কলাপাড়া উপজেলার পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম অংশে অবস্থিত অস্থায়ী শুঁটকী প্রকল্প। প্রকল্পটির স্থায়ীকরণ না হওয়ায়, সাগরে মত্স্য সংকটের কারণে, আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণের জটিলতা, সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের সমস্যা, হিমাগারের অভাব এবং যোগাযোগের সংকটের ফলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা সৈতক পাড়ের এ অর্থকরী অস্থায়ী শুঁটকী প্রকল্পটি যেকোন সময় গুটিয়ে যেতে পারে। এর ফলে বেকার হয়ে পড়বে প্রকল্পের সাথে জড়িত কয়েক'শ শ্রমজীবী লোকজন।
স্থানীয় এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কতিপয় মহাজন অর্থ খাটিয়ে সাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন জাতের মাছ জেলেদের কাছ থেকে ক্রয় করে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে এ ব্যবসা চলে আসছে। প্রকৃতির উপর নির্ভর করে শুকনো মৌসুমেই শুঁটকী প্রকল্পের ব্যবসা শুরু হয়। কুয়াকাটা সৈকতের শুঁটকী প্রকল্পে সারি সারি বাঁশের মাচানের উপর প্রাকৃতিক রোদে শুকানো হয় সাগর থেকে আহরিত নানা জাতের তরতাজা মাছ। ২৭ বছর পূর্বে প্রকল্পের শুরুতে ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণের মাছ আহরিত হবার ফলে অপচয় রোধ এবং পচন ধরার ভয়ে জেলেরা ও শুঁটকী প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকরা নিজেদের প্রযুক্তিতেই লবণ দিয়ে রোদের তাপে শুকিয়ে থাকে। আর সে শুঁটকী করা মাছ চালান হয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বর্তমানে মাছের দুষ্প্রাপ্যতা এবং লবণের দাম অত্যধিক হওয়ায় মহাজনদের এ প্রকল্পের খরচও বেড়ে গেছে অনেকগুণ।
কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত পারের এ শুঁটকী প্রকল্পে ৫ শতাধিক শ্রমজীবী লোক প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে জড়িত। সমস্ত শ্রমজীবী লোকজনই এ অস্থায়ী শুঁটকী প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজসহ বাঁশের মাচা তৈরি, চাটাই বিছানো, বাঁশ বেঁধে রেলিং তৈরি করা এবং সারা দিন শুকানো কাজও করে । এ শুঁটকী প্রকল্পে প্রধানতঃ পেয়া, ছুরি, লইট্টা, লাক্ষা, চান্দা, চাপিল, পাসিয়া, চিংড়ি, মাইট্টা, হাঙ্গর, শাপলা পাতা মাছ শুকানো হয়। এ ছাড়া অন্যান্য জাতের মাছও শুকানো হয় সাগর পাড়ে। বর্তমানে আবার এ সমস্ত মাছের দামও বেড়ে গেছে অত্যধিক। মাঝে মাঝে সাগরে জেলেদের জালে অস্বাভাবিক বড় আকারের মাছও ধরা পড়ে। তাও জেলেরা এখানে বিক্রি করে। অথচ এ শুঁটকী প্রকল্পটি সম্পূর্ণভাবেই অস্থায়ী। বর্ষার আগেই শুঁটকীকরণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ বর্ষার সময় মাছ শুঁটকীকরণের কাজে ভীষণ সমস্যার সৃষ্টি হয়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে বৈশাখ, বছরের এ ৬ মাস এখানে শুঁটকীকরণের কাজ চলে। প্রয়োজনীয় অর্থাভাব, যন্ত্রপাতির অভাব এবং উল্লেখিত কারণে এখানে উন্নত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রপ্তানিযোগ্য শুঁটকী উত্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ কুয়াকাটা সৈকতের এ শুঁটকী প্রকল্প দেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সোনারচর, রুপারচর, সেন্টমার্টিন, মৌডুবী, হাসার চর, দুবলার চরসহ দেশের অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থানের চেয়ে শুঁটকী করা হয় বেশি। তাই বহুবিধ সমস্যার ফলে কুয়াকাটার এ ঐতিহ্যবাহী শুঁটকী প্রকল্পটি ভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে এর সাথে জড়িত ব্যবসায়ী ও কর্মরত শ্রমজীবী লোকজন ইত্তেফাককে জানান। কুয়াকাটা শুঁটকী প্রকল্পের মহাজনরা জানান, সাগরে মাছ ধরারত তাদের অনেক ট্রলার ডাকাতির কবলে পড়ে। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের বহু ট্রলার সাগরে ডুবে গেছে। যার ফলে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে আগত বহু মহাজন এখান থেকে শুঁটকী ব্যবসা ছেড়ে চলে গেছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের শুঁটকী মহাজনরা এখান থেকে চলে যাবার ফলে স্থানীয়ভাবে কিছু লোকজন জীবিকার তাগিদে এখানে শুঁটকীর ব্যবসা ধরে রেখেছে।
কুয়াকাটা সৈকতের শুঁটকী ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতি মৌসুমে এ প্রকল্প থেকে প্রায় ৫ হাজার মণ শুঁটকী উত্পাদন হয়। এ উত্পাদিত শুঁটকী চট্টগ্রামসহ দেশের ভিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকরণ হয়। যার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে মত্স্য স্বল্পতার ফলে এবং আহরিত সে মাছের অত্যধিক মূল্য থাকায় শুঁটকী ব্যবসায়ে এখন মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। যদি এখানে শুঁটকী প্রকল্পে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রসেসিং করে বিদেশে ব্যাপক পরিমাণে রপ্তানি করা যেত তাহলে প্রচুর লাভবান হতো সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী লোকজন এবং ব্যবসায়ীরা। তাই এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।