
ইট-কাঠ-কংক্রিটের নগরী চট্টগ্রাম। নগরজুড়ে ব্যস্ততা আর কোলাহল। কোটি টাকার বাণিজ্যের নগরীতে কোলাহল আরো বেড়ে যায়, যদি উত্সবের উপলক্ষ হাজির হয়। তেমনই একটি উপলক্ষ বর্ষবরণ। নগরবাসীর কাছে এই উত্সব মানুষে মানুষে সম্মিলনের অন্যতম উপলক্ষ। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ডিসি হিলের নজরুল মঞ্চ থেকে সমবেত কণ্ঠে শোনা যায় 'মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা'র সুর। অগ্নিস্নানে এই ধরণীকে শুচি করতে ওরা গায় বর্ষবরণের গান। অশ্রুবাষ্প মুছে নতুন বছরকে বরণ করতে পুরবাসীর কাছে এই আহ্বান জানানো হয়। সকাল হতেই নগরবাসী ছুটে বেড়ায় প্রাণের উত্সবে। শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের এই মৌসুমি বাংলা নববর্ষ বরণ চলে কয়েকদিন ধরে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উত্সবের মূল কেন্দ্র ডিসি হিল। নগরবাসীরা কেবল কবিগুরুর মতো কেবল 'এসো হে বৈশাখ! এসো এসো'— বলে আহ্বানই করে না, নজরুলের সেই 'এলোকেশে ঝড় অকাল বৈশাখী' হানা দিচ্ছে কিনা সেটাও ভাবে। বৃষ্টিবিহীন দিনে চট্টগ্রামের ডিসি হিলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। যে আয়োজন চলে আসছে ১৯৭৩ সাল থেকে। নগরীর ডিসি হিল ছাড়াও সিআরবির শিরিষতলায় সাত রাস্তার মোড়, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি চত্বর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসজুড়ে চলে বর্ষবরণের নানান আয়োজন। নাগরিক ইট-কাঠ-কংক্রিটের ভিড় ঠেলে তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ী নববর্ষের বরণেও থাকে বর্ণিল আয়োজন। সবমিলে নববর্ষ চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনে অন্যরকম মাত্রা যোগ করে। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে শুরু হয় হালখাতা। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী টেরিবাজার, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখ করিয়ে ক্রেতার সাথে হালখাতার মাধ্যমে মেলবন্ধন আরও সুদৃঢ় করেন। নগরীর অন্যতম আকর্ষণ শিশু-কিশোরদের বিদ্যাশিক্ষার পাঠশালা সহজপাঠ ফুলকির বর্ষবরণ। বৈশাখের প্রথম দিবসে শিশু-কিশোরদের নানান অনুষ্ঠানে মহাসমারোহ বয়ে যায় এখানে। নগরীর মহিলা সমিতি স্কুলের মাঠেও থাকে বর্ষবরণ মেলা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নববর্ষ উত্সব উত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র উত্সব। আয়োজনের মাত্রা এবং ব্যাপকতায় এটি সকলের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে। নগর থেকে কিছুটা দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যারা বর্ষবরণ করতে চান তারা এসে মাতোয়ারা হয় এই ক্যাম্পাসে। পাহাড়-ঝর্ণা আর সমতলভূমির এই ক্যাম্পাসের বর্ষবরণে থাকে নানান লোকজ সংস্কৃতির সমাহার। দিনভর সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরাও সামিল হয় নিজেদের এই ক্যাম্পাসে। নগর থেকে বাহারি শাটল ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে ফিরতে হয় সেই রাতে। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা, মার্মা ও চাকমা আদিবাসী সমপ্রদায় বৈশাখ উদযাপন করে বৈ-সা-বি নামে। এখানে অন্যতম উত্সব মার্মাদের জলকেলী। এইদিনে নানান পদের মিষ্টান্ন, পায়েসতো আছেই, সাথে থাকবে নানান স্বাদের ও বৈচিত্র্যের পাহাড়ি খানাখাদ্য। জলকেলীর মাধ্যমে যে উত্সব তা যেমন যুবক-যুবতীদের মধ্যে অন্যতম উত্সব তেমনিই পাড়ায় পাড়ায় নানান আদিবাসী উত্সবে মিলিত হয় নানা বয়সী আদিবাসীরা।
চৈত্রের শেষ প্রহরে, মানে বাংলা বছরের শেষদিনটির পর উত্সবের শুরু চট্টগ্রামে। সেই বর্ষবরণের সমাপ্তি টানা হয় বলী খেলার মাধ্যমে। চট্টগ্রামের ভাষায় কুস্তিকে বলা হয় বলী খেলা। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে মেলা। কোটি টাকার বাণিজ্য হয় এই মেলায়। মুড়ি-মুড়কি থেকে শুরু করে খাচ-পালং সবই পাওয়া যায় এখানে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের আবদুল জব্বার সওদাগর শুরু করেন এ খেলা। বাঙালি যুবকদের ইংরেজ-বিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনে সুদক্ষ কর্মীবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য লালদীঘি ময়দানে চালু করা হয় বলী খেলা। এটি চট্টগ্রামে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে নতুন জোয়ার নিয়ে আসে। ফলে লালদীঘি ময়দানে জব্বারের বলী খেলা হয়ে ওঠে দেশপ্রেমিক জনসাধারণের দীক্ষা গ্রহণের মঞ্চ। চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে তরুণ থেকে মধ্যবয়সীরাও অংশ নিতেন বলী খেলায়। এতে দেশপ্রেমের মন্ত্রণা দেয়াই ছিল বড় কাজ, জয়-পরাজয় তো ছল কেবল। ব্রিটিশ সূর্য অস্তাচলে, পাকিস্তানি বাহিনী লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে, বিদেশি শত্রু নেই, বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন ভূমি। তাতে কী? এখনো জব্বার মিয়ার বলী খেলা আর লালদীঘির মেলা উদ্দাম, মুখর। উপলক্ষ বদলে গেলেও বাঙালির উত্সবের তালিকায় যুক্ত হয়ে গেছে এ মেলা আর বলী খেলা। এই মেলা সমাপ্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে চট্টগ্রামে শেষ জয় পনেরো দিন ধরে চলা বর্ষবরণ! এই নগরে একটা সময় ছিল যখন গ্রামীণ এই উত্সবগুলো ছাড়া জীবন কল্পনা করা যেতো না। বৈশাখের মেলার জন্য সেই বর্ষা থেকেই প্রস্তুতি। শরত্-হেমন্ত-গ্রীষ্মজুড়ে চলে কেনা এবং বেচার দুই দলেরই আয়োজন। ভরদুপুরের ঘুমের আগে বৈশাখী মেলায় যাওয়ার স্বপ্ন বা গল্প হতো শয্যাসঙ্গী। বর্ষবরণ উত্সবে অচেনা হাজারো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে কল্পনার এক জগত্ তৈরি হতো সবার। বছর বিদায় নিতো, বছর আসতো সেখান থেকেই। কিন্তু বিশ্বায়িত সংস্কৃতির প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মেলা। গোটা সংস্কৃতির মধ্যেই যখন এর প্রভাব পড়ছে, বর্ষবরণও বাদ নেই। গান, নাটক, কবিতা পাঠ, খেলাধুলাসহ নানা বিচিত্রানুষ্ঠান চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে পাড়া-মহল্লায় ও গ্রামেই বেশি দেখা যেতো। এখন বাস্তবের মেলার চাইতেও টেলিভিশনের পর্দার মেলা অনেককেই টানে। এসব সাংস্কৃতিক উত্সব-চালচলনের মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী টান ছিল, সেদিন আর নেই। দিন বদলে গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বৈশাখী উত্সব বা নববর্ষ পালন দিনে দিনে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। বাঁশির জায়গা দখল করেছে ভিনদেশী ভুভুজেলা। হারিয়ে যাচ্ছে হাত কাঠির ভেল্কি ঢাকের শব্দ। মালকোচা ধুতি পরে একবাদ্যে তারা ঢাক পেটান, ঢাকি নামেই যাদের ডাকি! সেই ঢাক আর তেমন একটা বাজে না বর্ষবরণে। আগে যারা মাতিয়ে রাখতেন এই বর্ষবরণের দিনটি; এখন সেসব ঢাকিরা সারাবছর নীরবে কেঁদে চলেন। সবার অলক্ষ্যে একটি দীনহীন জীবনই সম্বল যেন তাদের। পুরোনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছর এলেও তাদের ভাগ্যাকাশে আসে না কোন ভাগ্যদেবী! নাগরিক বর্ষবরণে আবেগের চেয়ে আয়োজনের পাল্লাই ভারি। বাণিজ্য আর কর্পোরেটের সর্বগ্রাসী থাবা সুকুমার উত্সবগুলোতেও। বহুজাতিক কোম্পানি আর মনোলোভা পণ্যের বিজ্ঞাপনে এখন মানুষের সাথে মানুষের মিলনে মুনাফা খুঁজে বেড়ায়। বিলবোর্ড আর সাইনবোর্ডের বিজ্ঞাপনের চাপে লুকিয়ে থাকে মানুষের সমবেত উপস্থিতি। খুব ধীরে হলেও খেয়াল করা যায়, বর্ষবরণ তার জৌলুস আর নিজস্বতা হারাচ্ছে এইসব উত্সবে।