মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
আমি যখন প্রাইমারি স্কুলের বারান্দা পেরিয়ে হাইস্কুলে পড়ছি, তখন বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাবা বল তো তোমার নামে একজন বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন, তিনি কে? আর সে প্রশ্নটি করার পেছনে কারণ হলো—আমার বাবাও একজন সাংবাদিক। সেদিন আমি সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। দু'দিন পর বাবার মুখে প্রথম শুনেছি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা জনাব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কথা। সেদিনের পর থেকে অদ্যাবধি হূদয়ের মণিকোঠায় স্থান দখল করে আছেন মানিক মিয়া। উনার নামের সাথে আমার নামটির কিছু মিল থাকার কারণে প্রায়ই আমাকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। একটি মজার ঘটনা না বললেই নয়, আমি যখন মাস্টার্স পরীক্ষা দিচ্ছি তখন ভাইভা পরীক্ষার সময় আমাকে চারটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল এরকম—তোমার নামে একজন বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন উনার নাম কী? আমি বলেছিলাম, মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। চারটি প্রশ্নের উত্তরই আমাকে প্রথম ক্লাস অর্জন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। যাক সে কথা, আমি যখন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে নিয়ে লিখছি, তখন আমার ভয় করছে। এ রকম বড় মাপের একজন মহানায়ক সম্পর্কে লেখার ন্যূনতম যোগ্যতাটুকু আমার নেই, তবু মন কেন যে বলল লিখতে, সে প্রশ্নের উত্তরও আমার কাছে নেই। তারপরেও ভয়ে ভয়ে কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসেছি। আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটি যদি প্রকাশিত হয় আর তা পড়ে যদি কোনো পাঠক একটিবার হলেও মানিক মিয়ার জন্য দোয়া করেন তাহলে আমার লেখার কষ্ট একটু হলেও সার্থক হবে।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কত বড় সাংবাদিক ছিলেন, কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন, সেটা বোঝার জন্য বড় পণ্ডিত হওয়া দরকার নেই, একটু পড়তে পারলেই বোঝা সম্ভব। তিনি তার কাজে সে প্রমাণ রেখে গেছেন। ছোট থেকে বড় যেকোনো মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী তিনি ছিলেন। সাংবাদিকতা জগতের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সত্য কথা বলা, সত্য কথা লেখার সাহসী সৈনিক কিভাবে হতে হয় তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। উনার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলো ইত্তেফাক আন্জাম দিয়ে যাবে এটাই আমাদের কামনা। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের রাজনীতি ও সাংবাদিকতার জগতে ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নাম কে না শুনেছে? মৃত্যু যেমন সত্য তেমনি অবধারিত। কিন্তু তারপরেও কিছু মানুষের মৃত্যু বছরের পর বছর হাজারো মানুষকে কাঁদায়। মানুষ মরে গেলেও বেঁচে থাকে, রেখে যাওয়া কীর্তির মাঝে। এ কীর্তির স্বাক্ষর মহাপুরুষরা বিভিন্ন জনে বিভিন্নভাবে রেখে যান। কেউ সাহিত্যে, কেউ শিল্পে, কেউ বিজ্ঞানে, কেউ বা সাংবাদিকতায়। তেমনি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাংবাদিকতার মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন দেশ তথা বিশ্বময়। মানুষ খুঁজে বেড়ায় সেই গুণীজনদের কিন্তু তারা আর ফিরে আসে না। তবু পথ চেয়ে বসে থাকে অগণিত মানুষ তাদেরই কর্মময় জীবনের পাণ্ডুলিপিগুলো পড়ার প্রত্যাশায়। তিনি কর্মজীবনে রাজনীতি ও সাংবাদিকতার সাথে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতা।
দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। আজও যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে শত ধিক দিতেন গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী দলকে। তিনি সারা জীবন যুদ্ধ করে গেছেন জনগণের কল্যাণের জন্য, অসহায় বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষগুলোর গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বঞ্চিত জনগণের অধিকার অর্জনে তার সংগ্রামী ও ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।
মানিক মিয়ার কর্মময় জীবনের সূচনা যেকোনো সাধারণ মানুষের মতোই ছিল, কিন্তু তিনি পাকিস্তানের রাজনীতি ও সাংবাদিকতা তথা জনজীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের সাথে নিজেকে যুক্ত করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলার এক মহান ব্যক্তিত্ব রূপে। অনেক সুধীজনের সুচিন্তিত অভিমত হচ্ছে, স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা রূপে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আবির্ভাবের পিছনে মানিক মিয়ার ভূমিকা শুধু অনস্বীকার্যই নয়, অপরিহার্যও ছিল। তিনি আজ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা অন্য স্রোতে প্রবাহিত হতো।
মানুষের মধ্যে যদি আত্মসম্মানবোধ না থাকে তাহলে মানুষ কখনও সত্যের অবতারণা করতে পারে না। মানিক মিয়ার আত্মসম্মানবোধ ছিল খুবই প্রখর, যার পরিচয় মেলে পিরোজপুরের কোর্টের আঙ্গিনায়। তিনি বিএ পাস করার পর পিরোজপুর সিভিল কোর্টে চাকরি গ্রহণ করেন। কোর্টের মুন্সেফ একদিন তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করেন। তিনি এর প্রতিবাদে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী স্বার্থন্বেষী সরকার মানিক মিয়ার সত্য ভাষণ এবং যুক্তিসঙ্গত দাবিকে গ্রহণ করতে পারেনি। তাঁর সত্যভাষণ ও যুক্তিসঙ্গত দাবির অপব্যাখ্যা করে তারা তাঁকে বারবার কারাগারে নিক্ষেপ করেছে, পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করেছে, তাঁর প্রেস বাজেয়াপ্ত করেছে। এত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেও তিনি সত্য বলা-লেখা থেকে একটু পিছপা হননি। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মানিক মিয়ার মতো সাহসী সাংবাদিকের আজ বড় প্রয়োজন।