পৃথিবীতে আমরা হাজারো রকমের প্রাণীর দেখা পাই। এমন আরও হাজারো প্রাণী এই পৃথিবী জুড়ে একসময় দাপিয়ে বেড়াতো অথচ আজ তারা নাই। ক্যামেরার সাহায্যে তোলা অথবা চিত্রকরের তুলিতে আঁঁকা প্রাণীর ছবি দেখে তাদের অনেককে তোমরা চিনতে পার আবার অনেককে চেনো না। এদের মধ্যে অনেক প্রাণী আছে যারা কোন এক সময় আমাদের এই পৃথিবীর অধিবাসী ছিল। পৃথিবীর পরিবেশ ও আবহওয়া পরিবর্তনের কারণে এবং পশু শিকারের খেসারত দিতে সতেরো থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে এদের অনেককে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হয়। চলো হারিয়ে যাওয়া সে সকল কয়েকটি প্রাণী গল্প শোনাই আজ তোমাদের। আজ থাকছে তার প্রথম কিস্তি।
তাসমানিয়ান বাঘ : এই বাঘটি অনেকের নিকট তাস্মানিয়ান নেকড়ে বা থাইলাচিনি বলে পরিচিত ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী এই মাংসাশী প্রাণীটি ক্যাঙ্গারুর ন্যায় তার পেটের তলায় থলিতে শাবক বহন করতে পারত। দেখতে অনেকটা কুকুরের দেহের ন্যায় এই বাঘটির দেহ ছিল পাতলা, পা ও লেজ ছিল চিকন এবং চোয়ালে ৪৬টি দাঁত দিয়ে সাজানো মুখমন্ডল ছিল সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মুখমন্ডল—এর মত। অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা পর এই বাঘের প্রধান খাদ্যের বিরাট একটি অংশ মানুষের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ফলে খাদ্য সংকটে পড়ে এই বাঘ। একসময় খাদ্যের অন্বেষণে এসে তারা কলোনিয়ালদের মেষ ও মেষপালকের ওপর হামলে পড়ে। তখন সরকারী আদেশে শুরু হয়ে যায় বাঘ নিধন। দীর্ঘদিন নির্বিচারে হত্যা করার পর এক সময় বাঘের সংখ্যা দ্রুত হরাস পেলে সরকার এই প্রাণীটির অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসে কিন্তু ততক্ষণে বেলা বহুদূর গড়িয়ে যায়। ১৯৩৩ সালে এই প্রজাতির সর্বশেষ নমুনাটি ধরা পড়ে এবং ১৯৩৬ সালে বাঘটির মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তাসমানিয়ান বাঘের বিলুপ্তি ঘটে।
মেক্সিকান ভালুক : যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস এবং উত্তর মেক্সিকোর তৃণভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল এলাকায় মেক্সিকান ভালুকের আবাসভূমি ছিল। ধূসর বর্ণের এই প্রাণীটি ছিল মেক্সিকোতে বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে সর্ব বৃহত্ প্রাণী। এটি লম্বায় ছিল ১৮৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন ছিল প্রায় ৩১৮ কেজি। ১৯৬৪ সালে এই প্রাণীটির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
ড্যাডো পাখি : তোমরা হয়তো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের নাম শুনে থাকবে। ১৬০০ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম এই প্রাণীটি সেই ছোট্ট দ্বীপটিতে মানুষের গোচরীভূত হয়। বিজ্ঞানীদের মতে প্রাকৃতিক ক্রমবিকাশের ফলে এই প্রাণীটির পাখা ক্রমেই ছোট এবং পা দুটি শরীরের তুলনায় বড় হতে থাকে। একটি পর্যায়ে এসে এইপ্রাণীটি দৌড়ানো এবং উড়াল দেয়ার ক্ষমতা হারায়। ড্যাডো পাখির আহার ছিল গাছ থেকে মাটিতে পড়া ফল ফলাদি। ১৬০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে মানুষের আগমন হলে আত্মরক্ষা করতে অক্ষম প্রাণীটি মানুষের আহারে পরিণত হয় এবং এই দ্বীপে মানুষের আগমনের প্রায় ৮০ বছর পর অর্থাত্ ১৬৮১ সালে ড্যাডো পাখির বিলুপ্তি ঘটে।
হ্যাস্ট ঈগলপাখি : নিউজিল্যান্ডের হ্যাস্ট ঈগলপাখি ছিল পৃথিবীতে বসবাসকারী পাখিদের মধ্যে সর্ববৃহত্ পাখী। এই পাখীর ওজন ছিল ১০ থেকে ১৫ কেজি। বর্তমানে মধ্য ও দক্ষিন আমারিকায় যে সকল বৃহত্ আকৃতির ঈগল পাওয়া যায় হ্যাস্ট ঈগলপাখীর ওজন ছিল তাদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশী। হ্যাস্ট ঈগলপাখীর প্রধান খাদ্য ছিল তৃণভোজী ও উড়তে অক্ষম বিশাল দেহের অধিকারী মওয়া পাখি। ৭০০ বছর পূর্বে নিউজিল্যান্ডে মানুষের পদার্পণ ও বসবাস শুরু হলে এই বিশাল ও শান্ত প্রকৃতির মওয়া পাখিটিও মানুষের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে খাদ্য সংকটে পড়ে যায় বেচারা হ্যাস্ট ঈগলপাখী। অবশেষে ২০০ বছর পর হ্যাস্ট ঈগলপাখী এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ক্যারিবিয়ান মনক সীল (মোনাচুস ট্রোপিক্যালিস) : ক্যারিবিয়ান মনক সীল নামের এই স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস ছিল গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল ক্যারিবিয়ান সাগর এবং ফ্লোরিডার উপকূলবর্তী এলাকায়। বিংশ শতাব্দির শুরুতে এই প্রাণী লোকচক্ষুর আড়াল হতে থাকলে খুঁজে বের করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করা হয় কিন্তু খোঁজার পর কোনো সন্ধান না পাওয়ার কারণে ১৯৫২ সালে ক্যারিবিয়ান মনক সীলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
পার্সিয়ান বাঘ : এই বাঘটি অনেকের নিকট কাসপিয়ান টাইগার নামে পরিচিত ছিল। এই প্রাণীটির আবাসস্থল ছিল সুদূর আনাতোলিয়া উপদ্বীপ থেকে ককেশাস, কুর্দিস্থান উত্তর ইরাক, ইরান আফগানিস্তান এবং মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও সাইবেরিয়ান বাঘের পর বৃহত্তম বাঘ হিসেবে এই বাঘের স্থান ছিল তৃতীয় স্থানে। পরবর্তিতে এই অঞ্চলগুলোতে মানুষের বসবাস বৃদ্ধি পেলে এই প্রাণীর পৃথিবী সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। তাছাড়া রাশিয়ার জার ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলো দখল করে সম্রাজ্যের পরিধি বাড়ানোর সময় অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী বাঘগুলোকে হত্যার আদেশ দিলে অতি অল্প সময়ে এদেরকে নিধন করা হয়। ১৯৬১ সালে তাজিকিস্তানে শেষ বারের মত এই বাঘটি মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়।