স্কুলে নতুন আপা এসেছেন। তিনি পড়ান খুব সুন্দর করে। হাসি হাসি মুখ। সব ছাত্রছাত্রীকে আদর করেন। যারা পড়া পারে না তাদেরকে বেশি আদর করেন। বেশি করে পড়ান। কাউকে বকা দেন না। কাউকে মারেন না। স্কুলে যে বেতগুলো ছিল সেদিন সেগুলোকে ফেলে দিয়েছেন। বললেন, শিশুদেরকে মেরে লেখাপড়া করানো যায় না। এখন সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আনন্দ। কারো মন খারাপ থাকতে দেখা যায় না। স্কুলের সময় হলে কেউ আর বাড়িতে থাকতে চায় না। স্কুলে চলে আসে। একজন মানুষ ইচ্ছে করলে কত কিছু বদলে দিতে পারেন!
অনুপম চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সে খারাপ ছাত্র ছিল। কিন্তু আপা আসার পর থেকে সেও ভালো হয়ে গেছে। কীভাবে কী হলো সে বুঝতে পারছে না। আগে অনুপম স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলত। এখন সে আর স্কুল ফাঁকি দেয় না। সেদিন আপা বললেন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে গল্প প্রতিযোগিতা হবে। গল্প হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের। অনুপমের তো মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। একটা গরুর রচনা যেখানে ভালোভাবে লিখতে পারে না, সে আবার লিখবে কিনা গল্প! এই বুদ্ধিটা আপার মাথায় না এলে হতো না? একদিন আপা বললেন, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে কত মানুষ শহীদ হয়েছেন। কত মা-বোন নির্যাতিত হয়েছেন, তা জানা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। তোমরা যদি গল্প লেখা শুরু করো, অনেক ইতিহাস জানতে পারবে।
অনুপমের চিন্তার দরজা খুলে গেল। সে ভাবল, আমার নানাভাই তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনতে পারি। গল্পও হয়ে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে পরেরদিন তার নানাভাইয়ের কাছে গেল।
অনুপম নানাভাইকে জিজ্ঞেস করল, নানাভাই, তুমি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে, আমাকে বলো। তার নানাভাই একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, তোমার সে কথা জানতে হবে কেন? অনুপম বলল, আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখতে হবে। আপা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা সবার কর্তব্য। আমাদের স্কুলে গল্প লেখার প্রতিযোগিতা হবে। তোমার কাহিনী দিয়েই গল্প লিখব।
অনুপমের কথা শুনে আনন্দে নানাভাইয়ের চোখে পানি এসে গেল। তিনি অনুপমকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। বললেন, নয় মাস জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কেউ কোনো দিন এল না আমার কথা শুনতে। তুমি আমার কথা দিয়ে গল্প লিখবে? এ আনন্দ যে আর ধরে না। তাঁর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। একবার বললেন, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন ছিল কষ্টের, তেমনি গৌরবের। কিন্তু কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে নষ্ট করে দিয়েছে। নানাভাইয়ের কান্না দেখে অনুপমের চোখেও পানি এসে গেছে। নানাভাই যুদ্ধের কাহিনী বললেন। অনুপম সে কাহিনী লিখল। এই কাহিনী শুনে অনুপম অবাক হয়ে গেল। এত কষ্ট আর মৃত্যুর কাহিনী!
অনুপমের এই কাজ দেখে তার নানাভাই খুব খুশি হলেন। তিনি তাকে একটা সুন্দর ডায়েরি কিনে দিয়ে বললেন, তুমি এই ডায়রিতে আরও গল্প লিখবে। পরেরদিন অনুপম ভাবল, আমাদের গ্রামে তো আরও মুক্তিযোদ্ধা আছেন। আমি তো তাদের কাহিনীও লিখতে পারি। পরেরদিন সে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনী শুনতে গেল। সে যতই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গেল ততই অবাক হলো। একেক জনের ইতিহাস একেক রকম। একটি ছোট্ট শিশু মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী লিখছে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা খুব আনন্দিত। তাঁরা অনুপমকে অনেক সাহায্য করলেন।
অনুপম তার এলাকার যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সবার জীবনের কথা লিখল। মনে মনে ভাবল, বড় হয়ে এই জীবনকথা দিয়ে বই লিখবে। কিন্তু স্কুলের গল্প প্রতিযোগিতার কী হবে? অনুপম ভাবল, সবচেয়ে কষ্টের কাহিনী দিয়ে একটা গল্প লিখবে। সবচেয়ে কষ্টের কাহিনী হলো মুক্তিযোদ্ধা কাশেম দাদার। যুদ্ধের সময় তিনি তাঁর দু'টি পা-ই হারিয়েছিলেন। আহা, কত কষ্টের জীবন! তিনি এখন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। তিনি যুদ্ধ করতে গিয়ে কীভাবে পা হারালেন, সে কাহিনী অনুপম লিখল। লিখতে অনুপমের চোখে বারবার পানি এসেছে। তার কান্না থামিয়ে রাখতে পারেনি। এক রাজাকারের গুলিতে তাঁর দু'টি পা হারিয়েছিলেন। সেই রাজাকার এখন একটা পার্টির বড় নেতা।
প্রতিযোগিতায় বিশজন ছাত্রছাত্রী গল্প জমা দিল। গল্প বাছাইয়ের জন্য থানা শিক্ষা অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার এলেন। পাশের হাইস্কুলের বাংলা শিক্ষক এলেন। আর এসেছেন নান্দাইল শহীদ স্মৃতি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি একজন কবি। অনুপমদের স্কুলে যেন আনন্দের জোয়ার। বিকেলে পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুরস্কার দেবেন। গ্রামের লোকজন এসেছেন। আরও এসেছেন পাশের গ্রামের আবুল কাশেম মুক্তিযোদ্ধা, যিনি যুদ্ধের সময় দু'টি পা হারিয়েছিলেন।
অনুপমের বুক দুরু-দুরু করছে। কে বিজয়ী হয় কে জানে? সব ক্লাসের ভালো ছাত্রছাত্রীরা গল্প জমা দিয়েছে। তারাই তো প্রথম হবে। অনুপম ভাবছে, যা হবার তাই হবে। প্রতিযোগিতায় হারলেও মন খারাপ করতে নেই। আপা বলেছেন। সে শান্ত হয়ে আমগাছের নিচে বসে রইল।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হলো। আপা অনুপমের দিকে মাঝে মাঝে তাকান আর পিটপিট করে হাসেন। অনুপমের বুক তখন কেঁপে উঠল। ব্যাপার কী? আপা হাসছেন কেন?
অনুপমের নাম ঘোষিত হলো। সে প্রথম বিজয়ী। উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজে মঞ্চের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে অনুপমকে এসে কোলে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। তার চোখে পানি। তিনি আনন্দে কাঁদছেন। এত ছোট ছেলে এত সুন্দর কাহিনী কীভাবে লিখল? উপজেলা নির্বাহী অফিসারের চোখে পানি দেখে সবার চোখ থেকে পানি পড়ছে। আপাও আনন্দে কেঁদে ফেললেন। মুহূর্তের মধ্যে আনন্দের আসরটা যেন কান্নার আসরে রূপ নিল।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বললেন, আমি এই অনুষ্ঠানে আসতে চাইনি। শিক্ষা অফিসার জোর করে ধরলেন, তাই এলাম। এখন মনে হচ্ছে, আমি যদি না আসতাম, তাহলে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতাম। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ধরনের গল্প প্রতিযোগিতা খুব অবাক করার মতো ব্যাপার। আমি অনুপমের মধ্যে যে প্রতিভা দেখতে পাচ্ছি, তা এ দেশের মানুষকে একদিন আলোকিত করবে। এত ছোট একটা ছেলে কীভাবে পারল এমন কাহিনী লিখতে, ভাবতেই পারছি না। আনন্দে আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। সুপ্রিয় সুধীজন, আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।
তিনি যখন অনুপমের মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনী সংগ্রহের কথা শুনলেন, তখন আরো অভিভূত হলেন। তিনি তার ভাষণে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে ভালোবাসা মানে দেশকে ভালোবাসা। দেশকে ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত অনুপমের মতো একটা ছোট ছেলে দেখাল, তার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমি গর্ব করে বলছি, অনুপমের মতো যদি অন্তত একটি ছেলেও প্রতিটি স্কুলে থাকে, তাহলে এ দেশ হবে স্বর্গভূমি।
অলঙ্করণ :রামিলা রাশেদ তোফা, সদস্য নম্বর :৩৩৩৮, যাত্রাবাড়ি, ঢাকা