপেরা, নিউ ফাল্গুনী অপেরা চ্যালেঞ্জার যাত্রা ইউনিট, কোহিনূর অপেরা, কেয়া যাত্রা ইউনিট, পলাশ অপেরা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, দোয়েল অপেরা, সবুজ অপেরাসহ অসংখ্য যাত্রাদল মাঠে নেমেছে। এ মৌসুমে এই দলগুলো খুবই আলোচিত ও নন্দিত হয়েছিল। যাত্রা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি এ কথা আজ সর্বস্বীকৃত। ধর্মীয় উত্সব উপলক্ষ্যে আয়োজিত শোভাযাত্রায় পৌরাণিক কাহিনী গীতবাদ্য-অভিনয়ের উপস্থাপনা একসময় যাত্রাগান হিসেবে পরিণতি লাভ করে। সময়ের বিবর্তনে যাত্রার রূপ বদলে গেছে। বিষয়ে, আঙ্গিকে, উপস্থাপনা রীতিতে যাত্রা এখনো সামাজিক বিনোদন, জনজ্ঞাপন, শিক্ষণ এবং প্রভাব বিস্তারের ফলে প্রায়োগিক জনমাধ্যম হিসেবে গ্রহণীয়। আধুনিক নগর জীবনে যেমন থিয়েটার, গ্রামীণ জনপদে তেমনি যাত্রা এখনো অন্যতম বিনোদন মাধ্যম হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। স্থূলতা, গ্রাম্যতা ও অশ্লীলতার অভিযোগ এবং নানা নেতিবাচক ধারণা সত্ত্বেও যাত্রার প্রভাব ও বৈভবকে অস্বীকার করা যায় না। বহুমুখী ইলেক্ট্রনিক্স মাধ্যমের প্রবল প্রতাপের এই প্রযুক্তির যুগেও বাংলাদেশের শতাধিক যাত্রাদলের কর্মকাণ্ড যাত্রাশিল্পের গুরুত্বকেই প্রমাণ করে। আর মৌসুম শেষের পরেও এর মঞ্চায়ন অব্যাহত থাকায় দর্শকপ্রিয়তার প্রমাণ মিলে। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত যাত্রাগান বাংলার লোকজ মেলার সাথে এভাবেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকুক এ কামনা সকলেরই।