রানা প্লাজা ধসিয়া পড়ার পর প্রায় একমাস অতিক্রান্ত হইতে চলিয়াছে। কিন্তু আহতদের আহাজারি এখনও থামে নাই। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বাঁচিয়া গেলেও রানা প্লাজা তাহাদের প্রায় পঙ্গু করিয়া দিয়াছে। ফলে এক অন্তহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে কর্মচঞ্চল এই মানুষগুলির ভবিষ্যত্। ইতিমধ্যে রুদ্ধশ্বাস উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘটিয়াছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও পরিবারসমূহের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার এবং পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ-এর পক্ষ হইতে গৃহীত হইয়াছে নানা উদ্যোগ। এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে কর্মহীন হইয়া পড়া শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আহতদের সুচিকিত্সার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে। আমরা আশা করি, সেই প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে পালিত হইবে। সরকারের পক্ষ হইতে হতাহতদের পরিবারকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হইয়াছে। চিকিত্সা সহায়তাও অব্যাহত আছে। আহতদের অনেকে সুস্থ হইয়া ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছেন। কিন্তু জীবন্মৃত অবস্থায় যাহারা বাঁচিয়া আছেন তাহাদের অবস্থা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। বর্তমানে শুধু রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালেই চিকিত্সাধীন আছেন ৭০ জন গার্মেন্টস কর্মী। তন্মধ্যে ১০ জনের মেরুদণ্ড ভাঙিয়া গিয়াছে। হাত-পা কাটিয়া ফেলিতে হইয়াছে আরও ৮ জনের। সাভারের এনাম হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালেও চিকিত্সাধীন আছেন অনেকেই। চিকিত্সা কিংবা আনুষঙ্গিক সেবা লইয়া তাহাদের কোনো অভিযোগ নাই। যখন যাহা দরকার সবই পাইতেছেন। কিন্তু কিছুতেই তাহাদের আহাজারি থামিতেছে না। কারণ সহায়-সম্বলহীন এই মানুষগুলির জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হইল শরীর বা কায়িক পরিশ্রম। সেই শরীরই যদি অচল হইয়া যায় তাহা হইলে তাহারা বাঁচিবেন কিভাবে?
একদিকে ভবন ধসিয়া পড়ার দুঃসহ স্মৃতি তাহাদের তাড়া করিতেছে সর্বক্ষণিকভাবে, অন্যদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিয়াছে হতদরিদ্র এই মানুষগুলিকে। কারণ প্রায় সকলেরই পরিবার আছে। আছে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোনসহ নির্ভরশীল একাধিক সদস্য। কাজ করিতে না পারিলে যে পরিবার-পরিজন লইয়া না খাইয়া থাকিতে হইবে— ইহা তাহারা ভালো করিয়াই জানেন। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হইবার সম্ভাবনাই যেইখানে অত্যন্ত ক্ষীণ, সেইখানে কাজ করিবেনই বা কিভাবে? অঙ্গহীন, বিকলাঙ্গ কিংবা অচল মানুষকে কে কাজ দেবেন? এইসব উদ্বেগ-আতঙ্কে দিশেহারা হইয়া পড়িয়াছেন অনেকেই। অবর্ণনীয় এই মানসিক চাপ যে তাহাদের জীবনকে আরও সংকটাপন্ন করিয়া তুলিতে পারে তাহাও বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায়, তাহাদের সাহস ও ভরসা জোগানো অত্যন্ত জরুরি হইয়া পড়িয়াছে। ইতোমধ্যে ব্যক্তি-উদ্যোগে অনেকেই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করিয়াছেন। কেহ নগদ অর্থ দিয়া সহায়তা করিতেছেন, কেহবা তাহাদের হাত-পা সংযোজনের মতো ব্যয়বহুল চিকিত্সার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। ইহা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক ও প্রশংসনীয়, তবে সমস্যার গভীরতা ও প্রয়োজনীয়তার বিচারে মোটেও যথেষ্ট নহে।
বস্তুত বিপন্ন এই মানুষগুলিকে কার্যকরভাবে সাহস ও ভরসা জোগাইতে হইলে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নাই। প্রথম কর্তব্যটি হইল, উপযুক্ত ও অব্যাহত চিকিত্সার মাধ্যমে তাহাদেরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম করিয়া তোলা। ইহার জন্য প্রয়োজনে হাত-পা সংযোজনের উদ্যোগও গ্রহণ করিতে হইবে। চিকিত্সার পরও যদি কিছু কিছু শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থাকিয়া যায়, সেই ক্ষেত্রে তাহাদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হইল দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। পাশাপাশি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় তাহাদের উপর নির্ভরশীল অসহায় পরিবারগুলিকে সাময়িক বা দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতা প্রদান করা যাইতে পারে। আমরা জানি যে সরকারের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে সরকার ও বিজেএমইএ আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হইলে গুরুতর আহত শতাধিক ব্যক্তির চিকিত্সা ও পুনর্বাসন এমন কোনো কঠিন কাজ নহে। প্রয়োজনে তাহারা আগ্রহী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সেবামূলক সংস্থাসমূহের সাহায্য-সহযোগিতাও গ্রহণ করিতে পারেন।