টুর্নামেন্টের সবচেয়ে 'হাই প্রোফাইল' ম্যাচে আজ মুখোমুখি হচ্ছে ব্রাজিল-জার্মানি। পরিসংখ্যান কিংবা ফুটবল ঐতিহ্যে ব্রাজিল সামান্য এগিয়ে থাকলেও, আজকের ম্যাচে ফেভারিট বলা যাচ্ছে না কাউকেই। যদিও এই টুর্নামেন্টে জার্মানি এখনো তাদের সেরা রূপে দেখা দিতে পারেনি, তবু আজকের ম্যাচে তারাই সামান্য এগিয়ে থাকবে। কিংবা বলা চলে দলের সেরা দুই খেলোয়াড়ের চোট এবং নিষেধাজ্ঞা পিছিয়ে দিয়েছে ব্রাজিলকে। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, ব্রাজিল কিন্তু তার নিজের মাটিতে খেলছে। ষাট হাজার দর্শকের সমর্থন যে কোন ম্যাচে প্রভাব ফেলতে যথেষ্ট। আমি নিশ্চিত, ফাইনালে যেতে হলে ব্রাজিলের এই তীব্র দর্শক সমর্থনের কোন বিকল্প নেই।
বিশ্বকাপের গত ১৯টি আসরে আটবারই শিরোপা জিতেছে ব্রাজিল অথবা জার্মানি। এই একটি তথ্যই বোধহয় তাদের ফুটবল ঐতিহ্য এবং আজকের ম্যাচের ওজন বোঝাতে যথেষ্ট। শুধু ঐতিহ্য কিংবা সাফল্য নয়, ফুটবল বিশ্বের সর্বকালের সেরা কিছু তারকার যোগান দিয়েছে এই দুই দেশ। যারা কিনা বছরের পর বছর, দর্শকদের বিনোদন যোগানোর পাশাপাশি ফুটবলকে এই অবস্থায় তুলে আনতেও বড় ভূমিকা রেখেছেন। পেলে, গ্যারিঞ্চা, সক্রেটিস, জিকো, রোনালদো, বেকেনবাওয়ার, জার্ড মুলার, লোথার ম্যাথাউসসহ আরো কত নাম। এই নামগুলোই আজ অস্কার-লাম-মুলারদের প্রেরণা যোগাবে, তাদের সর্বস্ব উড়ায়ে করে দিতে অনুপ্রাণিত করবে।
তাই এই ম্যাচটা কেবল বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল নয়, হয়ে উঠেছে এর চেয়েও বেশি কিছু। এমন ম্যাচে যে কোন ফুটবল বোদ্ধার পূর্বানুমান মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে পারে, যে কোন পরিসংখ্যানকে উড়িয়ে দিতে পারে। টুর্নামেন্টে দু'দলের পারফরম্যান্স বিচারেও ফেভারিট বলা যাচ্ছে না কাউকেই। কারণ দুই দলেই আজ এমন কিছু খেলোয়াড় আছেন, যাদের সামর্থ্য আছে একাই ম্যাচ বের করে নেয়ার। ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার। বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে গঞ্জালো হিগুইন আর্জেন্টিনার পক্ষে যেমনটা করেছেন।
তবে এরপরও সাদা চোখে দেখলে বলতে হবে, নেইমারের চোট এবং থিয়াগো সিলভার নিষেধাজ্ঞা কিছুটা হলেও পিছিয়ে দিয়েছে ব্রাজিলকে। এটা যেমন সত্যি, তেমনি তাদের অভাব পূরণের ক্ষমতা পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের আছে; সেটাও সত্যি। তবে কৌশলগত দিক থেকে নেইমারের চেয়ে সিলভার অভাবটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ ব্রাজিল দলের সবাই আক্রমণাত্ম খেলতে পছন্দ করেন। এই দলে কেবল একজন খেলোয়াড়ই আছেন যাকে আমরা পুরো টুর্নামেন্টেই কেবল রক্ষণ কাজে মনোযোগী থাকতে দেখেছি, তিনি সিলভা। তাছাড়া একজন অধিনায়ক সব সময়ই বিশাল মানসিক সমর্থনের যোগানদাতা। ব্রাজিল সব কিছুই মিস করতে যাচ্ছে আজ। সিলভার অনুপস্থিতিতে, দান্তেকে নামানো হতে পারে তার ভূমিকায়। বায়ার্ন মিউনিখের পক্ষে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসাবে খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। তাছাড়া জার্মানি দলে এক ঝাঁক বায়ার্ন তারকা খেলছেন। যাদের প্রায় সবার দুর্বলতা-শক্তিমত্তা দান্তের বেশ ভালভাবেই জানা থাকার কথা। এসব বিবেচনা করে লুই ফেলিপে স্কলারি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো দলে সুযোগ দিতে পারেন দান্তেকে। সেই কাজে দান্তে বেশ ভাল করবেন বলেই মনে হচ্ছে আমার। তবে রাইট ব্যাক হিসাবে দানিয়েল আলভেজের অনুপস্থিতি বেশ ভাবাচ্ছে আমাকে। মাইকন এই পজিশনে গত শুক্রবার রাতে বেশ ভাল খেলেছেন, তবে আলভেজের মতো নয়। মাইকন আর আলভেজের মূল পার্থক্য হচ্ছে, আলভেজ যেখানে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক সেখানে মাইকন খানিকটা রক্ষণাত্মক। কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটাই এর প্রমাণ। ঐ ম্যাচে ব্রাজিলের প্রায় সবগুলো আক্রমণই হয়েছে বাম প্রান্ত থেকে মার্সেলোকে কেন্দ্র করে। কিন্তু জার্মানির মতো বড় দলের বিরুদ্ধে কেবল একটি উইং যথেষ্ট নয়। নেইমার থাকছেন না বলে এমনিতেই ব্রাজিলের আক্রমণের সংখ্যা কমে যাবে। আক্রমণভাগকে নিশ্চয়ই আরো বেশি দুর্বল করতে চাইবেন না স্কলারি। সেক্ষেত্রে হয়তো কাতালান তারকাটিকে দেখা যাবে আজ। জার্মানি সেই তুলনায় বেশ নির্ভার। চোট কিংবা কার্ডের কোন সমস্যা নেই তাদের। বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার হয়তো কোয়ার্টার ফাইনালের মতোই শুরু থেকে মাঠে থাকছেন। রাইট উইংয়ে থাকবেন অধিনায়ক ফিলিপ লাম। সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার এবং সেট পিস বিশেষজ্ঞ ম্যাট হামেলস আজ হেডের মাধ্যমে ব্রাজিল রক্ষণে আতঙ্ক ছড়াতে প্রস্তুত। তবে জার্মানির জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাদের মূল খেলোয়াড় মেসুত ওজিলের ফর্মহীনতা। টুর্নামেন্টে গোল পেলেও এই আর্সেনাল তারকা এখন পর্যন্ত নিজের সেরা রূপে দেখা দিতে পারেননি। কে জানে আজই হয়তো ফিরবেন তিনি। অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার মিরোস্লাভ ক্লোসাকে প্রথম একাদশে দেখা যাওয়ার সুযোগ কমই। সেই তুলনায় বরং আন্দ্রে স্কুরেল বেশি কার্যকর হতে পারেন। তবে প্রতিপক্ষের এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে পারে ব্রাজিল, কারণ মাঠের এগারজনের বাইরে মাঠের বাইরে আরো অর্ধ লক্ষেরও বেশি মানুষের সমর্থন পাচ্ছে তারা। সব মিলে জমজমাট একটা লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি আমি।