ই-কমার্সের ক্ষেত্রেও এখন আর পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। এখনও পর্যন্ত শহরাঞ্চলের মধ্যে ই-কমার্স অনেকখানি সীমাবদ্ধ থাকলেও গ্রামাঞ্চলেও লেগেছে ই-কমার্সের ছোঁয়া। নিকট ভবিষ্যতেই ই-কমার্স দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়বে, সেই সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ২০০৮-০৯ সালে আমরা বাংলাদেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু করি। সেই সময় দেশে পেমেন্ট গেটওয়ে ছিল না। ই-কমার্স সম্পর্কে মানুষের ধারণাও স্পষ্ট ছিল না। ওই সময়ে কিন্তু উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ই-কমার্সে জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছিল। সেই সময়ে আমরা কেবল ই-কমার্সের ধারণাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করেছি। সেই হিসাবে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের দেশে যেভাবে ই-কমার্স সাইটগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেটি বড় একটি অর্জন। আমরা ২০০৮-০৯ সাল থেকে কাজ শুরু করলেও ই-কমার্সের সেবা প্রদান করতে সক্ষম হই ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। বলতে গেলে ২০১১ সালের শুরু থেকেই ই-কমার্সের প্রকৃত যাত্রা শুরু হয় আমাদের। এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পেমেন্ট গেটওয়ে উন্মুক্ত করে দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ ছাড়া ই-কমার্সের যাত্রা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কমার্সের সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারলেও সেই সময়ে বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো ততটা দক্ষতা দেখাতে সমর্থ হয়নি। মূলত তারা ই-কমার্সের সেবা প্রদানের জন্য আর্থিক লেনদেনের সুবিধা দিতে প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেনি, যা ই-কমার্সের অগ্রগতিকে খানিকটা বাধাগ্রস্তও করে। ই-কমার্স দুইভাবে আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। প্রথমত, দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করতে ই-কমার্স রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের দেশে উত্পাদন পর্যায়ে যারা কাজ করে থাকেন, বাজারজাতকরণে তাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই বললেই চলে। যে কারণে একজন কৃষক তার উত্পাদিত ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয় মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে। অথচ কৃষক যদি সরাসরি তার পণ্যটি ক্রেতা বা ভোক্তার হাতে পৌঁছে দিতে পারত, তাহলে কৃষক যেমন তার উত্পাদিত পণ্যের সঠিক মূল্যটি লাভ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করত, অন্যদিতে ক্রেতা বা ভোক্তাও সরাসরি তুলনামূলকভাবে অনেক কম দামেই পণ্যটি পেতে পারত। কৃষক বা উত্পাদক এবং ভোক্তা বা ক্রেতার মধ্যেকার এই যোগসূত্র হয়ে কাজ করতে পারে ই-কমার্স। আমাদের দেশিয় বাজারের কথাই যদি বলি, ই-কমার্সের সেবা ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য আরও অনেক খাত এখনও বাকি রয়েছে। সেবাখাতকে এখনও ই-কমার্সের সাথে তেমনভাবে যুক্ত করা যায়নি। বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধের কাজটি ই-কমার্সের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে। গাড়ি থেকে শুরু করে সব ধরনের টিকেটও অনলাইনেই ই-কমার্সের মাধ্যমে বিক্রি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশিয় পণ্যকে বিদেশে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ই-কমার্স। ইতোমধ্যেই দেশীয় অনেক পণ্যই ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে বিদেশি ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশীয় পণ্যকে তাই আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরতে ই-কমার্স হয়ে উঠতে পারে কার্যকরী একটি মাধ্যম।
ই-কমার্সের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গেলে আমাদের কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ই-কমার্সকে আমাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে এই খাতে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য ট্যাক্স বা ভ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ভ্যাট বা ট্যাক্সের আওতার বাইরে রাখতে হবে। ই-কমার্সের প্রসারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রেও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ ১০ বছর করের আওতামুক্ত ছিল। আমরাও একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করে ই-কমার্সের প্রসারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারি।
এর বাইরে ই-কমার্স সম্পর্কে মানুষের যাতে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে সেদিকটায় নজর দিতে হবে। সরকারি বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণায় উঠে আসতে পারে ই-কমার্সের কথা। একদিকে সাধারণ মানুষের কাছে ই-কমার্সের লেনদেন যে সম্পূর্ণ নিরাপদ, সেই বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে; অন্যদিকে ই-কমার্সের উদ্যোক্তা যাতে গড়ে ওঠে, তেমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করতে হবে। জাতীয় বাজেটে আইটি খাতে পৃথক একটি বরাদ্দের দাবি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। এই বরাদ্দের মধ্যে বা এর বাইরেও ই-কমার্সের জন্য আলাদা থোক বরাদ্দ থাকতে হবে যাতে ই-কমার্সের নবীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা যায়।
ই-কমার্সের মাধ্যমে কিন্তু সঠিকভাবে পণ্য সরবরাহ না করে ক্রেতাকে প্রতারিত করা এবং পণ্য বিক্রির নামে বিদেশ থেকে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ গ্রহণ করাও সম্ভব। এগুলো যাতে না ঘটে সে জন্য কোনো ই-কমার্সের সাইটে কী ধরনের পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেসব পণ্যের সঠিক অনুমোদন রয়েছে কি না, পণ্যগুলোর জন্য লেনদেন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হচ্ছে কি না, পণ্য অর্ডারের পর সঠিকভাবে সরবরাহ হচ্ছে কি না এসব বিষয় মনিটরিংয়ের জন্য একটি যথাযথ কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন। আর ই-কমার্স সাইট গড়ে তোলার জন্যও উপযুক্ত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। আসলে ই-কমার্স সাইটগুলোর কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা গেলে ভোক্তাদের কাছে একে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে না। আরও একটি বিষয়ে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। আর তা হলো উপযুক্ত একটি পেমেন্ট সিস্টেম। আমাদের দেশে এখনও পেপ্যাল প্রবেশ করতে পারেনি, সেটা দুঃখের বিষয় নিশ্চয়। পেপ্যাল সবার কাছেই কাঙ্ক্ষিত। তবে এক্ষেত্রে আরেকটু ভিন্নভাবে চিন্তার অবকাশ রয়েছে। পেপ্যালের মাধ্যমে লেনদেন যতই সহজ হোক না কেন, প্রতিটি লেনদেন থেকেই অর্থ লাভ করবে পেপ্যাল। সেক্ষেত্রে পেপ্যালের বদলে আমরা নিজেরাই যদি একটি শক্তিশালী ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ প্রতিষ্ঠা করতে পারি, সেটা কিন্তু আমাদের জন্য অনেক লাভজনক। আমরা মনে করি গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে মোবাইলে যেভাবে দ্রুত এগিয়ে গেছে, তেমন অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব ই-কমার্সের ক্ষেত্রে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত একটি পরিকল্পনা এবং যুগোপযোগী একটি নীতিমালাই ই-কমার্সকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের পথে।
লেখক :ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফিউচার সলিউশন ফর বিজনেস
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেছেন, 'র্যাবের কেউ জড়িত থাকলে তাকে রক্ষার চেষ্টা করব না, বিভাগীয় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে।' তিনি কি এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন?