বৈশাখের প্রথম দিনে নববর্ষকে বরণ করে নিতে নানা আয়োজনে মুখর থাকে বাঙালিরা। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে শোভাযাত্রা ও বিভিন্ন আয়োজনে মুখোশের ব্যবহার বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তোলে। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ উদযাপন মুখোশ ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। মুখোশের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন জিনিসের প্রতিকৃতি। আর এই মুখোশের ইতিবৃত্ত নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজনে লিখেছেন রিয়াদ খন্দকার
শেষ বিকেলের সূর্যের আলোয় চারুকলায় ঢুকতেই মনে হলো মুখোশের হাটে ঢুকেছি। অনেকে বাহারি রঙের বিভিন্ন আকারের মুখোশ তৈরি করছেন। কেউবা মুখোশে রং করছেন, কেউ রঙের মিশ্রণ করছেন, অনেকেই ঘষে নিচ্ছেন মুখোশের কাগজের আস্তরণটি, কেউ শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন ভালোভাবে শেষ হয়েছে কি না। আর মাঝেমধ্যে একেকজন সমস্যা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন একেকজনের কাছে। তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন, কোথায় কোন রং করা হবে, কীভাবে আরেকটু সুন্দর করা যাবে মুখোশটি। প্রতি বছরেই বাঙালির সার্বজনীন উত্সব পহেলা বৈশাখ আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ এমনই উত্সবমুখর হয়ে উঠে সরা, মুখোশ ও পটারিও তৈরিতে। বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখে মুখোশের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮৮-৮৯ সাল থেকে। এর আগে নববর্ষ পালন করা হতো কিন্তু মুখোশের ব্যবহার হতো না। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে মুখোশের চাহিদা বেড়েছে। সারা বিশ্ব লোকজ ধারা থেকে আধুনিক ধারায় প্রবেশ করছে, মুখোশও এর ব্যতিক্রম নয়। এসব মুখোশ তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে সুইচ বোর্ড অথবা মোটা মাউন্ট বোর্ড। এগুলোকে প্রথমে বিভিন্ন আকৃতিতে কেটে নেওয়া হয়। তারপর সেগুলোকে পিন অথবা আঠা দিয়ে পেস্টিং করা হয় এবং সবশেষে তাতে করা হচ্ছে কালার ও বিভিন্ন ডিজাইন। এভাবেই একে একে তৈরি হয়ে উঠছে গোঁফওয়ালা রাজা, সুন্দরী রানি, রাগী বাঘ, লক্ষ্মী পেঁচাসহ নানা আকৃতির মুখোশ। তা ছাড়া আরও থাকছে আই মাস্ক। চোখে পরার জন্য। এটিতে সামনের চোখে আকৃতিতে কাটা থাকে এবং ওপরে থাকে নানা ডিজাইন। এ ছাড়াও পেপার ম্যাশ দিয়ে তৈরি করা হয় এক ধরনের মুখোশ। প্রথমে মাটি দিয়ে স্ট্রাকচার তৈরি করে তাতে কাগজ ও আঠা দিয়ে তৈরি হয় এটি। বিভিন্ন ধরনের মুখোশের মূল্য একেক রকম। তবে আই মাস্কগুলো ১০০ টাকায় পাবেন। তা ছাড়া ৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মুখোশও পাবেন সেখানে। মাটির সরা আমাদের ঐতিহ্য বহন করে। আর সরাচিত্র আমাদের শিল্প মাধ্যমের একটি বড় অনুষঙ্গ। মাটির তৈরি এ সামান্য সরাকেই গ্রামবাংলার মানুষ উত্সবে পালা-পার্বণে কখনও আলপনা আবার কখনও বা ছবি এঁকে অসামান্য করে তোলেন। সরার উত্পত্তি ও উত্কর্ষ ঘটে পূর্ববঙ্গের ঢাকা এবং ফরিদপুর অঞ্চলে। বাঙালিয়ানায় ঘর সাজাতে এর জুড়ি নেই। আর সরার ওপর রং দিয়ে আঁকা হয় নানা কাহিনীর চিত্ররূপ। শম্পা ও রাসেলের বাসায় খুবই পছন্দের বসার রুমটা। আর সেটির দেয়ালের এক পাশ সাজিয়েছেন তারা সরাচিত্র দিয়ে। তার একেকটা একেক রকম। কোনোটায় দুটি বাঘ একসঙ্গে, আবার কোনোটায় হুতুম পেঁচার মুখ। এ রকম নানা ধরনের সরাচিত্র অঙ্কন করা হচ্ছে নববর্ষবরণের প্রস্তুতি হিসেবে। তাতে ব্যবহার করা হচ্ছে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙের মতো উজ্জ্বল রংগুলো। এতে থাকছে পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে নানা ফোক মোটিফ, যার মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। কোনো কোনো সরাচিত্রে বর্ণিত হচ্ছে নানা রূপকথার কাহিনীও। আর চারুকলার নবীন-প্রবীণ শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় তাতে পাচ্ছে প্রাণ। এর মূল্য পড়বে ৪০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের ফুটপাথ ধরে একটি টেবিলে অনেকগুলো রঙিন মুখোশ নিয়ে বসে আছে কয়েকজন তরুণ। চোখের মুখোশ, বড় মুখোশ, মাটির পট, পুতুল সবই আছে তাদের ছোট্ট এই টেবিলে। তরুণরা সবাই ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের চারুকলা বিভাগের ছাত্র। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ছোট পরিসরে অনেকেই এই মুখোশ তৈরি এবং বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। মুখোশে মুখরিত এবারের বৈশাখের প্রথম দিনটি সকলের জন্য মঙ্গলময় হয়ে উঠবে, সকলের জন্য রইল শুভকামনা।