অনভ্যাসে বিদ্যানাশ। ১/১১-এর বিরূপ ধাক্কায় ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর সাংবাদিকতা হতে ছিটকে পড়ি। কাগজ-কলম গুটিয়ে চলে আসি প্রেসক্লাবে। রাত ১টা পর্যন্ত, বিমর্ষ চিত্তে একা একা প্রেসক্লাবে বসে ভাবি, এ কী হলো। এরপর দেখতে না দেখতে কেটে গেছে বছরের পর বছর। মেয়েরা তো বটেই, বন্ধুবান্ধব সুহূদ অনেকেই লেখালেখির পাঠ চুকিয়ে ফেলার কারণ জানতে চেয়েছেন। মেয়েরা অহরোহ এক কথাই বলেছে, মাঝে মাঝে দু'একটা লেখার চেষ্টা করেন না কেন। নাহলে একদিন হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির অতলে! হয়তো তাদের কথাই ঠিক। কিন্তু প্রেরণার কোনো তরঙ্গ যদি না থাকে লিখব কেমন করে। এর ওপর গত চারদিন যাবত বিছানায় শোয়া। কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছি। হাঁটাচলা অনেক পরের কথা। বিছানায় উঠে বসার শক্তিও নেই। এরপরও আজ লেখার চেষ্টা করছি শুধুমাত্র অন্তর আত্মার ডাকে।
আজ আমার পরম শ্রদ্ধেয় সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার প্রয়াণ দিবস। ১৯৬৯ সালের এই দিনে তিনি ছায়াভরা মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে দূর নীলিমায় চলে যান সে এমন এক লোক সেখান থেকে কেউ কখনও ফিরে আসেনি। মৃত্যুর পরেই তার মৃত্যুরহস্য নিয়ে সংশয় দানা বেঁধে ওঠে। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুসহ অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে, এ মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু কি না! বঙ্গবন্ধু প্রেরকের নাম ঠিকানাবিহীন একটি চিঠির উল্লেখ করে বলেছেন, 'আজও আমার একটি চিঠির কথা মনে পড়ে। এ চিঠিতে বলা হয়েছিল —আপনার পিন্ডি বা করাচি আসবেন না। এলে আপনাদের মেরে ফেলা হবে। এরপরও তিনি রাওলপিন্ডি যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। আমাকে বলা হয়, 'মারলে আপনাকে মারবে, আমাকে মারবে কেন? যাই দেখি ওরা কী বলে।' আমার উপদেশ অগ্রাহ্য করে তিনি পিন্ডি যান। ফিরে আসেন নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে। কে বলবে শহীদ সাহবেকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেই একইভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে কি না?'
১৯৬৪ সালে মানিক মিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হয়। আগেও ছিল, তবে না থাকার মতোই। এর দু'তিনদিন আগেই ভারতে শুরু হয় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেই দাঙ্গার প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলাদেশেও। দাঙ্গা শুরু হওয়ার একদিন পর মানিক মিয়া সম্পাদিত সে সময়কার সর্বাধিক প্রচারিত ও জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকে ৮ কলামব্যাপী একটি ব্যানার নিউজ ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল 'পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও'। এ নিউজ ছাপা হওয়র পরপরই অত্যন্ত কড়া ভাষায় বাঙালি জাতিকে প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়ে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়। সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন মানিক মিয়ার অত্যন্ত স্নেহভাজন তত্কালীন প্রধান সহকারী সম্পাদক আহমেদুর রহমান। তখন তিনি দেশে-বিদেশে 'মিঠেকড়া ভীমরুল' হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। সম্পাদকীয় ছাপা হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী সংগঠিত হয় দাঙ্গাবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন। ঠাটারিবাজারের হাক্কা গুণ্ডা ছিল তখন আইয়ুবীয় স্বৈরশাসনের তল্পীবাহক মোনায়েম খাঁর পুরোনো ঢাকার দক্ষিণ হস্ত। সে তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে ইত্তেফাক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সংবাদ পেয়ে মানিক মিয়া লুঙ্গি কাছা দিয়ে ইত্তেফাক অফিস থেকে ছুটে আসেন এর সামনের তেরোরাস্তার মোড়ে। পাশে এসে দাঁড়ায় ইত্তেফাকের সকল সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিনি হাক্কা গুণ্ডাকে তার দলবল নিয়ে ইত্তেফাক আক্রমণ করার আহ্বান জানান। কিন্তু হাক্কার সে সাহস হয়নি। এর পরদিনই ছিল বঙ্গবন্ধু আহূত সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িক শান্তি মিছিল। মানিক মিয়ার নেতৃত্বে ইত্তেফাকের সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমি তখন দৈনিক পাকিস্তানের স্টাফ রিপোর্টার। খবর পেয়ে আমিও মিছিলে অংশগ্রহণ করার জন্য ছুটে যাই। এ ঘটনাটি কি মানিক মিয়া ও তার সম্পাদিত ইত্তেফাকের অসম্প্রদায়িক রাজনীতির ভূমিকার পরিচয় বহন করে না!
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল প্রভৃতির প্রতি মানিক মিয়ার ছিল অসীম অনুরাগ (বঙ্গবন্ধুর উক্তি)। এ দেশের দুঃখী মানুষকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। এটিও বঙ্গবন্ধুরই কথা। এ ভালোবাসার মূল্যায়ন এবং দেশপ্রেম ও মানুষের অধিকার ইত্যাদির প্রতি নিষ্ঠা মূল্যায়ন করেই হয়তো বঙ্গবন্ধুর রাজধানীর সবচেয়ে প্রশস্ত রাস্তার নামকরণ করেছিলেন 'মানিক মিয়া এভিনিউ'। কে বলবে এর মাধ্যমে বাঙালির প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসার বিশাল হূদয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল কি না।
গণতন্ত্রের প্রতি মানিক মিয়ার অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের ব্যাপারে কেউ কোনোদিন ন্যূনতম সন্দেহ প্রকাশ করেননি। তিনি ছিলেন গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মিশ্র অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা। সাংবাদিকদের বেতন বোর্ড আদায়ের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন, ঠিক তেমনি মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্যও। তিনি বিশ্বাস করতেন মুক্তবুদ্ধির চর্চাই প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে দেশীয় সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারে আমাদের সক্ষম করতে, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সে সময়কার ইত্তেফাকের ভূমিকা স্মরণ করতে গিয়ে কেউ কেউ দলীয় মুখপত্র বিশেষণটি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। আমার কাছে মোটেই তা সঙ্গত মনে হয় না। আমি বিশ্বাস করি 'ইত্তেফাক' সবসময় ছিল জনগণের মুখপত্র। গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরাই ছিল এর মূল নীতি। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সালের প্রারম্ভ পর্যন্ত, যাই হোক, ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়ে বাঙালির নবচেতনার উন্মেষ ঘটে। প্রবল হয়ে ওঠে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এসবই তুলে ধরা হতো ইত্তেফাকে। গণতন্ত্রের পূজারি হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন নীতির তিনি সমর্থক ছিলেন না। ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আগ্রাসী নীতির সমালোচনা করে তার কঠোর-কঠিন লেখা এর প্রমাণ বহন করে। পুঁজিবাদের প্রতি বিরোধ না থাকলেও এর একনিষ্ঠ সমর্থক হতে পারেননি তিনি। মিশ্র অর্থনীতির প্রবক্তা হিসেবে তিনি মনে করতেন একচেটিয়া ব্যবসা জনগণের অধিকার রক্ষায় সহায়ক হয় না। অর্থলোভ মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে এক নির্মম ধনবাদী লুটেরা শ্রেণীর। যারা কর্মজীবী মানুষকে মুষ্টিভিক্ষা দিয়ে নিজেদের শোষণ ও রাজকীয় জীবনযাপন রক্ষা করতে চায়।
সতীর্থদের প্রতি তার ভালোবাসা ও দায়িত্বজ্ঞানের জ্বলন্ত প্রমাণ আমি নিজে। ১৯৬৫ সালের ২০ মে ইত্তেফাকের 'মিঠেকড়া ভীমরুল'খ্যাত আমার অগ্রজ আহমেদুর রহমান কায়রোর অদূরে পিআই-এর বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। বোধগম্য কারণেই আমাদের পরিবারে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার পরদিন মরহুম মানিক মিয়া সস্ত্রীক সান্ত্বনা দিতে আমাদের রামকৃষ্ণ মিশন রোডে অবস্থিত বাসায় আসেন। আমরা ভাড়া থাকতাম প্রখ্যাত কম্যুনিস্ট নেতা মরহুম সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকদের বাসায়। একজন মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব সেরকম সান্ত্বনা তিনি আমাদের দেন। যাওয়ার সময় আমার এক নিকট আত্মীয়কে বলেন যান যে, আহমেদুর রহমান যে বেতন-ভাতা পেত তার ছেলেমেয়েরা প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তা দেওয়া হবে। আমি তখন অধুনালুপ্ত দৈনিক পাকিস্তানের স্টাফ রির্পোটার দুই-তিন মাস পর কোনো নিয়োগপত্র না দিয়েই তিনি আমাকে ইত্তেফাকে জয়েন করার পরামর্শ দেন। আমি তা পালন করি। মানবপ্রেম, সতীর্থর প্রতি দায়িত্ব বা সহকর্মীর প্রতি অন্তর্গত ভালোবাসার এ কোনো ধরনের বহিঃপ্রকাশ কিনা জানি না!
দেশে আজ এক সঙ্কটজনক অবস্থা। 'ও নদীরে কোথায় তোমার দেশ, কোথায় তোমার চলার শেষ'—গানের কলির মর্মবাণীর মতো। দেশের গতি কোনদিকে, কোথায় এর শেষ, চূড়ান্ত পর্বে শান্তি না সঙ্কট কেউই তা সুস্পষ্ট বলতে পারছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে শুভ ও চরম অশুভর। গত কিছু কাল যাবত এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নানা রকম পরামর্শ দিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। এরমধ্যে গাফ্ফার ভাই (প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বন্ধু আবদুল মান্নান ও বন্ধুবর সৈয়দ আবুল মকসুদ দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বেশি। এর সবগুলোর রাজনৈতিক বাস্তবায়ন, সবগুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে কিছু থাকতে পারে যার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাদের সামাজিক একটা প্রভাব থাকলেও রাজনৈতিক কোনো প্রভাব বা সুপারিশের প্রতি আকৃষ্ট করার মতো শক্তিশালী কোনো হাতিয়ার তাদের হাতে নেই। তাই ঘুরে ফিরে এয়ার মার্শাল (অব) এম আসগর খানের একটি উক্তি বারবার মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, 'পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য দাবিদাওয়ার ব্যাপারে মানিক মিয়া ছিলেন উচ্চকণ্ঠ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা। তার মৃত্যুতে সংলাপের সূত্র নষ্ট হলো এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায়। দেশের রাজনীতিতে যখন সমন্বয় বিধান সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সে প্রয়োজন পূরণে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। সেই মানিক মিয়া আজ আমাদের মধ্যে নেই।' কিন্তু তার আদর্শ, মানবপ্রেম ও গণতন্ত্র নিষ্ঠা চির সমুজ্জ্বল। মানিক মিয়ার সে চেতনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করা হলে দেশের মঙ্গল হবে বলে আমার মনে হয়।