রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা গতকাল মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। আজ রাত পোহালেই শুরু হবে ভোটের লড়াই। দেশের প্রধান দুইটি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দলগতভাবে অংশ নেওয়ায় উত্তাপ-উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। নির্দলীয় এ নির্বাচনে সংসদ নির্বাচনের দলীয় আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হচ্ছে দুই দলের সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে। সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগে অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতির মোড়ও ঘুরিয়ে দিতে পারে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে এ নির্বাচনের ফলাফল একদিকে মর্যাদার লড়াই, অন্যদিকে কৌশলগত লাভ-ক্ষতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে দেশের মানুষের পূর্ণ দৃষ্টি এ নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনী এলাকার জনগণের একটাই প্রশ্ন-কে হচ্ছেন চার সিটির নগরপিতা? তারা এখন শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত। প্রার্থী নির্বাচনে একদিকে জাতীয় রাজনীতির ইস্যু, অন্যদিকে উন্নয়ন ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, দুর্নীতি এবং প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা বিবেচনা করছেন ভোটাররা। তবে এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ভোটারদের অপেক্ষা করতে হবে শনিবার পর্যন্ত।
বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া উত্সবমুখর পরিবেশে মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজ নিজ সমর্থনে প্রচারণা চালিয়েছেন। ১৯ দিনের এই প্রচার-কার্যক্রম গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই শেষ হয়েছে। এর আগে বুধবার মধ্যরাত থেকেই বহিরাগতদেরকে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করতে বলায় গতকাল কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকে প্রচারণায় দেখা যায়নি। তবে অভিযোগ রয়েছে, এখনো অসংখ্য বহিরাগত এলাকা ছাড়েননি। নির্বাচন উপলক্ষে চার সিটিতে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে চেক পোস্ট। বহিরাগতদের ঠেকাতে মূলত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। চার সিটির প্রতিটি শহরের রাস্তাঘাট, দোকানপাট, অফিস-আদালত সবখানে চলছে প্রার্থীদের নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো নগরী। চার সিটির শহরতলী ও আশপাশের গ্রামগুলোতেও দেখা গেছে একই চিত্র। কারণ এই চার সিটিতে গতবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেছিল। তাই বিএনপি চায় জয় ছিনিয়ে আনতে। অন্যদিকে নিজেদের চার সিটির মেয়র পদে জয় অক্ষণ্ন্ন রাখতে চায় ক্ষমতাসীনরা। চার সিটির চার কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যে সার্বিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়েছে।
নির্দলীয় নির্বাচনে দলীয় রূপ
স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী সিটি নির্বাচন একটি নির্দলীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী ঘোষণা, প্রচারণা চালানো এবং দলের নেতাদের ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কার্যত চার সিটিতেই দলীয়ভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৮ দল এবং ১৪ দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কৌশলগত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। 'দলীয় প্রার্থী' না বলে 'সমর্থিত প্রার্থী' বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কার্যত দলীয় প্রার্থী যা, সমর্থিত প্রার্থী তা-ই। শুধু প্রার্থী মনোনয়নই নয়, প্রচারণাও চালানো হয়েছে দলীয় ও জোটবদ্ধভাবে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছাড়া দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতাই প্রচার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এমন কোনো সহযোগী সংগঠন নেই যারা প্রচারণায় অংশ নেননি। একই অবস্থা ১৮ দলীয় জোটের ক্ষেত্রেও। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, তরিকুল ইসলাম থেকে শুরু করে দলের সকল পর্যায়ের নেতারাই প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দলীয় রূপ এ নির্বাচনে দেখা গেছে।
চার সিটির মেয়র প্রার্থীদের প্রতীক
এর মধ্যে সদ্যবিদায়ী মেয়র ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছেন তালা, মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল পেয়েছেন আনারস প্রতীক, স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমান পেয়েছেন চশমা প্রতীক। খুলনায় সদ্য বিদায়ী মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক-তালা, বিএনপির সদ্য পদত্যাগী সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি-আনারস ও জাতীয় পার্টি (এ) জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু পেয়েছেন দোয়াত কলম প্রতীক। বরিশালে ১৪ দল সমর্থিত সম্মিলিত নাগরিক কমিটি সমর্থিত ও সদ্য বিদায়ী মেয়র শওকত হোসেন হিরন পেয়েছেন টেলিভিশন, ১৮ দল সমর্থিত জাতীয়তাবাদী নাগরিক পরিষদের আহসান হাবীব কামাল-আনারস ও মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন পেয়েছেন দোয়াত কলম প্রতীক। সদ্যবিদায়ী মেয়র ও সিলেটে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন আনারস, বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী-টেলিভিশন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন রিমন পেয়েছেন তালা প্রতীক।
পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন
চার সিটিতেই পরিবর্তন আর প্রত্যাবর্তনের জোর শ্লোগান শোনা যাচ্ছে। বিরোধী দল সমর্থকরা পরিবর্তনের আওয়াজ তুলেছেন। তারা দুর্নীতি, দু:শাসন এবং কতগুলো রাজনৈতিক দাবি এবং হেফাজতে ইসলামের উপর আইন-শৃংখলা বাহিনীর নির্যাতনসহ বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে পরিবর্তনের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে উন্নয়নের ধারবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে প্রত্যাবর্তনের শ্লোগান দিচ্ছেন ১৪ দলীয় জোটের সমর্থকরা। তারা স্থানীয় নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সাথে তুলনা করতে নারাজ। তবে কোথাও কোথাও সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিটিও সামনে এসেছে।
৬৫২ কেন্দ্রের ৪২৩টি ঝুঁকিপূর্ণ
চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬৫২ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৪২৩টি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রায় দুই শতাধিক ভোট কেন্দ্রকে অধিক ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সংখ্যা সিলেট ও রাজশাহীতে বেশি। রিটানিং অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ সংখ্যা নির্ণয় করেছেন। সাধারণ ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে ১০৩টি, খুলনায় ২১৫টি, বরিশালে ৬০টি ও সিলেটে ৪৫টি। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র নির্ধারণ করার জন্য পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্ব্বী প্রার্থীর বাড়ির নিকটবর্তী কেন্দ্র, একটি কেন্দ্রে স্বাভাবিক ভোটারের অনুপাতে অধিক সংখ্যক ভোটার, প্রশাসনিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিগত নির্বাচনে দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা অতীত রেকর্ড এবং জামায়াত-শিবির প্রভাবাধীন এলাকাগুলো।
ভোটার সংখ্যা ও সিটির ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র
সর্বশেষ হালনাগাদ ভোটার তালিকানুযায়ী রাজশাহী সিটিতে ভোটার ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯২৭ জন। আর ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩০টি, ভোটকেন্দ্র ১৩৭টি, ভোটকক্ষ ৮৭১টি এবং অস্থায়ী ভোটকক্ষ আছে ১০৭টি। এ সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ১শ' ৩টি। খুলনা সিটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৪০ হাজার ৬৫৬ জন। আর ওয়ার্ডসংখ্যা ৩১টি। এখানে ভোটকেন্দ্র ২৮৮টি, স্থায়ী ভোটকক্ষ ১ হাজার ৪২৮টি এবং অস্থায়ী ভোটকক্ষ ৩৩টি। এ সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ২১৫টি। এর আগে ২৩৯ কেন্দ্রের মধ্যে এ সংখ্যা ছিল ১৯৫টি। বরিশাল সিটিতে ভোটার ২ লাখ ২২ হাজার ৯৩৯ জন। এ সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩০টি। এখানে কেন্দ্রের সংখ্যা ১০০টি, স্থায়ী ভোটকক্ষ ৬১৪টি এবং অস্থায়ী ভোটকক্ষের সংখ্যা ৩৭টি। এ সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ৬০টি। সিলেট সিটিতে ভোটার ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৭ জন। আর ওয়ার্ডের সংখ্যা ২৭টি। মোট কেন্দ্র ১২৭টি। স্থায়ী ভোটকক্ষের সংখ্যা ৮৯৬টি এবং অস্থায়ী কক্ষের সংখ্যা ১১টি। এ সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৪৫টি।
ইসির বাজেট ৬ কোটির ওপরে
চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনী ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি টাকারও বেশি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এর মধ্যে নির্বাচনী পরিচালনা ব্যয় ধরেছে মাত্র দুই কোটি টাকা। বাকি চার কোটি টাকাই রাখা হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা খাতে। চার বিভাগীয় কমিশনারের জন্য রাখা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। চাহিদাপত্র অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে রাজশাহীতে ৩৮ লাখ ৪ হাজার ৯৫০ টাকা। খুলনায় ৫৯ লাখ ২৯ হাজার টাকা। বরিশালে ৩২ লাখ এক হাজার টাকা এবং সিলেটে ৩৭ লাখ ৭৪ হাজার ৩৫০ টাকা। চার সিটিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। এই চার সিটিতে ৬০ জন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাচনের পরের দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।
উল্লেখ্য, গত ২৯ এপ্রিল চার সিটির তফসিল ঘোষণা করে ভোট গ্রহণ নির্ধারিত হয় ১৫ জুন। আর ১৩ জুন থেকে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামবে র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্য, থাকবেন ১৬ জুন পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে বন্ধ হয়ে যাবে নির্বাচনী প্রচার।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তি শোকজ নোটিশেই!
চার সিটি নির্বাচনে ব্যাপকভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। প্রার্থী, প্রার্থীর সমর্থক, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি প্রায় সকলের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছিল পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরের বিরুদ্ধে। সার্কিট হাউজ ও সরকারি গাড়ি ব্যবহার, রাস্তা দখল করে পথসভা, নির্ধারিত ক্যাম্পের চেয়ে অধিক ক্যাম্প ও নিষিদ্ধ বিলবোর্ড স্থাপনের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি ভোট কেনার জন্য টাকা বন্টনের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব অপরাধের জন্য শোকজ নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন রিটার্নিং অফিসাররা। যদিও আইনে জেল ও অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার নজির নেই।