বঙ্গদেশে পঞ্জিকার সূচনা অষ্টাদশ শতকে। হিন্দুদের মধ্যেই পূজা-পার্বণে তিথি নক্ষত্র দেখা এবং বিবাহ-ব্যবসা-বাণিজ্য, কোথাও যেতে হলে পঞ্জিকায় শুভাশুভ লগ্ন বা দিনক্ষণের ভালো-মন্দ দেখার প্রয়োজনীয়তা থেকে পঞ্জিকার প্রয়োজন অনুভূত হয়। কিন্তু ছাপানো পঞ্জিকার যুগ তখনো শুরু হয়নি। তবে দৈবজ্ঞ বা জ্যোতিষীরা তিথি-নক্ষত্র দেখে সাংকেতিক ভাষায় সূত্রাকারে গ্রহ-নক্ষত্রের উদয় ও সঞ্চারের বিবরণ এবং তার প্রভাবে শুভাশুভ, শুভযাত্রা এবং ভাগ্য ও পরিণাম ফল নির্ধারক হাতে লেখা ছোট ছোট পুঁথি তৈরি করতেন। এসব পুঁথি সহজলভ্য ছিল না আর সহজলভ্য হলেও এর সাংকেতিক ভাষা ও সূত্রের দুর্জ্ঞেয়তার কারণে সাধারণ মানুষ এ পঞ্জিকার অর্থ উদ্ধার করতে পারত না। প্রতিবছরের সূচনায় দৈবজ্ঞ-পঞ্জিকাকারদের বেশ রমরমা ব্যবসা হতো। এই দৈবজ্ঞ ব্যবসায়ীরা ছিল ব্রাহ্মণ—তবে সর্বোচ্চ শ্রেণির নন। তা না হলেও লোকচরিত্র সম্পর্কে এদের বেশ ধারণা ছিল। এদের কিছু সম্মোহনী শক্তিও ছিল। ফলে এরা পঞ্জিকার ব্যবসাটা বেশ চুটিয়েই করতে থাকে। লালসালু কাপড় বেঁধে পঞ্জিকার হাতে লেখা বই হাতে নিয়ে এরা ঘুরে ঘুরে তাদের ব্যবসা চালাত। অর্থাত্ বিভিন্ন বাড়িতে যেয়ে পঞ্জিকায় লিখিত গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান এবং তার ফলাফল তাদের মক্কেলদের বুঝিয়ে দিত। অন্তঃপুরেও তাদের অবাধ যাতায়াত ও বিশেষ খাতির ছিল। মহিলারা শুচিস্নিগ্ধ হয়ে পঞ্জিকার বিবরণ শ্রদ্ধাভরে জেনে বুঝে নিতেন। এমন যে হাড়কেপ্পন মহিলা তারাও স্নিগ্ধচিত্তে পঞ্জিকাকারকে উত্তম আহার ও জল খাবারে আপ্যায়ন করে পঞ্জিকায় বর্ণিত নানা দুর্জ্ঞেয় রহস্য জেনে নিতেন।
যা হোক, প্রাচীন কৃষিসভ্যতার দেশ মিশরেই প্রথম পঞ্জিকা সংকলিত হয় প্রায় তিন হাজার বছর আগে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এরকম একটি প্রাচীন পঞ্জিকা সংরক্ষিত আছে। এই পঞ্জিকাটি বেশ পরিপূর্ণ। এত আগের পঞ্জিকা হলেও এতে লাল ও কালো কালিতে শুভ-অশুভ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের দিন ক্ষণ ও লগ্ন ইত্যাদি উল্লেখ আছে। প্রাচীন মিশরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং নীলনদের জলে কৃষিসভ্যতার বিকাশের ফলে পঞ্জিকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। উল্লেখ্য যে, প্রাচীন মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পঞ্জিকার সময় নির্ধারণে বড়ো ধরনের সাফল্যের পরিচয় দেন।
দুই.
ক্যালেন্ডার শব্দটি ল্যাটিন ভাষা থেকে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা নিয়েছে। এর ব্যুত্পত্তিগত অর্থ হিসাবের বই। আর আলমানাক শব্দটি, ধারণা করা হয় আরবি ভাষা থেকে এসেছে। এই আলমানাক আর বাংলা পঞ্জিকা একই ধরনের। মিশরের যে পঞ্জিকার কথা আগে বলেছি তা ছিল এই আলমানাক। এই আলমানাকে নাগরিক মানুষ ও গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের বিভিন্ন তথ্য এবং নানা ধর্ম ও উত্সব সংক্রান্ত বিবরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ও যাতায়াত সংক্রান্ত সংবাদ মুদ্রিত বা লেখা থাকে। মিশরে ও ইউরোপের রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন জুলিয়াস সিজার। পরে সাধু গ্রেগর তাঁর পরবর্তীকালের জগদ্বিখ্যাত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেন। উন্নতমানের এই পঞ্জিকা এখন বিশ্বব্যাপী চালু রয়েছে। আমাদের দেশেও এর ব্যাপক প্রচলন। আমলোকে একে 'ইংরেজি পঞ্জিকা' বা 'ইংরেজি বছরের পঞ্জিকা' বলে থাকে। কেউ কেউ একে খ্রিস্টীয় পঞ্জিকাও বলেন। দুটি কথাই ভুল। কারণ, এই পঞ্জিকা উদ্ভূত হয়েছে রোমে। রোমের মানুষ রোমান ক্যাথলিক। আর ইংরেজরা খ্রিস্টধর্মের অন্য শাখা প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী। দুইয়ের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। তাই ইংরেজরা ঘৃণা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে নতুন চক্রান্ত করে ১৭০ বছর পর্যন্ত এ পঞ্জিকা গ্রহণ করেনি। পরে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রটেস্ট্যান্ট আইন পাস করে ইংল্যান্ডে এ পঞ্জিকা গৃহীত হয়। এ পঞ্জিকা আসলে রোমান পঞ্জিকা যা জুলিয়ান এবং এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসাবে বিদ্বত্সমাজে পরিচিত।
তিন.
ইউরোপে প্রথম পঞ্জিকা ছাপা হয় ১৪৫৭ সালে। আর ইংল্যান্ডে প্রথম মুদ্রিত পঞ্জিকার হদিস মেলে ১৪৯৭-এ। ইংরেজরা এদেশ দখল করার পর থেকে এদেশে তখন হাতে লেখা পঞ্জিকার যুগ চলছে। এসব হাতে লেখা পঞ্জিকার মধ্যে আবার সামঞ্জস্যের অভাব ছিল। ফলে তাদের শাসনকাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তাই সরকারের অনুরোধে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পণ্ডিতদের সভায় পঞ্জিকার জন্য একটি সর্বসম্মত বিধি স্থির করে দেন। এভাবেই পঞ্জিকা সংকলন শুরু হয়। নদীয়ায় তখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যানিধি ওই বিধি অনুসরণ করে পঞ্জিকা সংকলন করে স্থানীয় নবাব, সামন্তপ্রভু ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পঞ্জিকা সংকলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে পঞ্জিকার নামপত্রে লেখা থাকত, 'মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমত্যানুসারে ফলিত।' সে সময় পঞ্জিকার (হাতে লেখা) দাম ছিল দু'আনা থেকে এক টাকা। সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে এক টাকার অনেক দাম। আর দামের এতটা ফারাক কেন সে প্রশ্ন উঠতে পারে।
বাংলায় যাকে আমরা পঞ্জিকা বলি, বাংলার বাইরে তা 'পঞ্চাঙ্গ' অভিধায় চিহ্নিত। সংস্কৃত নামের এই 'পঞ্চাঙ্গে' প্রাচীন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতো। যথা : বার, তিথি, নক্ষত্র যোগ ও করণ। আমরা পঞ্চাঙ্গ নাম হলেও এতে বিপুলতা, বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি তেমন দেখা যায় না। বাংলা পঞ্জিকা সে তুলনায় ঢাউস। আসলে বাংলা পঞ্জিকার নাম পঞ্চাঙ্গ হলেও যেন ঠিক হতো। বাংলা মুদ্রিত পঞ্জিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৩৫। এটি প্রকাশ করেন শ্রী রামহরি নামের জনৈক পঞ্জিকা প্রেমিক। আর আলমানাকধর্মী পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে। এতে বহু তথ্য, বিজ্ঞাপন, সন-সূচি ইত্যাদি সংযোজিত হয়। বর্তমানে প্রকাশিত গুপ্তপ্রেম ডাইরেকটরী পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১২৭৬ সনে। বাংলা ১২৯৯ সনে প্রকাশিত হয় বৃহত্ মুসলমান পঞ্জিকা। এই পঞ্জিকা সংকলন করেন মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ। ১৩১৪ সনে এই পঞ্জিকার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ২৭২।
চার.
সম্রাট আকবর তাঁর সভা-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজীর মাধ্যমে ভারতীয় সন ও পঞ্জিকার সংস্কার করেন। হিজরি ও ভারতীয় শকাব্দের সমন্বয়ে বাংলা সন তাঁরই প্রয়াসের ফল বলে কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন। ১৯৫০-এর দশকে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে শকাব্দ সনের সংস্কার করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার সাধন করা হয়। শহীদুল্লাহর সংস্কারে কিছু অপূর্ণতা ছিল। ১৯৯৪-৯৫ সালে বাংলা একাডেমির একটি টাস্কফোর্স আবারও সংস্কার করে এই পঞ্জিকা। সেই পঞ্জিকাই এখন বাংলাদেশে চালু রয়েছে। ট্রাক্সফোর্সের এই সংস্কারে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের ১৪ই এপ্রিলে প্রতিবছর ১লা বৈশাখ হবে। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরকম সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও যে পশ্চিমবঙ্গে তা কার্যকর হয়নি, তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি পঞ্জিকা প্রকাশকদের সিন্ডিকেটের জন্য। এদের কাছে সেখানকার সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।