
আধুনিক ধর্মীয় উত্সবের নিরিখে ঈদুল ফিতর সর্বশ্রেষ্ঠ উত্সব হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছেও ঈদুল ফিতর বিভিন্ন আঙ্গিকে আবির্ভূত হয়েছে। ঈদ এখন শুধু ধর্মীয় উত্সবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ উত্সব এখন ধর্মীয় সীমা ছাড়িয়ে ব্যাপক কলেবরে সামাজিক-অর্থনৈতিক আনন্দানুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডে রূপ নিয়েছে। অথচ কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের ঈদের উত্সব এত বৈচিত্র্যে সমাদৃত ছিল না। সময়ের পরিক্রমায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঈদ উত্সব আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে প্রায় এক হাজার বছর আগে এ দেশে ইসলাম প্রচার শুরু হলেও প্রাচীনকালের ঈদ উত্সবের ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। সুলতানি থেকে মোগল আমল পর্যন্ত ঈদের উত্সব ও আনন্দানুষ্ঠান রাজদরবার ও অভিজাত মুসলিম শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ কৃষক মুসলমানরা অভিজাত মুসলিম শাসকদের দ্বারা হিন্দু কৃষকের মতোই শোষিত হতো। মোগল আমলের নির্মিত কিছু ঈদগাহ নির্মাণের ভেতর ঈদের নামাজ ও উত্সব পালনের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। রফিকুল ইসলামের ‘ঢাকার কথা’ গ্রন্থের বিবরণে পাওয়া যায় যে তত্কালীন বাংলার সুবেদারদের নেতৃত্বে ঈদের আনন্দমিছিল হতো। সেখানে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসনামলেও এ চিত্রের তেমন পরিবর্তন হয়নি। মূলত ঈদের আনন্দ ও উত্সব ওপরতলার শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ঈদ উত্সব সামাজিক উত্সবে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। কবি সুফিয়া কামালের আত্মজীবনীতে ঈদ উত্সবের বর্ণনা যেভাবে বর্ণিত হয়েছে :রোজার শুরুতে ঘরে ঘরে হাতে বানানো সেমাই আর বাচ্চাদের জন্য নতুন পোশাক তৈরির কাজ শুরু হতো। আর এই কাজের আনন্দের ভাগটা শিশু আর কিশোররাই উপভোগ করত। কোনো কোনো মহিলা নতুন কাপড় পরিধান করতেন; কিন্তু বয়স্ক পুরুষদের নতুন কাপড় পরিধানের প্রচলন তখন পর্যন্ত অনুপস্থিত ছিল। ঈদের দিন সকালে পুরুষরা গোসল করে মুখে খুরমা দিয়ে ঈদের নামাজে যেতেন এবং নামাজ শেষে ঘরে ফিরে সেমাই ও পোলাও-গোশত খাওয়ার ভেতরই ঈদ উত্সব শেষ হতো। বাচ্চা মেয়েরা বাড়ির ভেতরই নতুন কাপড় পরে ঘুরে বেড়াত। কবি সুফিয়া কামাল যে বাঙালি মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এতে সে শ্রেণির বর্ণনাই প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে সাধারণ কৃষক পরিবার কিংবা সাধারণ পরিবারগুলোর ঈদ উত্সবের কথা আসেনি। তারই সমসাময়িক সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দিনের ‘আত্মস্মৃতি’র গ্রন্থে কিশোর বয়সের ঈদুল ফিতরের যে বর্ণনা করেন, তাতে উল্লেখ আছে, ঈদুল ফিতরের সময় যেহেতু গরু কোরবানি হতো না, তাই হিন্দু ধর্মের লোকেরাও মুসলমানদের বাড়িতে আপ্যায়িত হতো। তারা বাড়ি এসে ফিরনি ও পোলাও-কোরমার স্বাদ গ্রহণ করত। তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। তখন পর্যন্ত গোঁড়া হিন্দুদের ধর্ম ছিল মুসলিম পরিবারে আহার গ্রহণ করা প্রকারান্তরে ধর্মবিচ্যুতিরই নামান্তর। অন্যদিকে কামরুদ্দীন আহমদের ‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের আত্মপ্রকাশ’ গ্রন্থে প্রকাশ পায়, সেই সময় বরং মুসলমানরা হিন্দুদের পূজা-পার্বণে, বিশেষ করে জমিদারবাড়িতে উপস্থিত হতো। ইউরোপের শিক্ষার প্রভাবে হিন্দু-
মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন থাকে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক পর্যন্ত। কামরুদ্দীন আহমদ ও আবু জাফর শামসুদ্দীনের এক দশকের বেশি কনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী (বাঙালনামা) লিখেছেন তাঁর কিশোর সময়ের কথা। মুসলমান বন্ধুদের বাড়িতে ঈদের নেমন্তন্ন বাঁধা ছিল। তখন বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাড়িতে গোমাংস ঢুকত না। ওটা প্রধানত দরিদ্র মুসলমান বাড়িতে চালু ছিল। কচিত্ কখনো বাড়িতে গোমাংসের রান্না হলেও ছেলেদের ওপর কড়া আদেশ থাকত, তা যেন হিন্দু বন্ধুদের না দেওয়া হয়। অবশ্য তপন রায় চৌধুরী তাঁর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য গোমাংসের স্বাদ নিতে গিয়ে বন্ধুর পিতার কাছে ভর্ত্সনা পেয়েছেন আর বন্ধু পেয়েছেন ‘ঠেঙ্গানি’।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে দুর্গা পূজার ছুটিতে হিন্দু জমিদার ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার যে প্রচলন শুরু করেছিল, সে রেওয়াজ কিন্তু ঈদের সময় মুসলমান বিত্তশালী কিংবা চাকরিজীবীদের বেলায় প্রচলিত ছিল না। গ্রামে ঈদ একেবারেই ধর্মীয় উত্সবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ চিত্রটা শুধু তত্কালীন পূর্ব বাংলায়ই নয়, পশ্চিম বাংলার গ্রামেও ছিল। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ ছেলেবেলার স্মৃতিতেও বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের একই চিত্র পাওয়া যায়। মুসলমানপাড়ায় ঠাণ্ডা পরব হচ্ছে ঈদ, বকরি ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর—এইসব। খুব ঠাণ্ডা, হই-হুল্লোড় নেই, হুটোপুটি নেই। সকালে গোসল করা, আতর মাখা, লাল তুর্কি ফেজ টুপি পরা, তারপর নামাজ পড়া কখনো মসজিদে, কখনো মাঠে। ফিরে এসে সেমাই খাওয়া—ব্যস। দুপুরে একটু ভালো খাওয়া-দাওয়া। দেশ ভাগের আগে ঢাকা ছিল নেহাত একটি জেলা শহর। তবে বাণিজ্যিক কারণে এবং মোগল আমলের রাজধানী ও বঙ্গভঙ্গের কারণে ঢাকা কিছুদিনের রাজধানী হওয়ার সুবাদে কিছুটা ভিন্ন রকমের গুরুত্ব বহন করত। নাজির হোসেন ও নাট্যকার সাঈদ আহম্মেদের ঢাকার স্মৃতিকথায় যে চিত্রটি পাওয়া যায় তা হলো—ঢাকার নবাবদের ঈদ উদ্যাপন কিছুটা ভিন্নতর আনন্দ দিত ঢাকাবাসীকে। বিশেষ করে ঈদের আনন্দমিছিল আর মোরগ লড়াই ছিল বিশেষ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান (event)। বৃহত্তর বাংলার রাজধানী কলকাতায় কিছুটা ভিন্ন ধরনের ঈদের আনন্দ উত্সব পালিত হতো। তবে সেটা মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিকভাবে বলা যায়, ঢাকার কিছু অংশ ছাড়া সারা বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে একেবারেই সাদামাটাভাবে ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হতো।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বকীয়তা খুঁজতে থাকে। সেবন্তী ঘোষ সম্পাদিত দেশ ভাগ গ্রন্থে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেন—‘স্বীকার করার উপায় নেই যে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্তের বিকাশের একটা অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যে এই মধ্যবিত্ত একদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্দীপিত হয়, অন্যদিকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির তীব্র অনুরাগীরূপে আত্মপ্রকাশ করে।’ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির স্বপ্ন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভেতর দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ভঙ্গ হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রণী ভূমিকা রাখে। মধ্যবিত্তের ব্যাপক অংশগ্রহণের দ্বার উন্মোচিত হয়। সেই প্রেক্ষাপটের ধারাবাহিকতায় ঈদের মতো ধর্মীয় উত্সবও সংস্কৃতির উত্সবে পরিণত হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবীর উত্থানের সূচনা (বঙ্গভঙ্গের অব্যাবহিত পরে) হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে। এর ওপর ভিত্তি করে দৃঢ়ভাবে গ্রথিত হতে থাকে এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃশ্যমান প্রকাশ ঘটে। বিগত শতাব্দীর ৬০ দশকে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এগিয়ে যায়।
পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি মুসলমানদের ভেতর বাঙালিত্ব ও মুসলমানত্ব দুটো ধারার সংমিশ্রণে সংস্কৃতির ধারায় যে যাত্রা শুরু করে, সে ধারার ভেতর মধ্যবিত্তের মধ্যে ঈদ আনন্দের নতুন নতুন অভিধা খোঁজা শুরু হয়। নতুন পোশাকের সমারোহ আর কিছু নতুন মোগল খাবারের সঙ্গে পাশ্চাত্য ও চৈনিক খাবারের সংযোগ ঘটে। ঈদকে সামনে রেখে বাণিজ্য সবে শুরু হয় ঢাকার কিছু কিছু বাজারে। একসময়কার গুলিস্তান, সদরঘাট, চকবাজারের চৌহদ্দি পেরিয়ে সদ্য নির্মিত নিউ মার্কেট আর এলিফেন্ট রোডের কিছু অংশজুড়ে দোকানই ছিল ঈদের কেনাকাটার প্রাণকেন্দ্র। ৬০-এর দশকের শুরুতে ঈদ উত্সবের যে ঢাকাকেন্দ্রিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার প্রভাব কিছুটা মফস্বল শহরে পৌঁছতে শুরু করে। ঈদের নতুন নতুন পোশাকের সঙ্গে কিছু উপাদেয় খাদ্যের সংযোজন হয় ঈদ আনন্দের সীমাবদ্ধ কাঠামোয়। ঈদকে সামনে রেখে ‘বেগম পত্রিকা’ ঈদ সংখ্যার সূচনা করে ৫০ দশকের শেষে। এরপর চিত্রালী, চিত্রবাণীর মতো পত্রিকায় কিছু লেখা ছাপা হতো। আর ঈদ উপলক্ষে সিনেমা প্রদর্শনের জন্য হলগুলোতে মুক্তি পেত নতুন নতুন ছবি।
পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর সড়কপথে যোগাযোগব্যবস্থা বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন জেলা শহরের সঙ্গে ঢাকার সড়কপথের যোগাযোগের ব্যবস্থা মাত্র সূচনা হয়। গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ সহজ ছিল না বলে ঈদের ছুটিতে এখনকার মতো ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যেত না। সে সময় হাতেগোনা কয়েকটি বাঙালি ধনী পরিবার ও সদ্য উঠতি কিছু বাঙালি ব্যবসায়ী ও উচ্চপদে আসীন চাকরিজীবীদের মধ্যেই জাকাত দেওয়ার সুযোগ থাকত। শহরের মধ্যবিত্ত বেশির ভাগ মানুষই গ্রামের দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের মধ্যে জাকাতের কাপড় বণ্টন করার জন্য গ্রামে যেতেন কিংবা কারো মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতেন। অন্যদিকে বড় বড় শহরের সে সময় অবাঙালি ব্যবসায়ীরাই মূলত জাকাতের কাপড় দরিদ্র মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। জাকাতের কাপড় মানেই নিম্নমানের কাপড়, নুিমানের কাপড়ই ‘জাকাতের কাপড়’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ৬০ দশকে। জাকাতের টাকায় ভালো কাপড় না দেওয়ার মানসিকতা বিত্তশালীদের মধ্যে কেমন করে গড়ে উঠল, তার ইতিহাস আজও অজানা। এখনো জাকাতের কাপড় মানে নুিমানের কাপড় হিসেবে পরিচিতি অব্যাহত আছে। বড় বড় দোকানের এক কোণে লেখা থাকে, এখানে ন্যায্যমূল্যের জাকাতের কাপড় পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ভূমিকা রাখেনি। আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক পরিবর্তনের ধারার সূচনা করে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের আবাসভূমি হলেও বিশ্বে একমাত্র অসাম্প্রদায়িক বাঙালি রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় বাংলাদেশ। ’৭৫-পূর্ব পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শ পরিবর্তিত হয়ে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের পাশাপাশি দুই দশকের মধ্যে উচ্চবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। সাধারণ পরিবারের সন্তানও রাতারাতি বিশাল ধনসম্পত্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্সের পাশাপাশি গার্মেন্টশিল্পের বিকাশ ও অন্যান্য শিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঢাকার সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে এবং একই সময়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমান্তরালভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, এখন বাংলাদেশের প্রায় গ্রামেরই কেউ না কেউ রাজধানী ঢাকায় এবং বিদেশে অবস্থান করছে। ফলে অর্থনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যোগাযোগও বৃদ্ধি পায়। দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বিদেশি সংস্কৃতির অবিরাম মিথস্ক্রিয়ার ফলে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ধারায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার করছে এ দেশে।
ঈদের আগে রোজার সময় তত্কালীন পাকিস্তানে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের ইফতার পার্টির আয়োজন শুরু হয়। এখন ঈদের আনন্দ উত্সবের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল, সামাজিক দলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রোজা উপলক্ষে ইফতার পার্টির আয়োজন করে। বিভিন্ন রেস্তোরাঁও ইফতার পার্টির নানা চমকপ্রদ আয়োজন
করে। শুধু শহরেই এই ইফতার পার্টির সীমাবদ্ধতা নেই। গ্রামগঞ্জেও এই ইফতার পার্টির আয়োজনের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। একইভাবে ঈদোত্তর ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজনও সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম ঈদ উত্সবের পোশাকের ডিজাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’। এখন শুধু ঈদ নয়, পূজা, পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে পোশাকের নকশার প্রতিযোগিতার আয়োজন চলে। একসময় বিদেশি পোশাক বাজারের বিরাট স্থান দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যেই দেশীয় পোশাক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করে বাজার দখল করে নেয়। কয়েক দশক আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, পাঞ্জাবির মতো পোশাকে এমন কারুকার্যময় বাহারি নকশার বিরাট আবির্ভাব ঘটবে ঈদ আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আড়ং’ এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হলেও পরবর্তী সময়ে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দেশি ফ্যাশনের প্রভাব। পুঁজিবাদীব্যবস্থার সব পণ্যের ঈদ বাণিজ্যিকীকরণের বলয়ে প্রবেশ করে। ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা মাত্রা যোগ হতে শুরু করে ঈদ উত্সবকে কেন্দ্র করে। পুরুষদের পোশাকের পাশাপাশি মহিলাদের পোশাক, গয়না, সেন্ডেল, জুতাসহ এমন কোনো উপাদান নেই, যা ঈদ বাজারে আসছে না। পোশাক, গয়না, পাদুকা, প্রসাধনী সামগ্রীর পাশাপাশি খাদ্য তালিকায় সংযোজিত হচ্ছে নতুন নতুন উপাদান। দেশীয় খাদ্যের পাশাপাশি বিদেশি খাদ্যের সংযোজন হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে তারকাবিশিষ্ট রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি বিভিন্ন রেস্তোরাঁও দিচ্ছে নানা রকমের আয়োজন। যদিও উচ্চবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্তকে কেন্দ্র করে। খাদ্য উত্পাদকরা নতুন নতুন পণ্য ঈদ উপলক্ষে বাজারে ছাড়ছে, যা শহর ছেড়ে গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে ভোক্তার জন্য রয়েছে বিরাট বাজার। তৈজসপত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন, মোবাইল এমনকি অ্যাপার্টমেন্টের মতো মূল্যবান উপহারও ঈদ উপলক্ষে বাজারে আসছে। ভোগ্য জীবনের পাশাপাশি মনোজগত্সহ বিনোদনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে বিরাট পরিবর্তন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাপ্তাহিকীর বিশেষ ঈদ সংখ্যা আরেক অধ্যায়। কেবল মান নয়, সংখ্যার বিবেচনায় বিপুলসংখ্যক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস প্রতিবছর সংযোজিত হচ্ছে বাংলা সাহিত্যে। ঈদকে সামনে রেখে বিগত শতাব্দীর বিশেষ করে কবিরা অনেক কবিতা লিখেছেন। তবে কবি নজরুলের ‘রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ গানটি আজও ভীষণ জনপ্রিয়। একভাবে বলা যায়, এ গানটি যেন ঈদের জাতীয় সংগীত হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। একইভাবে নতুন নতুন চলচ্চিত্র, সংগীত, মিউজিক ভিডিওসহ নানা রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় ঈদ উপলক্ষে। সম্প্রতি টেলিভিশনের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে ঈদ উপলক্ষে নানা রকম অনুষ্ঠান আর নাটকের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঈদের নাটক আর বিনোদনের দু-একটা অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন শুধু সপ্তাহব্যাপী নয়, কোনো কোনো চ্যানেল পক্ষকালব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে।
একসময় শুধু গরিব আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্র মানুষকে জাকাতের কাপড় বিলি-বণ্টনের পরিসীমার উত্তরণ ঘটিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোন ও নিকটাত্মীয়দের উপহারসামগ্রী দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। এখন সেটা বন্ধুবান্ধব, কার্যালয়ের সহকর্মী, ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের উপহার প্রদানের রেওয়াজ যেমন শুরু হয়, তেমনি ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের প্রিয় কর্মচারীদের ঈদের উপহার দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। ঠিক তেমনি ঈদ উপলক্ষে একসময় ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের রেওয়াজ শুরু হয়। কিন্তু সে রেওয়াজ এখন সেলফোন, ফেসবুক, ই-মেইলের বদলৌতে ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে। এখন মেসেজের মাধ্যমেই ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।
শুধু টেলি বিনোদন নয়, ইদানীং ঈদের ছুটি উপলক্ষে মানুষ গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে, তেমন বিপুলসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতে ও রিসোর্ট সেন্টারে অবসর বিনোদন উপভোগ করতে যাচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন রিসোর্ট সেন্টার বিভিন্ন ছাড় দিয়ে গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। মূলত ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার অধিবাসীদের মধ্য থেকেও বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে যাচ্ছে। যাদের অবস্থা বেশি ভালো, তাদের কেউ পাশের দেশ ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে বের হচ্ছে। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, ঈদ বা পার্বণ উপলক্ষে এমনভাবে শহর খালি করে যাওয়ার ঐতিহ্য তৈরি করতে পেরেছে।
ঈদ উপলক্ষে বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিশাল অঙ্কের টাকা লেনদেন হতে শুরু করেছে। এই অর্থনৈতিক লেনদেনের ফলে ভোক্তাবাজার সব শ্রেণির মানুষকে নাড়া দিয়েছে। গ্রাম থেকে শহর—সর্বত্রই ঈদ বাজারের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কোনো না কোনোভাবে এই বিশাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে সমগ্র দেশ। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে বড়দিন উপলক্ষে যে আয়োজন চলছিল দীর্ঘ বছর যাবত্, তারই প্রতিফলন এখন বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে। ধর্মীয় উত্সব এখন সামাজিক উত্সবের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উত্সবে পরিণত হয়েছে। একসময় গরিব লোকেরা বলত—‘গরিবের আবার ঈদ’। এখন আর এ কথা শোনা যায় না বললেই চলে। সবাই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে চায়। শুধু মুসলমানরাই নয়, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ—সব ধর্মের লোকেরাই এ ধর্মীয় সামাজিক উত্সবে অংশগ্রহণ করছে। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উত্সবকে ঘিরে শুরু হওয়া উত্সব এখন বহুমাত্রিক উত্সবে পরিণত হয়েছে।
ঈদ ধর্মীয় আচার-বিশ্বাসকে ভিত্তি করে সাদামাটাভাবে উত্সব অনুষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল বটে; আজ তা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি ব্যাপক অর্থনৈতিক উদ্দীপনায় ছড়িয়ে গেছে বিত্তশালী থেকে আমজনতার ঘরে ঘরে। যে যেমন অবস্থায় থাকুন না কেন, অন্তত একটি দিনের আনন্দ সাধারণ মানুষও তাদের স্মৃতির সঞ্চয়ে রাখতে চায়। এই ধর্মীয় উত্সব সর্বজনীনতার উত্সবে বিস্তৃতি পাচ্ছে।