ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সকাল দশটায় আমি মিঠু আর আলী ইমাম ভাই হাজির হলাম কলকাতার বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই বিখ্যাত বাড়িতে। বেম বড়সড় প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি ভেঙে পায়ে পায়ে পৌঁছুলাম দোতলায়। দরজায় কড়া (কলিং বেল) টিপলাম। যিনি দরজা খুলেছেন তিনি এত লম্বা যে আমাদের তিনজনকেই ঘাড় পেছন দিকে বাঁকিয়ে প্রায় আকাশ দেখার মতো করে উঁচুতে তাকাতে হলো। আরে অই তো! গুরু স্বয়ং দরজা খুলেছেন! আমরা কিছু বলার আগেই অসাধারণ গমগমে ভরাট কণ্ঠে বললেন তিনি, 'বাংলাদেশ থেকে?'
আমরা যৌথ কণ্ঠে, 'জি' বলতেই 'পাঁচ মিনিট কিন্তু' বলতে বলতে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। সেই বিখ্যাত কক্ষে। এই কক্ষের ছবি কত দেখেছি! এখানে বসে সত্যজিত্ রায় কত ইন্টারভিউ দিয়েছেন! এই তো যে চেয়ারটায় তিনি বসেছেন সেই চেয়ারে বসা ছবিও তো কম দেখিনি। ওই যে পেছনে বড় জানালা। জানালার বাইরে গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি। চারদিকে চোখ বুলিয়ে প্রশান্তিতে ভরে গেল মন। এখানে ওখানে এত এত বই। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে অপূর্ব লাগছিল তাঁকে। আমাদের শৈশব-কৈশোরের হিরো সত্যজিত্ রায়। আমাদের জীবনকে রংয়ের রেখায় ছন্দে ছবিতে ভরিয়ে দিয়েছেন এই মানুষটি।
দীর্ঘদেহী সত্যজিত্ রায়কে ছুঁয়ে দেওয়া যায় এমন দূরত্বে বসে আছি আমরা তিনজন। মিঠু আর আলী ইমাম ভাই বসেছেন সত্যজিতের সামনের ডান দিকের সোফায়। আমি বাম দিকে। সত্যজিত্ আমাদের মধ্যিখানে। সামনের টেবিলের উপর লম্বা পা দুটি ঠেকিয়ে দিয়ে বসেছেন তিনি। দুই হাঁটুর ওপর একটা ইজেল টাইপের কাঠের স্ট্যান্ডে উপর নিটে দুটো বোর্ড। নিচের বোর্ডটার উপরে সাদা ফুলস্কেপ কাগজের তিন চারটা পাতা আড়াআড়ি করে রেখে খসখস করে লিখচেন কী যেন। লিখছেন আর আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। একজন মানুষ একইসঙ্গে দুটি বিসয়ে মনোযোগ দেন কী করে? আমার সন্দেহ হলো, তিনি আমাদের কথা শুনছেন না। ওদিকে আলী ইমাম ভাই চমত্কার বিশুদ্ধ উচ্চারণে গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন তাঁর মুগ্ধতার কথা। মসুয়া গ্রামের কথা। আমাদের দুজনার সাম্প্রতিক পরিকল্পনার কথা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ আরও বিশিষ্ট বাঙালির সঙ্গে। ঢাকার সেই সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তৃতায় সত্যজিত্ পুরোনো ঢাকার বাঁদরের উত্পাতের কথা বলেছিলেন। আলী ইমাম ভাইয়ের চলমান কথার মাঝখানে ইচ্ছে করেই আমি ইনসার্ট বসালাম, 'কী লিখেছেন আপনি?'
ধরেই নিয়েছিলাম যে সত্যজিত্ রায় আমাদের কথা কানেই নিচ্ছেন না কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সত্যজিত্ রায় উত্তর দিলেন গমগমে কণ্ঠে, 'গুপি বাঘা ফিরে এল' ছবির গানের নোটেশন লিখছি। একটু দেখি? ইচ্ছে হলে দেখতে পার।
আমি আর আলী ইমাম তড়াক করে উঠে পড়লাম। দুদিক থেকে দুজনে তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সত্যজিতের হাতের লেখা আমাদের কাছে এতটাই প্রিয় আর পরিচিত যে আমরা সেই চেনা হস্তাক্ষরের লেখা গান এবং গানের নোটেশন তৈরি হবার ঘটনা চাক্ষুষ করে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ফিরে এসে বসলাম যার যার আসনে। আমাদের বিস্মিত করে সত্যজিত্ জানতে চাইলেন আলী ইমামের কাছে, পুরোনো ঢাকার বাঁদর প্রসঙ্গে বলছিলে...
আমরা দুজনেই বুঝে গেলাম ভয়াবহ রকমের কঠিন জিনিস সতহ্যজিত্ রায়। তার মানে গানের নোটেশন রচনার সময় প্রতিটা মুহূর্ত তিনি আমাদেরও খেয়াল করেছেন!