পারস্পরিক স্বার্থেই পরস্পরের প্রতি সম্মাননা প্রদর্শনের উপরে গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক যে বিশ্বশান্তির জন্যও অপরিহার্য সেই ব্যাপারটিকেও হিসাবের মধ্যে লইতেছে উভয় পক্ষ। চীন মনে করিতেছে, দুই দেশের মধ্যে যদি কোন ধরনের সংঘাত বাধিয়া যায়, তাহা হইলে তাহা হইবে একটি বিপর্যয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র জানাইয়াছে, চীনকে কোণঠাসা করিবার কোন ইচ্ছাই তাহার নাই। গত বুধবার বেইজিংয়ে শুরু হওয়া চীন-মার্কিন বার্ষিক সংলাপ হইতে আগত এমন ইতিবাচক বার্তা বিশ্বব্যাপী কিছুটা হইলেও স্বস্তির পরশ বুলাইয়া দেয় বৈকি। বৃহস্পতিবার নাগাদ উভয় পক্ষ সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে পরস্পরকে সহায়তাদানের ব্যাপারেও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে এই বার্তা পরিবেশন করিতেছে যে, পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়া থাকিয়া বস্তুত কোন পক্ষই লাভবান হইতে পারিবে না। বরং পরস্পরকে সহায়তা দানের মাধ্যমেই উভয়ের লাভবান হইবার সম্ভাবনা অধিক। চীন যাহা চাহিতেছে তাহা হইল, উভয় পক্ষের মধ্যে সমতাভিত্তিক সম্পর্ক, একের সার্বভৌমত্বের প্রতি অন্যপক্ষের সম্মান এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত একপক্ষের ধারণার ব্যাপারে অন্যপক্ষের শ্রদ্ধা প্রদর্শন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বলিতেছে যে, কোন কোন বিষয়ে ভিন্নমত থাকিলেও চীন যেন এই সকল ভিন্নমতকে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক কৌশলের অংশ হিসাবে ধরিয়া না লয়। তবে এই জায়গাতে আসিয়া গোল বাধিবার ঝুঁকি থাকিয়াই যাইতেছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্র যেই কয়েকটি বিষয় লইয়া কড়া সমালোচনা করিয়া থাকে সেইগুলিকে চীন ধর্তব্যের মধ্যে লয় না। উল্লেখ্য, জলসীমা লইয়া প্রতিবেশীদের সহিত মতানৈক্য ও সাইবার দুনিয়ার অপরাধে চীনা হ্যাকারদিগকে চিহ্নিতভাবে দায়ী করা লইয়া সামপ্রতিক সময়ে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে নীরব উত্তেজনা বিরাজ করিতেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন লইয়াও এই দুই দেশ একে অপরের তীব্র সমালোচনা করিতেছে দীর্ঘদিন ধরিয়া।
জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান ও ব্রুনেইয়ের মত প্রতিবেশীদের সহিত সমুদ্রসীমা লইয়া চীনের নানা প্রকার বিরোধ আছে। বিশেষ করিয়া জাপানের সহিত বিরোধ ইদানীং বেশ খানিকটা উত্তেজনা ছড়াইতেছে। আর এইক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই জাপানের পক্ষ লইয়া আছে। বেইজিং মনে করে যে, কেবল জাপানকে সমর্থন দানই নহে বরং অন্য প্রতিবেশীদিগকেও জলসীমা লইয়া চীনের বিরুদ্ধে তাতাইয়া তোলাতে ওয়াশিংটনের ভূমিকা আছে। এই বিষয়ে দুই পরাশক্তির মধ্যে সমঝোতা না হইলে সম্পর্কের প্রকৃত উন্নতি কতখানি হইবে, তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না। সাইবার জগতে হ্যাকিং-এর মত অপরাধবৃত্তি লইয়াও দুইপক্ষের মধ্যে মতানৈক্য চলিতেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবিমতে সাইবার জগতে অপরাধের ক্ষেত্রে চীনা হ্যাকারদের ভূমিকাই সর্বাধিক। বিশেষ করিয়া মেধাস্বত্ব আইনের লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনা হ্যাকারদিগকেই বলিতে গেলে এককভাবে দায়ী করে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চীনের প্রতি দাবি জানায়। মেধাস্বত্ব আইনের লঙ্ঘনকে চীনও আশঙ্কাকর একটি বিষয় হিসাবে চিহ্নিত করিতেছে। কিন্তু বলাইবাহুল্য যুক্তরাষ্ট্র যেইভাবে বিষয়টি লইয়া প্রচার-প্রচারণা চালাইতেছে ও ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলিতেছে তাহার সহিত মোটেও একমত নহে চীন। ইহা ছাড়াও মানবাধিকারের লঙ্ঘন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য ও প্রচারণাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল হিসাবে গণ্য করে চীন। এই দুই পরাশক্তি নিয়মিত সংলাপে বসিতেছে; বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার দিক হইতে দেখিলে ইহা স্বস্তিকর। কিন্তু উল্লে¬খিত মতানৈক্যগুলি জারি থাকিলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কতখানি মৌলিক পরিবর্তন আসিবে, তাহা সামনের দিনগুলিতেই দেখিবার বিষয় বৈকি।