বিশ্বকাপের ইতিহাসে এর আগে কখনো তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ নিয়ে এতটা আলোচনা হয়েছে কিনা মনে পড়ে না। নানা নতুন ঘটনা আর ইতিহাসের জন্ম দেয়া ব্রাজিল বিশ্বকাপ যাত্রার শেষ দিকে এসে আরেকটি নতুন ধারণার জন্ম দিল। নিঃসন্দেহে এই আলোচনার মূল কারণ, স্বাগতিক ব্রাজিল খেলছে এই ম্যাচে। ব্রাজিল কিভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায় কিংবা আদৌ দাঁড়াতে পারে কিনা, সেটা দেখতে অপেক্ষা করছেন সবাই। ফলে আজ ব্রাসিলিয়ায় ব্রাজিল-নেদারল্যান্ডস ম্যাচটিকে নিতান্ত নিয়মরক্ষার ম্যাচ বলে ভাবা যাচ্ছে না।
সেমিফাইনালে সাত গোলের লজ্জায় ডোবা ব্রাজিলের জন্য ম্যাচটি কোটি কোটি সমর্থকের ভাঙ্গা হূদয়ে প্রলেপ লাগানোর একটি সুযোগ। অন্যদিকে, আরো একবার শেষ চার থেকে বিদায় নেয়া ডাচরা চাইবে অন্তত কিছু সন্তুষ্টি নিয়ে দেশে ফিরতে। যদিও তাদের কোচ লুইস ফন গল জানিয়ে দিয়েছেন, এই ম্যাচ নিয়ে খুব একটা ভাবছেন না তিনি।
ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণের বাইরে বিশ্বকাপের একটি আসরের অর্থনৈতিক তাত্পর্যও নিতান্ত তুচ্ছ নয়। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি আসর থেকে প্রায় তিনশ কোটি ডলার আয় করবে ফিফা। এই বিশাল অর্থের হাতছানিই তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ আয়োজনের পেছনে বড় যুক্তি হিসাবে কাজ করেছে। এটা এমন একটা ম্যাচ যেখানে খেলতে চায় না কোন দলই। কারণ, সেমিফাইনালে পৌঁছা প্রতিটি দলই টুর্নামেন্ট শুরু করে চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন যখন শেষ হয়ে যায়, আমার মনে হয় না তখন নিয়মরক্ষার কোন ম্যাচ খেলার মানসিকতা কারো থাকে। আর্জেন্টিনার কাছে হেরে ফাইনালের স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবার পর ফন গল যেমন বলেছেন, এই ম্যাচ খেলার কোন যুক্তিই নেই।
অতীতের আসরগুলোর জন্য কথাটি হয়তো ঠিক। তবে এবার সমীকরণটি ভিন্ন। বলা চলে, পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের জার্মানদের কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার বিষয়টিই পাল্টে দিয়েছে সবকিছু।
বিশ্বব্যাপী ব্রাজিলের বিশাল দর্শক সমর্থন একটি ব্যাপার। তার চেয়েও বড় বিষয়টি হচ্ছে বিশ কোটি ব্রাজিলিয়ান। তারা চোখের সামনে তাদের স্বপ্নকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখেছেন। দেখেছেন ডেভিড লুইজ-অস্কারদের নিয়ে রীতিমতো ছেলে খেলা করেছেন টমাস মুলার-টনি ক্রুজরা। আমি নিশ্চিত ঐ নব্বই মিনিট প্রতিটি ব্রাজিলিয়ানের কাছে নব্বই বছরের মতো দীর্ঘ মনে হয়েছে। যারা অপেক্ষা করছিল প্রিয় দলের বিজয় উত্সবের জন্য, তারাই চেয়েছে যত দ্রুত সম্ভব এই ম্যাচ শেষ হয়ে যাক! ফুটবল পাগল একটি দেশ, যারা কিনা ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সফল দল; সেই দলটিকেই কিনা দেখতে হলো নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয়!
যেই দেশে শিরোপা বাদে অন্য যে কোন ফলাফলকেই মানা হয় লজ্জা হিসাবে, সেই দেশের মানুষ এই হারে কিভাবে মুষড়ে পড়েছে ভাবাটা কঠিন কিছু নয়। এখন লুইস ফেলিপ স্কলারির দলের সুযোগ দেশবাসীর সেই হতাশ, ব্যথীত, দুঃখপীড়িত মনে কিছুটা হলেও সান্ত্বনার প্রলেপ বুুলানোর।
দলের সেরা তারকা নেইমার এরই মধ্যে সতীর্থদের অনুপ্রাণিত করেছেন সর্বস্ব উজাড় করে দিতে। বলেছেন, দেশবাসীর জন্য কিছুটা আনন্দের উপলক্ষ ফিরিয়ে আনতে।
আমার মনে হয় ব্রাজিল দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের মনেও ঠিক সেই বিষয়টাই কাজ করবে। যে লজ্জায় তারা ডুবেছে, কোন কিছুই সেটা ভোলাতে যথেষ্ট নয়। মারাকানায় ১৯৫০ বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচে হারের দুঃখ আজ পাঁচ যুগ পরেও ভুলতে পারেনি ব্রাজিল, এই হারের দুঃখ ভুলতে কত শতাব্দী লাগবে কে জানে। তবে এর মাঝেও আজকের জয়টা হয়তো সমর্থকদের মনে সাময়িক একটা আনন্দের উপলক্ষ হিসাবে কাজ করবে। সুতরাং, জীবনবাজি রেখে শেষ বারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবেন হাল্ক, জুলিও সিজাররা।
স্কলারি হয়তো কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনবেন। শেষ চারে তাকে যেভাবে আক্রমণাত্মক কৌশল বেছে নেয়ার মাশুল গুনতে হয়েছে, তারপর এই পরিবর্তনটা আসলে অবশ্যসম্ভাবী। অল আউট আক্রমণে না গিয়ে বরং কিছুটা পজেশনাল ফুটবল খেলতে চাইবে ব্রাজিল। একই পথ অনুসরণ করবে নেদারল্যান্ডসও। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ম্যাচের মতোই খেলতে চাইবে তারা। পাশাপাশি চেষ্টা থাকবে পাল্টা আক্রমণেরও। সবমিলে আমার মনে হয়, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে যে ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবটা সবাই আশঙ্কা করছে, তেমনটা দেখা যাবে না এখানে। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে সুন্দর একটা ম্যাচ উপভোগ করতে পারবো সবাই।