
বাংলাদেশে মানুষের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসিয়াছে। পূর্বের অনেক অপ্রাপ্তি ও বিপর্যয় এবং প্রতিকূলতা এখন ক্রমহরাসমান। শহর কিংবা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিগত কয়েক বত্সরের উন্নয়ন লক্ষ্য করিবার মত। মানুষের গড় আয় যেমন বাড়িয়াছে, তেমনি অঞ্চল ও শ্রেণিভেদে বৈষম্যের মাত্রাও হরাস পাইয়াছে। রাষ্ট্রের কাজই সমাজের সর্বক্ষেত্রে নানামাত্রিক অসাম্য দূর করা, নাগরিকের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই ক্ষেত্রে অতীতে যাহাই হউক না কেন, সামপ্রতিককালের অর্জন বেশ উত্সাহব্যঞ্জক। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বাত্সরিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অগ্রগতির সেই চিত্রটিই ফুটিয়া উঠিয়াছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল যে অল্প কয়টি দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অর্জনের জন্য সংস্থাটির বিশেষ গুরুত্বের তালিকায় স্থান পায়, বাংলাদেশ তার অন্যতম। মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি রাষ্ট্রেরও অবস্থান বাংলাদেশের কাছাকাছি। তালিকায় ভারত ও ভুটানের অবস্থান আগের জায়গাতে স্থির থাকিলেও এই বত্সর একধাপ আগাইয়াছে বাংলাদেশ, যাহা অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক বিষয়। এইবারের প্রতিবেদনের অন্যতম দিক হইলো, নানান ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যকার বিদ্যমান অসমতা বাংলাদেশ বহুলাংশে কাটাইয়া উঠিয়াছে। অথচ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এটি একটি সাধারণ সমস্যা। বাংলাদেশের অর্জন এইক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি বড় ব্যতিক্রম। বলাবাহুল্য, মোট জনসংখ্যার অর্ধেক যেইখানে নারী, দেশের সকল কর্মকাণ্ডে তাহাদের প্রকৃত অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকিলে সত্যিকার উন্নয়নও সম্ভব নহে। সুখকর ব্যাপার হইলো, যেকোনো ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ এবং আত্মনির্ভরশীলতার হার আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি-কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চাইতেও অধিক। ইহাছাড়া নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং স্বাস্থ্যসেবার কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বিগত কয়েক বত্সরে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বে দৃষ্টান্তস্বরূপ। দৈনিক ইত্তেফাকের একাধিক প্রতিবেদনে দেশব্যাপী নূতন অসংখ্য উদ্যোগের কথা উঠিয়া আসিয়াছে। মানুষের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকার যে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছিল তাহা বেশ ফলদায়ক হইয়াছে বলিয়াই প্রতীয়মান হয়। বেসরকারি সংস্থাসমূহের অবদানও অনস্বীকার্য। তবে দেশের মানব উন্নয়নের পথে কিছু প্রতিবন্ধকতা রহিয়াছে, সেগুলি দূর করা সহজসাধ্য নহে। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য অসংখ্য চ্যালেঞ্জ রহিয়াছে । কিন্তু সঠিক কর্মপরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথার্থতা, সর্বোপরি দেশপ্রেম ও দূরদর্শী নেতৃত্বেই কেবল সেগুলি অতিক্রম করা সম্ভব। গত বত্সরে রাজনৈতিক নানান দ্বৈরথ এদেশে যেভাবে হানা দিয়াছিল তাহার পরও উন্নয়ন ধারা যে থামিয়া যায় নাই, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন শীর্ষক এই প্রতিবেদনটিই তাহার প্রমাণ। মানব উন্নয়নের যে ধারা চলিতেছে তাহাকে কোনমতেই থামিতে দেওয়া যাইবে না। স্বীকৃতির প্রয়োজন রহিয়াছে, কিন্তু কেবল আত্মতুষ্টিতে মগ্ন থাকিলে অর্জিত সাফল্যও হারাইয়া যাইতে পারে। উন্নয়ন অব্যাহত রাখিতে হইলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং যথাসময়ে তাহার বাস্তবায়ন। যে সকল ক্ষেত্রে অবস্থার উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য নহে সেসব ক্ষেত্রে যেমন ফলদায়ী পদক্ষেপ লইতে হইবে তেমনি যে যে ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সম্ভব হইয়াছে সেই ধারা অব্যাহত রাখিতে হইলে প্রয়োজন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন। দেশের যে সামর্থ্য রহিয়াছে, তাহা যদি পূর্ণমাত্রায় নিয়োজিত হয়, তাহা হইলে দ্রুতই একটি দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়িয়া তোলা অসম্ভব কোন ব্যাপার নহে। নাগরিকের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আত্মোন্নয়নের লক্ষ্যে নাগরিক প্রয়াসও তেমনি অত্যন্ত কার্যকর। সকলের তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। উন্নয়ন সূচকের অন্য সবগুলিতেই বাংলাদেশের উত্তরোত্তর অগ্রগতি কাম্য।