মো. ম নি রু ল ই স লা ম
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দুইজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর শিষ্য ছিলেন, সোহরাওয়ার্দীর মসি এবং সোহরাওয়ার্দীর অসি। সোহরাওয়ার্দীর অসি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ; আর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর মসি, যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে রাজনীতিক আন্দোলনের ক্যানভাসের সবচেয়ে বড় শিল্পী, সবচেয়ে বড় কলমযোদ্ধা। তিনি তাঁর পেশাদারী জীবন ও কর্ম দিয়ে রাজনীতি ও সাংবাদিকতার একটি সেতুবন্ধন নির্মাণ করেন। অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, তিনি ছিলেন মূলত রাজনীতিক, কিন্তু কার্যত সাংবাদিক। এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একজন মানিক মিয়া অতিদ্রুতই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন এবং আমাদের জাতীয় সংগ্রামের সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর প্রেরণাস্থল হয়ে ওঠেন। স্বীয় আদর্শের জন্য আপসহীন এই যোদ্ধা স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শে স্বাধীনতার মুখ দেখে বাংলাদেশ।
১৯১১ সাল, যে সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়, সেই সালে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় মানিক মিয়া জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৫ সালে বরিশালের বিএম কলেজ থেকে বিএ পাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় যে 'দৈনিক ইত্তেহাদ' পত্রিকা প্রকাশিত হয় তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মানিক মিয়া। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার বছরেই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সম্পাদনায় 'সাপ্তাহিক ইত্তেফাক' পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়, যা ছিল মূলত ওই দলের মুখপত্র। ১৯৫১ সালে মানিক মিয়া সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হন। '৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পর এবং '৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর মানিক মিয়ার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই 'দৈনিক ইত্তেফাক'ই মুসলিম লীগ-বিরোধী ও পূর্ব বাংলার বঞ্চিত জনগণের মুখপত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পেছনে দৈনিক ইত্তেফাক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। আইয়ুবের শাসনামলে তাঁর উপর নির্যাতনের খড়গহস্ত নেমে এসেছিল কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শের সাথে কখনোই আপস করেননি। তাঁর সাংবাদিকতার আদর্শ ছিল—বাংলাদেশের স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতিষ্ঠিত করা। ১৯৬৯ সালের ১ জুন এই অকুতোভয় কলমযোদ্ধা রাওয়ালপিণ্ডিতে পরলোকগমন করেন। 'মোসাফির' ছদ্মনামে মানিক মিয়া ইত্তেফাকে 'রাজনৈতিক মঞ্চ' শিরোনামে কলাম লিখতেন। মূলত মোসাফিরের রাজনৈতিক মঞ্চের কারণে এদেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ইত্তেফাক। শুধু বিরোধিতা নয়, বরং অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য সন্নিবেশিত এই 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে, গ্রেফতার হন মানিক মিয়া, নিষিদ্ধ হয় তাঁর প্রাণপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক।
মানিক মিয়ার রাজনীতি কিংবা সাংবাদিকতার মূল দর্শন ছিল—'সাংবাদিকতার জন্য রাজনীতি নয়, বরং রাজনীতির জন্য সাংবাদিকতা'। পাকিস্তান টাইমসের সাংবাদিক জেডএ সুরেলীকে তিনি একবার বলেছিলেন, 'আমি সাংবাদিকতার জন্য রাজনীতি করি না, রাজনীতির জন্যই সাংবাদিকতা করি।' ১৯৮১ সালে প্রকাশিত 'পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর' বইটিতে মানিক মিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শনের পরিচয় পরস্ফুিটিত হয়েছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর সাহচর্যে মানিক মিয়া যে গণতন্ত্রের পাঠ নেন, সেই গণতন্ত্রের আদর্শ বা দর্শন প্রচার করার হাতিয়ার হিসেবে ইত্তেফাককে সামনে আনেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানিক মিয়ার আন্দোলনের হাতেখড়ি, আর তাঁর আন্দোলনের পূর্ণতা পায় পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সমর্থনে তিনি বলেন, 'যাহারা স্বাধীনতা আন্দোলনে (পাকিস্তান আন্দোলনে) জনগণের ভূমিকাকে তুচ্ছ স্থান দিয়া ব্যক্তিবিশেষের নেতৃত্বকে ফুলাইয়া ফাঁপাইয়া তুলিতে প্রয়াসী হয় তাহারা হয় রাজনৈতিক এতিম, নয় গণবিরোধী।' জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই হবেন প্রকৃত শাসক যেখানে সামরিক বা আমলাতান্ত্রিক খবরদারি অনাকাঙ্ক্ষিত। মানিক মিয়া তদানীন্তন পাকিস্তান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ অবস্থা উপলব্ধি করে লেখেন, 'আমলারা যত দক্ষই হোন না কেন, গণ-সমস্যা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সীমিত এবং অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।' ১৯৪৯ ঢাকায় মুসলিম লীগের বিরোধী শক্তি হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। একই সালে পাকিস্তানি শাসকদের মুখপত্রের বিরোধী মুখপত্র হিসেবে ইত্তেফাকের জন্ম। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের রূপকার বাংলার ছাত্র-জনতা, আর ভাষা আন্দোলন হতে উত্সারিত জাতীয়তাবাদের মুখপত্র হিসেবে লড়াই করতে থাকে ইত্তেফাক। ৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার করে এবং যুক্তফ্রন্টের মৌলিক দাবিগুলোকে গণমুখী করে ইত্তেফাক। মূলত যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারকে নিয়ে পশ্চিমা শাসনের একটি বিরোধী শক্তির আবির্ভাবের জন্য ব্যাপক জনমত তৈরি করে ইত্তেফাক, যা পশ্চিমাদের পরাজয়কে অনিবার্য করে তোলে। ৫৮-এর আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে মানিক মিয়ার 'রাজনৈতিক মঞ্চ' একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আন্দোলন তৈরি করে। ৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন মানিক মিয়া এবং মানিক মিয়ার ইত্তেফাক বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ এই ছয় দফার সবচেয়ে বড় প্রচারপত্র ছিল। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে পশ্চিমা শাসকদের রাজনৈতিক পরাজয়ের সাথে সাথে নৈতিকতারও চরম বিপর্য ঘটে, এখানেও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আবর্তনের মধ্যে মানিক মিয়া ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১ জুন তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি শুধু আন্দোলন করেননি পাশাপাশি বাঙালি অধিকার বঞ্চিত জনগণের মধ্যে অধিকার আদায়ের স্বপ্ন নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বেঁচে ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বেঁচে থাকা আদর্শ স্বাধীনতাকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা প্রথমেই আঘাত করে মানিক মিয়ার আদর্শের এবং প্রাণের প্রতিষ্ঠান ইত্তেফাক অফিসে। কারণ ইত্তেফাকই বাংলার মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছে আন্দোলন করতে, অধিকার আদায় করতে, স্বাধীনতাকামী হতে। রাজনীতির মাঠে তারা গরম বক্তব্য দেননি কিংবা আন্দোলনের হাত উঁচু করা নেতাও তার ছিলেন না, কিন্তু তাদের আদর্শিক সত্তা ও লেখনী ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লবের জন্ম দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর মানিক মিয়াকে দলের হাল ধরতে অনুরোধ করা হলে তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, আমি 'এভাবেই' মানুষের সেবা করতে চাই। রাজনীতির সম্মুখ পটে না এসে বরং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম পরিচালনা করেছে, একটি পত্রিকাকে সাথে নিয়ে সেই সংগ্রামের এক যুগপত্ ধারা সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধুর 'মানিক ভাই'। রাজনীতির মাঠে এসে আন্দোলনের আঙুল উঁচু করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর অধিকার আদায়ের মাঠে কলম উঁচু করেছেন কলামযোদ্ধা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
লেখক : এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি