মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে পৃথক তিনটি যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধসহস্র মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু যুগপত্ শোকাভিভূত ও উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছে বিশ্ববাসীকে। একজন বেসামরিক বিমান চালনা বিশেষজ্ঞ সমপ্রতি মন্তব্য করিয়াছেন যে, তিনি এমন একটি সপ্তাহ ইতিপূর্বে আর দেখেন নাই। বাস্তবিকই গত কয়েকদিনে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহা নজিরবিহীন শুধু নহে, অবিশ্বাস্যও বটে। বিপর্যয়ের সূচনা হইয়াছিল গত মার্চে দুই শতাধিক যাত্রী লইয়া মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার মধ্য দিয়া, আর ১১৬ জন যাত্রীসমেত আলজিরীয় উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার মধ্য দিয়া। সর্বশেষ শোকাবহ ঘটনাটি ঘটিয়াছে গত বৃহস্পতিবার। স্মর্তব্য যে, ঠিক এক সপ্তাহ আগে, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রায় তিনশত যাত্রীসহ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ এমএইচ১৭ বিধ্বস্ত হইয়াছিল গত ১৭ জুলাই। সেই বিপর্যয় কাটাইয়া উঠিবার আগেই মাত্র পাঁচদিনের ব্যবধানে গত বুধবার তাইওয়ানে বিধ্বস্ত হইয়াছে ট্রান্স-এশিয়া এয়ারওয়েজের অপর একটি উড়োজাহাজ। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাইয়াছে প্রায় অর্ধশত যাত্রী। মাত্র একদিনের ব্যবধানে পর পর সংঘটিত শেষোক্ত দুইটি দুর্ঘটনার জন্য প্রতিকূল আবহাওয়াকে দায়ী করা হইলেও মার্চে নিখোঁজ হওয়া মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটির কোনো হদিস মিলে নাই অদ্যাবধি। অন্যদিকে ইউক্রেনের আকাশসীমায় সংঘটিত অপরাধের জন্য পরস্পরকে দোষারোপের খেলা এখনও অব্যাহত আছে। কিন্তু ঘৃণ্য এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দূরে থাক, চিহ্নিত করাও সম্ভব হয় নাই এই পর্যন্ত। সব মিলাইয়া, সৃষ্টি হইয়াছে শোক ও আতঙ্কের এক অভাবিত পরিস্থিতি—যাহা মোটেও অভিপ্রেত নহে।
দুর্ঘটনার উপর কাহারো হাত নাই। একের পর এক ঘটিয়া যাওয়া ঘটনাগুলিকে নিছক দুর্ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করা গেলে কিছুটা সান্ত্বনা হয়তো পাওয়া যাইত। কিন্তু ইতোমধ্যে যেইসব প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে তাহাতে সেই অবকাশও সংকুচিত হইয়া পড়িয়াছে। প্রশ্ন অনেক। সবকিছুকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে বিমানযাত্রীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। সমগ্র আকাশসীমাই মানুষের নখদর্পণে চলিয়া আসিয়াছে—নিখোঁজ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বিমানটি এই বদ্ধমূল ধারণাকে ইতোমধ্যেই গুরুতর প্রশ্নের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে। সেইসাথে যাত্রীবাহী বেসামরিক বিমানের উপর অকারণে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা জানাইয়া দিল যে, বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্র যত বিস্তৃত হইতেছে—আকাশপথও তত অনিরাপদ হইয়া উঠিতেছে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, যাত্রীবাহী বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিমান চালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা ও যোগ্যতা লইয়াও। বিশেষ করিয়া ভাড়া করা বিমানের ক্ষেত্রে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির ব্যাপারে উদাসীনতার বিষয়টি নূতন নহে। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ যে সবই জানেন তাহাতেও সন্দেহ নাই। উন্নয়নশীল বিশ্বের বহু দেশের নিকট জাতীয় পতাকাবাহী নিজস্ব বিমান বহর পরিচালনা মর্যাদা বা আত্মশ্লাঘার বিষয় হইলেও তাহা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য তাহাদের আছে কিনা—সেই প্রশ্ন এড়াইয়া যাওয়া কঠিন। প্রশ্নগুলি পুরাতন। তবে আকাশপথে একের পর এক বিপর্যয় সেই প্রশ্নগুলিকে নূতন করিয়া সামনে আনিয়াছে মাত্র। কিছুটা স্বস্তির বিষয় হইল, ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশনও (আইএটিএ) বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সহিত গ্রহণ করিয়াছে। অতিক্রান্ত সপ্তাহটিকে 'কালো সপ্তাহ' অভিহিত করিয়া সংস্থাটি বলিয়াছে যে, আকাশপথে চলাচলকারী উড়োজাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে 'কোনো ধরনের চেষ্টাই বাদ রাখা হইবে না'। উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী বাস্তবেও তাহার যথাযথ প্রতিফলন দেখিবার জন্য উন্মুখ হইয়া আছে।