আর্জেন্টিনা ও জার্মানরা যখন উত্সবের প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই সময়ে মারানাকানা স্টেডিয়াম যেন মৃত্যুপুরী। যে স্টেডিয়ামকে ঘিরে হাজার হাজার ব্রাজিলীয়দের ভীড় লেগে থাকতো তার আশেপাশে এলাকা এখন এক রকম জনমানব শূন্য। মারাকানার রাস্তায় শরীর সচেতন ব্যক্তিরা জগিং করতেন। স্টেডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক উঁকি দিতেন যানবাহনের দর্শক। কোলাহল পূর্ণ সেই এলাকাটি গত বৃহস্পতিবার দেখা গেল একেবারেই নিরব। অবাক কাণ্ড, আজ বাদে কাল বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। অথচ মারাকানায় সেই উত্তেজনার আঁচড় পাওয়া গেলো না।
স্টেডিয়াম এলাকায় ঘুরে ফিরে মনে হলো বিশ্বকাপ ফুটবল অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন এটা ভাঙ্গা হাটের চিত্র। মারানাকানার এলাকার লোকজনদের সাথে কথা বলে জানা যায় তারা এই খেলা নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাতে রাজি না। দোকানগুলোতে ম্যাচের সময় প্রচুর ক্রেতা দেখা যেতো। চেয়ার পাওয়া যেতো না। এখন খুব বেশি ক্রেতা নেই। দোকানে বসে টিভি দেখছেন বিক্রেতারা। আরো অবাক লেগেছে এক সময়ের জমজমাট মিডিয়া সেন্টারটি একেবারেই ফাঁকা। বাংলাদেশ থেকে আসা কয়েকজন সংবাদকর্মী কাজ করে চলেছেন। আর ৬০০ সিটের পুরোটাই ফাঁকা প্রায়। স্বেচ্ছাসেবীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হেরে ব্রাজিলের বিদায়ে এমন দৃশ্য। ফুটবল নিয়ে ব্রাজিলীয়ানদের আগ্রহ কমে গেছে। তারা বলছেন, 'লজ্জা হচ্ছে বলতে আমরা ফুটবলের দেশের মানুষ।' ট্রেনে বাসে টেলিভিশন আছে। সেখানে দেখানো হচ্ছে স্কোলারি মাফ চাইছেন। দেখানো হচ্ছে নেইমার কিভাবে চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন। দেখানো হচ্ছে জার্মানির কাছে কিভাবে সাত গোল হজম করেছে ব্রাজিল। কেন এবং কিভাবে এটা হয়েছে তা তদন্ত করতে বলেছেন ব্রাজিলের ক্রীড়া মন্ত্রী আলডো রেভেলো। কোচ লুইস ফিলিপ স্কোলারির চাকরির মেয়াদ এই বিশ্বকাপ ফুটবল পর্যন্ত ছিল। কিন্তু এখন ব্রাজিল ফুটবল সংস্থা স্কোলারিকে রাখতে নারাজ। ক্রীড়া মন্ত্রী বলেছেন ১৯৫০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের কাছে হেরে যাওয়াটা ছিল জাতীয় বিপর্যয়। এবার যেটা ঘটেছে সেটা আরো ভয়ানক। সরকার ফুটবল নিয়ে নড়াচাড়া দিয়েছে। বলেছে এখনই এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। কোথায় কোথায় সমস্যা হয়েছিল সেটা ঠিকঠাক করতে হবে। যেন আগামী বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিলের এমন করুণ দশা না হয়। ব্রাজিল যখন তাদের ফুটবল বিপর্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় সেই সময়ে রিও শহরের কোপাকাবানা বীচে আনন্দ উল্লাস। ব্রাজিলীয়ানদের নিরবতার মধ্যেও আর্জেন্টাইন জার্মানদের উত্সব চলছে। ১৯৯০-এর ইতালী বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও জার্মানি মুখোমুখি হয়েছিল। রোম শহরের সেই ফাইনালে জার্মানি ১-০ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। তার আগের আসরে ৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা ৩-২ গোলে হারায় জার্মানিকে। জার্মানি এবার নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলছে আটবার। আর্জেন্টিনা খেলছে পঞ্চম ফাইনাল। ২৪ বছর পর আবার জার্মানি আর্জেন্টিনার লড়াই দেখবে ফুটবল দুনিয়া। এমন শুভলগ্নে উত্সবের প্রস্তুতি তো নিতেই পারেন তারা।
ব্রাজিলের পর নেদারল্যান্ডসের বিদায়ে আর্জেন্টাইন এবং জার্মানরা এখন গলায় গলা মেলাচ্ছেন। দুই দেশের ভৌগোলিক ব্যবধানটা পেছনে ঠেলে দিয়ে কোপাকাবানায় তারা রীতিমতো পিকনিক করছেন। ফাইনাল ম্যাচের আনন্দে বৃষ্টি ভেজা দিনেও সমুদ্র দেখার ভীড় অতিথিদের। ১৩ জুলাই ফাইনাল। স্বাগতিক ব্রাজিল নেই। অতিথি দল আর্জেন্টিনা এবং জার্মানি খেলবে ফাইনাল। বুধবার বিশ্বকাপ ফুটবলের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা নেদারল্যান্ডসকে হারানোর পরই রিওতে আসতে শুরু করেছেন দুই দেশের হাজার হাজার দর্শক। কোপাকাবানার বীচে শত শত গাড়ি। যার ভেতরেই বসবাস, খাওয়া দাওয়া। জোরে স্প্যানিশ গান বাজাচ্ছেন। বোগলদাবা করে গিটারে সুর তুলতে চাইছেন কেউ কেউ। ব্রাজিলকে সাত গোল দেয়ার পর জার্মানি থেকে প্লেনে উঠে রিওতে নামতে শুরু করেছেন জার্মানরা। আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠার পর থেকে সেখান থেকেও দর্শক আসতে শুরু করেছে।সবাই মারাকানার কাছেই কোপাকাবানায় গিয়ে হোটেলে উঠছেন। আনন্দ করছেন। উল্লাস করছেন। কোপাকাবানার বীচ ঘেঁষে বিলাস বহুল হোটেল হবে অন্তত ১শ'। আরো আছে পেছনের দিকে। একই চিত্র।
দুই দেশের দর্শকের কারণে হোটলে রুম খালি নেই। হোটেলের রেস্টুরেন্ট এবং পানশালায় পা রাখার জায়গা নেই। ব্রাজিল ফাইনালে ওঠেনি। তারপরও রিওর হোটেল খালি নেই। দীর্ঘদিন পর আর্জেন্টিনা জার্মানি বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনাল খেলছে। দুই দেশের ফুটবলামোদীদের আগ্রহ অনেকখানি বেড়ে গেছে। এ কারণে কোথাও রুম খালি নেই। কোপাবানার বিরাট এলাকা ছড়িয়ে আশেপাশের হোটেলগুলোতেও ফাঁকা নেই। কোন কোন হোটেল মালিক রুম ফাঁকা থাকার পরও ভাড়া দিচ্ছেন না। কারণ তারা জানেন পকেট ভর্তি ইউরো নিয়ে আসছেন জার্মান দর্শকরা। তাই আশায় আছেন এসব হোটেলের মালিকরা, ফাইনালের আগে ১০ গুণ ভাড়া বাড়িয়ে ফায়দা লুটে নেয়া যাবে বলে।