মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের আনন্দের দিন। অর্জিত অধিকার উদযাপন ও সংহত করার দিন। কিন্তু আমাদের শ্রমজীবী মানুষের নিকট এইবারের মে দিবসের আবহ একেবারেই ভিন্ন। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ যখন উত্সবমুখর পরিবেশে দিবসটি উদযাপন করিতেছে, বাংলাদেশে তখন চলিতেছে শোকের মাতম। শোকে যেন পাথর হইয়া গিয়াছে শ্রমজীবী মানুষের বুক। সাভার ট্র্যাজেডি আবারও চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল যে, কতোখানি নাজুক, কতোখানি অনিরাপদ এবং কতোখানি মূল্যহীন তাহাদের জীবন। সামান্য সান্ত্বনাটুকু পর্যন্ত নাই তাহাদের সামনে। একবার ভবন ধসিয়া, আরেকবার আগুনে পুড়িয়া মরাই যেন হইয়া দাঁড়াইয়াছে তাহাদের নিয়তি। অথচ এমন হইবার কথা ছিল না। কে না জানেন যে, অব্যাহত রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতাসহ নানা প্রতিকূলতার ভিতরেও এই শ্রমজীবী মানুষেরাই রক্ত সঞ্চালন করিয়া চলিয়াছেন অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাতগুলিতে। ইহার স্বীকৃতি বা প্রতিদান হিসাবে নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং উন্নততর জীবন অবশ্যই তাহাদের প্রাপ্য ছিল। প্রাপ্য ছিল সংবিধানস্বীকৃত সকল মৌলিক ও মানবিক অধিকার। কিন্তু বাস্তবতা হইল, প্রাণান্ত পরিশ্রমের পর যেই বেতন-ভাতা তাহারা পান তাহা দিয়া জীবনধারণ করাই কঠিন। ফলে উন্নততর জীবন তো দূরের কথা, কারখানার অমানবিক পরিবেশে এখন জীবন বাঁচানোই দায় হইয়া পড়িয়াছে তাহাদের জন্য। নিরাপত্তার অভাবে কর্মস্থলগুলি পরিণত হইয়াছে একেকটি ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদে। অথচ দেখিবার কেহ নাই। যাহাদের দেখিবার কথা তাহারা ব্যস্ত নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের নানা ফন্দিফকিরে। সর্বোপরি, শ্রমিকেরা যে সংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিজেদের দাবিদাওয়া তুলিয়া ধরিবেন সেই অধিকারটুকুও স্বীকৃত নহে পোশাক শিল্পে।
শ্রমজীবী মানুষের এই দুঃসহ অবস্থার জন্য যে মূলত আমাদের দায়িত্বহীন ও বুলিসর্বস্ব রাজনীতিই দায়ী তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই বলিলেই চলে। অপ্রিয় হইলেও সত্য যে, জনগণের ভোটে যখন যাহারা ক্ষমতায় আসিয়াছেন তাহারা কেবল একের পর এক প্রতিশ্রুতিই প্রদান করিয়াছেন, কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের কর্মপরিবেশ ও জীবনমান উন্নয়নে কাজের কাজ কিছুই করেন নাই। শুধু তাহাই নহে, রাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ অর্থ যাহাদের পিছনে ব্যয় হইয়া থাকে, রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে সেই প্রশাসনকেও অকার্যকর করিয়া ফেলা হইয়াছে। ফলে প্রশাসনও তাহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিস্মৃত হইয়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সেবাদাসে পরিণত হইয়াছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের নানা অনিয়ম, অন্যায় আবদার বা বাড়াবাড়ির নিকট নতি স্বীকার না করিয়া প্রশাসন তাহাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করিলে যে সাভার ট্র্যাজেডি সংঘটিত হইতে পারিত না তাহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সাভারের নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনার ক্ষেত্রেই শুধু নহে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসনের অনুরূপ লেজুড়বৃত্তির দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। আর এই অবস্থা যে একদিনে সৃষ্টি হয় নাই তাহাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুধু পোশাকশিল্প খাতেই এখন কর্মরত আছে আমাদের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। রফতানিমুখী এই শিল্পে তাহাদের বিপুল অবদান দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। কিন্তু বংশানুক্রমিক দুঃসহ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র হইতে মুক্তির প্রত্যাশায় দেশের নানা প্রান্ত হইতে আসা হতদরিদ্র এই মানুষগুলির জীবনমানের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই গত তিন দশকে। কারণ তাজরীন কিংবা রানা প্লাজার মতো বড়ো ধরনের বিপর্যয় না ঘটিলে তাহাাদের কথা কাহারো মনেই থাকে না। দুর্ঘটনার পর কয়েকদিন দৌড়ঝাঁপ চলিলেও অতিদ্রুতই সব চাপা পড়িয়া যায়। মূল সমস্যার সমাধান তো হয়ই না, বরং অধিকতর ভারি হইতে থাকে উপেক্ষা ও বঞ্চনার পাল্লা। এই বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশের একার নহে। উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশেই জনগণের দোহাই দিয়া গলাবাজির রাজনীতিই বেশি হয়। সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ না করিয়া আশ্রয় নেওয়া হয় কূট-রাজনীতির। কারখানা-মালিক, প্রশাসন, এমনকী গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই এই সুযোগ কাজে লাগাইয়া নিজেদের আখের গোছাইতে ব্যস্ত থাকেন। আর তাহার করুণতম কুফল ভোগ করিতে হয় দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষকে।
জাতীয় স্বার্থেই অবিলম্বে এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধানই সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব। এই ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অজুহাত, অবহেলা বা গাফিলতির সুযোগ নাই।