সাভার ট্র্যাজেডির এই বিষণ্ন সময়ে আমরা দেখিয়াছি, সাধারণ দীনদরিদ্র হইতে আরম্ভ করিয়া সংবেদনশীল বিত্তবান মানুষ ও প্রতিষ্ঠান তাহাদের নিজ নিজ পরিসরে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে আন্তরিক হইয়াছেন। ভয়াবহ ভবন ধসে আহত মানুষদের জন্য রক্তদান করিয়াছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী। তাহার সহিত এইরূপ দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ না করিয়া পারে না, যখন দেখা গেল স্বেচ্ছায় রক্তদান করিতেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা স্বয়ং। রাজধানীর আইসিডিডিআরবিতে গত রবিবার স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন রাষ্ট্রদূত মজীনা ও মার্কিন দূতাবাসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। সাভারে কয়েক শ' শ্রমিকের করুণ মৃত্যুতে তিনি, তাহার সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ব্যথিতচিত্তের কথা তাহার এই সপারিষদ রক্তদানের মাধ্যমে বুঝিয়া লইতে আমাদের অসুবিধা হয় না।
রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার এমন বাংলাদেশ-বান্ধব মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ আমরা ইতিপূর্বে আরো বহুবার দেখিয়াছি। আন্তর্জালে তাহার একটি ছবি অতি জনপ্রিয়— যেইখানে দেখা গিয়াছে, তিনি আমাদের শ্রমজীবী মানুষের জনপ্রিয় পোশাক লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিধান করিয়া রিকশায় চালকের আসনে বসিয়া রহিয়াছেন, যাত্রী হিসাবে রহিয়াছেন তাহার পরিবারের সদস্যরা।
কিছুদিন পূর্বে তাহার মাধ্যমে আমরা জ্ঞাত হইয়াছিলাম এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কী বিশেষ পরিবর্তন ঘটিয়াছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। দেশ হিসাবে আমরা উন্নয়নশীল। কিন্তু পশ্চিমা দৃষ্টিতে কোন কাতারে? রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলিয়াছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার চোখে সফল উন্নয়নশীল দেশের তালিকার শীর্ষে রহিয়াছি আমরা। ইহা আমাদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি এবং অদূর ভবিষ্যতে উন্নয়নশীল হইতে উন্নত বিশ্বে প্রবেশের জন্য একটি স্পষ্ট ধারণা দেয় বটে। তাহাছাড়া বাংলাদেশকে তিনি একাধিকবার এশিয়ার টাইগার বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। বাংলাদেশের মানুষের উদ্যম ও কর্মস্পৃহার তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করিয়াছেন বহুবার।
দেশের নৈরাজ্যকর এই অস্থির সময়ে ড্যান মজীনা বিভিন্ন সময়ে বলিয়াছেন, 'সহিংসতা মত প্রকাশের একমাত্র উত্তর নয়।' বিগত কিছুদিন যাবত্ অরাজক পরিস্থিতির সুযোগ লইয়া কিছু সুযোগসন্ধানী দেশের সংখ্যালঘুদের জানমালের উপর বর্বরোচিত হামলা ও নৃশংসতা চালাইয়াছে। ড্যান ডব্লিউ মজীনা ইহাতে মর্মাহত হইয়াছেন, ক্ষুব্ধ হইয়াছেন। তাহা প্রকাশও করিয়াছেন সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সদাহাস্য ড্যান মজীনাকে বন্ধুত্বের কোমল হাত বাড়াইতে দেখা গিয়াছে দেশের প্রান্তিক জনপদেও। তাহাকে আমরা ছুটিয়া যাইতে দেখিয়াছি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বৈসাবী উত্সবসহ নানা স্থানে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সেই উত্সবে তাহাকে আমরা যেইভাবে একাত্ম হইতে দেখিয়াছি, সকলের সহিত নিজেকে রাঙাইতে দেখিয়াছি, তাহা আমাদের হূদয়কে জানাইয়া দেয় তাহার অন্তরনিঃসৃত ভালোবাসার বার্তা। ইহা আমাদের কীভাবে বিমুগ্ধ না করিয়া থাকিবে? বন্ধুত্ব ও প্রকৃত ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায় দুর্যোগে- দুঃসময়েই। সেই বিপদ যত বড় হয় ততই অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বাংলাদেশের এই অস্থির ও বেদনাদীর্ণ সময়ে রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার আন্তরিক ও মানবিক ভূমিকা এই দেশ স্মরণ রাখিবে বহুকাল, ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই।