নববর্ষের উদযাপনের ভেতরে যে সাধারণ বিষয়টি সবসময় স্পষ্ট থাকে, তা হল, পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরের আবাহন। কিন্তু এবারের বাংলা নববর্ষ শুধু নতুন বছরের আবাহনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। এই নববর্ষ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন সম্ভাষণে উদ্ভাসিত হয়েছে। এর ভিত্তি অবশ্য গতবারের নববর্ষের সময়ই তৈরি হয়। গত বছর বাংলা সন যেভাবে এসেছিল, তেমনটি আমরা এর আগে বোধহয় বার দু'তিনেক দেখেছি। একাত্তরের এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে অর্থাত্ বাংলা ১৩৭৮ সনের বাংলা নববর্ষ ছিল অবশ্য এক অন্য চেহারার। তখন ২৫ মার্চের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের রেশ চলেছে দেশব্যাপী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত শহীদ মিনার, বিধ্বস্ত দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, দি পিপল, ধ্বংস হয়েছে প্রেসক্লাবের একাংশ, বিভিন্ন ছাত্রাবাস, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাসমূহ। প্রতিদিন হত্যা-ধ্বংস আর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে দেশের সর্বত্র। নিরাপত্তার অভাবে মানুষ ছুটে বেড়িয়েছে এখানে-ওখানে। শহরের মানুষ সামান্য সহায়সম্বল নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আবার গ্রামের মানুষ শহরে ছুটেছে বাঁচার তাড়নায়। হণ্যে কুকুরের মতো দাবড়ে বেড়িয়েছে সর্বত্র পাকিস্তানি খুনি সেনা এবং সেই জল্লাদদের এদেশীয় দোসররা। ঘরে ঘরে আতঙ্ক-বিভীষিকা পুরুষশূন্য বাড়ি-গ্রাম-জনপদ। ঠিক এমনি একটা পরিস্থিতিতে সেদিন বাংলার বুকে এসেছিল বাংলা নববর্ষ, দ্রাঘিমাঙ্কিত পৃথিবীর দিনরাত্রির পরিক্রমার অমোঘ নিয়মে।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের যথাযথ বিচারের দাবিতে গত বছর যেভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শাহবাগ, সেই উত্তাল ঊর্মির ভেতরেই প্রকৃতির নিয়মে চলে আসে বাংলা নববর্ষ। বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ যেন প্রচণ্ডভাবে জেগে উঠেছিল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে। দু'মাস পর বাংলা নববর্ষ এসে যেন সেই জাগরণকে ছড়িয়ে দিল প্রতিটি মানুষের হূদয়ের গভীরে। সেটা ছিল এমন এক সময় যখন একদিকে চলছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে তাকে প্রতিহত করার গণজাগরণ। অস্তিত্বের সেই লড়াইয়ে অবশেষে বাংলার মাটির মানুষেরই জয় হয়। পরাজিত হয় একাত্তরের প্রেতাত্মারা। তবে তারা বসে নেই। এবারের বাংলা নববর্ষ আমাদের ভেতরে জাগিয়ে দেয় সেই শক্তি ও সাহস—যা দেশমাতাকে চিত্কার করে বলে—তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। যেই প্রতিবাদের, যেই সংগ্রামের বিপুলা ঢেউয়ের শত্রুরা ভেসে গিয়েছিল একাত্তরে। সে কারণেই বাহাত্তরের বাংলা নববর্ষের চেহারা ছিল একেবারেই উল্টো! সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার আনন্দে উদ্ভাসিত বাঙালির প্রাণের রঙে রাঙানো বাংলা নববর্ষ। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার প্রাণস্পর্শে উদ্বেলিত বাংলা নববর্ষ। এর পর থেকে প্রতিটি বাংলা নববর্ষ হয়েছে বাঙালির একান্ত আপন একটি দিন। এমনকি পঁচাত্তরের পরেও এই দিনটি বাঙালির হাতছাড়া হয়নি কখনো। ২০০১-এর নববর্ষের অনুষ্ঠানে জঙ্গি আক্রমণ হল। প্রাণহানি ঘটল বেশ কয়েকজনের। কিন্তু সেই হামলা নিবৃত্ত করতে পারেনি সংস্কৃতিমনা মানুষকে। বাংলা নববর্ষ আর সীমাবদ্ধ রইল না নাগরিক জীবনের গণ্ডিতে। এখন প্রত্যন্ত গ্রামের ঘরে ঘরে বাংলার মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে বাংলা নববর্ষের উত্সব।
এদেশের একটা অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো যখন ভাষা এবং বাঙালির অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র হয়, তখন ফুঁসে ওঠে বাঙালি একুশের মধ্য দিয়ে, যখন বাঙালির সংস্কৃতি আক্রান্ত হয় তখন জীবন্ত হয় বাংলা নববর্ষ। আর যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক মানসসত্ত্বা এবং মানবিক মূল্যবোধ আক্রান্ত হয়, তখন সর্বশক্তি নিয়ে জাগ্রত হয় স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস। এই চারটি সুদৃঢ় অক্ষয় স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্ব। তাই একাত্তরের সেই অবরুদ্ধ নগরীতেও বাংলা নববর্ষ এসেছিল রক্তরঞ্জিত পুষ্পাঞ্জলি নিয়ে। এখানেই বাঙালি অনন্য—তুলনাহীন।
বাঙালির জীবনের চারটি উত্সব সার্বজনীন। একটি একুশে ফেব্রুয়ারি, একটি বাংলা নববর্ষ, একটি স্বাধীনতা দিবস এবং আর একটি বিজয় দিবস। এই চারটি দিন সব বাঙালির চেতনার রঙে রাঙানো। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় অবনত হয় বাঙালি জাতি— কৃতজ্ঞতা জানায় তাঁদের উদ্দেশ্যে যাঁরা পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি ভূখণ্ডের অভ্যুদয়ের জন্য বছরের পর বছর সংগ্রাম করেছেন, জীবনদান করেছেন, বাংলাকে জাতীয় জীবনে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি অর্জনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে সফলতা নিয়ে এসেছেন এবং বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষির গর্ব করার জন্য একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ঠিকানা নিশ্চিত করেছেন।
বাংলার মাটি থেকে বাংলা মায়ের আঁচল থেকে যে ঘ্রাণ বয়ে নিয়ে যে মানুষটি ছুটে আসে গ্রাম থেকে নগরে কিংবা মহানগরে, তারা যেন নতুন এক আত্মিক টানে আত্মহারা হয়ে পড়ে নববর্ষের দিনটিতে। ফাল্গুনের বসন্তের আবেশ ছাপিয়ে চৈত্রের দাবদাহ, তার ভেতরেও বাংলা নববর্ষ কত শত রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। আর যে জিনিসটা ছাপিয়ে যায় সব কিছুকে, তা হল এই দিনের মানবতাবাদী রূপ। এ উত্সব সর্বজনীন। এ উত্সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির। আদিবাসীরাও বৈসাবি উত্সবের ভেতরে উদযাপন করে এই নতুন বর্ষকে। যে সাংস্কৃতিক উত্সব সব মানুষের জন্য, তার চেয়ে বড় মানবিক সৌন্দর্য আর কোথায় আছে? বাংলা নববর্ষ সেই সৌন্দর্যেরই আকর। অসাম্প্রদায়িক, মানবিক বাংলাদেশের শেকড়কে নতুন করে দেখায় এই বাংলা নববর্ষ। আর ষড়যন্ত্রকারীদের জাল ছিন্ন করার পর যে নতুন বছর আসে, সেই বছরের আনন্দ ছাপিয়ে যায় অতীতের সব আনন্দকে, যেমনটি আমরা দেখেছিলাম বিজয়ের পর বাহাত্তরের বাংলা নববর্ষের দিনটিতে। এবারের নববর্ষের আনন্দোচ্ছ্বাস আর উত্সবের ভেসে যাওয়ার আবেগ যেন বাহাত্তরের মতোই।