কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে ছয় দিনের সফরে সিলেট এসেছিলেন। সে সময়ই তিনি কোনো একদিন নিম্নোক্ত কবিতাটি রচনা করেছিলেন :
মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি।
ভারতী আপন পুণ্যহাতে
বাঙালীর হূদয়ের সাথে
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া।
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।
কোনো শুভানুধ্যায়ী-ভক্তের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে এ কবিতাটি রচনা করে থাকতে পারেন বলে গবেষকদের ধারণা। তবে যে কারণেই এ কবিতাটি রচিত হোক না কেন, এটি যে সিলেটের রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ এক কবির ভালোলাগা থেকে জন্ম হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কবিতাটির পঙিক্ততে পঙিক্ততে সিলেটের প্রতি কবির মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। কবি তাই সিলেটকে ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’তে ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। আগমনের ২২ বছর পর কবিগুরুর মৃত্যুর পরপরই সিলেটবাসী শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৪১ সালে কবি-প্রণাম নামে একটি স্মারক প্রকাশ করেছিলেন। সে স্মারকে প্রথমবারের মতো কবির স্বহস্তে লেখা কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছিল। এরপর থেকে নানাজনের লেখায় এ কবিতা আলোচিত হয়ে এলেও অদ্যাবধি রবীন্দ্র রচনাসমগ্রে স্থান পায়নি। কবির স্বহস্তে লেখা এ কবিতাটি কেন কিংবা কী কারণে সমগ্রে স্থান পায়নি তা রহস্যাবৃত্তই বলা চলে।
কবি-প্রণাম বেরিয়েছিল ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পর সিলেট শহরে বসবাসরত কবির অনুরাগী ও গুণগ্রাহীরা এ স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তত্কালীন সিলেটের জামতলা এলাকার ‘বাণীচক্র ভবন’ হতে নলিনীকুমার ভদ্র সংকলনটি প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এটি সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন নলিনীকুমার ভদ্র, অমিয়াংশু এন্দ, মৃণালকান্তি দাশ ও সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ। কবিগুরুর প্রয়াণের পর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ ছিল সম্ভবত এটিই প্রথম।
স্মারক গ্রন্থটির অন্যতম সম্পাদক নলিনীকুমার ভদ্র ‘অবতরণিকা’য় জানিয়েছিলেন, কবিপ্রণাম গ্রন্থে লেখার অনুরোধ জানিয়ে খ্যাতনামা লেখক ও রবীন্দ্র ঘনিষ্ঠদের কাছে চিঠি প্রেরণ করা হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত লেখা দিয়েই কবি-প্রণাম তৈরি হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন :
গত বৈশাখ মাসের শেষভাগে শ্রীহট্ট শহরে “বাণীচক্রে”র উদ্যোগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একাশীতিতম জন্ম-উত্সব সম্পন্ন হবার অব্যবহিত পরেই “বাণীচক্রে”র জন্যে কবিগুরুর আশীর্বাণী প্রার্থনা ক’রে আমি একখানা পত্র লিখি। সে-পত্রের উত্তরে শ্রীযুক্ত অনিলকুমার চন্দ মহাশয় আমাকে জানালেন যে, অসুস্থতা-নিবন্ধন কবিগুরুর কলম ধরাই বারণ, তবে তিনি সুস্থ হ’লে আমাদের আশা পূর্ণ হবে।
চন্দ মহাশয়ের চিঠি পাবার পর থেকেই ভাবছিলাম, কবি সেরে উঠলেই শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে আসবো।
শ্রাবণ মাসে শ্রীহট্টের পল্লী-অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় যখন দিন যাপন করছি তখন অকস্মাত্ একদিন এসে পৌঁছলো রবীন্দ্রনাথের লোকান্তর গমনের নিদারুণ দুঃসংবাদ। এ আঘাত যেমনি অপ্রত্যাশিত তেমনি মর্মান্তিক।
অবিলম্বে শ্রীহট্টে ফিরে এসে শোকসভার আয়োজন করলাম। মাত্র মাসকয়েক আগে আমরা যখন শহরের অন্যান্য রবীন্দ্রভক্তদের সঙ্গে একযোগে তাঁর জন্ম-উত্সব উদ্যাপন করি, তখন একান্ত মনে এই কামনাই তো করেছিলাম যে, শতায়ু হোন কবি, তাঁর লোকোত্তর প্রতিভার অজস্র অবদানে আমাদের সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ভাণ্ডার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধতর হোক। সেদিন কি ভাবতে পেরেছিলাম যে, এত শীঘ্র শোক-সভায় সমবেত হয়ে এমনিধারা অশ্রু-জলে কবিগুরুর স্মৃতি-তর্পণ করতে হবে!
কিছুদিন পরে বন্ধু শ্রীযুক্ত মৃণালকান্তি দাশ কবিগুরুর বরণীয় স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবার উদ্দেশ্য ‘বাণীচক্র’ থেকে বাংলা এবং শ্রীহট্টের খ্যাতিমান লেখকদের রচনা-সম্ভারে পূর্ণ একখানা পুস্তক প্রকাশের সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত করেন। ‘কবি-প্রণাম’ নামটিও তাঁরই নির্বাচিত। [...]
তিনি আরও লিখেছিলেন :
[...] সকলের সহযোগিতায় কবিগুরুকে সুদূর মফস্বল থেকে আমরা শুধু শ্রীহট্টেরই নয়, সমগ্র বাংলা দেশের মিলিত প্রণাম জানাতে সক্ষম হয়েছি।
[...] ‘কবি-প্রণামের’ পরিশিষ্টে শ্রীহট্টের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের কতকটা আভাস পাওয়া যাবে। শ্রীহট্টের অনেকেই তাঁর স্নেহভাজন হবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। বাইশ বছর আগে কবি একদা আমাদের শ্রীহট্ট শহরে এসে তিনটি দিন অবস্থান করেন। শ্রীহট্টবাসী নরনারী তখন অনুপ্রাণিত হয়েছিল তাঁর উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তৃতায়, মুগ্ধ হয়েছিল তারা তাঁর মধুক্ষরা কণ্ঠের সুললিত সঙ্গীতে। কবির জীবনী থেকে এ তিনটি দিনের কাহিনী নিঃশেষে মুছে গেলেও তাঁর গৌরবোজ্জ্বল মহিমা কিছুমাত্র ম্লান হবে না। কিন্তু এ কাহিনী বাদ দিয়ে যদি কোনোদিন শ্রীহট্টের ইতিহাস লেখা হয় তা হ’লে তা হবে অসম্পূর্ণ। অনাগত যুগে আমাদের ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা এ-কাহিনী প’ড়ে গর্ব অনুভব করবে,—যদিও ঈর্ষা করবে তারা আমাদের অপরিসীম সৌভাগ্যকে।
শ্রীহট্টের রবীন্দ্রভক্তদের অনুরাগকেই রূপায়িত করবার চেষ্টা করা হয়েছে ‘কবি-প্রণামে’। [...]
কবি-প্রণাম-এর অন্যতম সম্পাদক নলিনীকুমার ভদ্রের লেখার সূত্র ধরে বলা যেতে পারে, তত্কালীন শ্রীহট্ট, যা আজকের এই সিলেট—এখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে কবিগুরুর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে ‘ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা’ সত্যিকার অর্থেই শ্লাঘা অনুভব করবে এবং এটিই স্বাভাবিক। সংকলনে যাদের লেখা স্থান পেয়েছে তারা হচ্ছেন : প্রমথ চৌধুরী, সতীশচন্দ্র রায়, বুদ্ধদেব বসু, মৃণালকান্তি দাশ, জগদীশ ভট্টাচার্যত, ক্ষিতিমোহন সেন, শান্তিদেব ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, অমিয় চক্রবর্তী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীরচন্দ্র কর, লীলাময় রায়, রসময় দাশ, প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত, সাধনা কর, সুপ্রভা দেবী, গোপাল ভৌমিক ও নলিনীকুমার ভদ্র। এগুলোর মধ্যে নয়টি কবিতা এবং বাকিগুলো গদ্য। তবে ওই সংকলনে তিরিশের দশকের কবি তত্কালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক, খোদ রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রশংসিত সিলেটের বাসিন্দা অশোকবিজয় রাহার কোনো লেখা এতে স্থান না পাওয়াটা একটু রহস্যই বটে। তার লেখা সংকলনভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি সম্পাদনা পর্ষদের নিছক ভুল নাকি তাদেরই রাজনীতির অংশ—সামপ্রতিক সময়ে এ বিষয়টি একাধিক গবেষকের আলোচনায় উঠে এসেছে।
সংকলনে কবিগুরুর বেশকিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, স্বহস্তে লিখিত অপ্রকাশিত কবিতার পঙিক্ত, ঘনিষ্ঠজনদের কাছে লেখা চিঠি এবং সিলেটে প্রদত্ত কবিগুরুর দুটো অভিভাষণের সঙ্গে পরিশিষ্ট বিভাগে আরও পাঁচজনের লেখা মুদ্রিত হয়েছে। এরা হচ্ছেন : সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ, রাধানন্দ ভট্টাচার্য্য, সত্যভূষণ সেন, হেম চট্টোপাধ্যায় ও যোগেন্দ্রকুমার চৌধুরী। এ লেখাগুলোর প্রায় সব কটিতেই কবিগুরুকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করা হয়েছে। পাশাপাশি সংকলনের প্রকাশক ‘বাণীচক্র’-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সর্বশেষ তথ্য সন্নিবেশিত করে একটি লেখা ও কিছুসংখ্যক বিজ্ঞাপনও মুদ্রিত হয়েছিল। বিজ্ঞাপনগুলো পাঠে তখনকার সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাহিত্যচর্চা সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে দুটো অভিভাষণ সংকলনে স্থান পেয়েছে এর প্রথমটি ১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর তত্কালীন শ্রীহট্ট শহরের টাউনহল প্রাঙ্গণে কবিগুরুর বক্তৃতার অনুলিখিত রূপ। এটি ‘বাঙ্গালির সাধনা’ শিরোনাম দিয়ে যৌথভাবে অনুলিখন করেছেন উপেন্দ্রনারায়ণ সিংহ ও মনোরঞ্জন চৌধুরী। দ্বিতীয় বক্তৃতাটি ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৮ কার্তিক শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজ হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কবিগুরুর প্রদত্ত বক্তৃতা। এটি ‘আকাঙ্ক্ষা’ শিরোনামে যৌথভাবে অনুলিখন করেছেন উপেন্দ্রনারায়ণ সিংহ ও মনোরঞ্জন চৌধুরী। পরে এই বক্তৃতাটি রবীন্দ্রনাথ নিজে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘Towards the future’ নাম দিয়ে মডার্ণ রিভিয়ু পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন।
কবি-প্রণাম-এ সৈয়দ মুজতবা আলী তার ‘গুরুদেব’ লেখায় লিখেছিলেন, ‘[...] শ্রীহট্টবাসীরূপে আমার গর্ব এই যে বিশ্বভারতীর কলেজ বিভাগে আমিই প্রথম বাইরের ছাত্র। [...] রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখি ১৯১৯ সালে শ্রীহট্ট শহরে। পূজ্যপাদ গোবিন্দনারায়ণ সিংহের আমন্ত্রণে তিনি শ্রীহট্টের আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন।’
শ্রীনলিনীকুমার ভদ্র তার ‘যোগাযোগ’ লেখায় জানিয়েছিলেন, কবিগুরুর সঙ্গে সাক্ষাত্কালে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি তো সিলেট থেকে আসচ। চৌদ্দ পোনের বছর আগে যখন সিলেটে যাই তখন দেখেছিলাম মণিপুরী নাচ। সে নাচ আমার মনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সুদূর কল্পলোকে, মনে জেগেছিল নৃত্যনাট্যের পরিকল্পনা, সে যেন আমার মনকে পেয়ে বসেছিল। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের মণিপুরী নাচ শেখাবার উদ্দেশ্যে ১৩২৬ সন থেকে ১৩৩৬ সন এই দশ বছরের মধ্যে তিন তিনবারে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সবশুদ্ধ ছয়জন মণিপুরী নৃত্যশিক্ষককে আনিয়েছি শান্তিনিকেতনে। সমপ্রতি আছেন মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক নবকুমার। “নবরাজ” অভিনয়ে প্রথম সংযোজনা করলাম একটু অদলবদল করে মণিপুরী নাচ। মণিপুরী নৃত্যকেই ভিত্তি করে নাট্যগুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। নৃত্যনাট্যে যে বিশেষ রস-সৃষ্টি করতে চাই তার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে মণিপুরী নাচ।’
একই লেখায় লেখক প্রভাতরঞ্জন গুপ্তের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। প্রভাতরঞ্জন জানিয়েছিলেন : ‘১৩৪১ বাংলাতে গুরুদেব [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] একবার আমাকে সিলেটে পাঠিয়েছিলেন মণিপুরী নাচের শিক্ষক সংগ্রহ করতে। সিলেটে উপযুক্ত লোক না পেয়ে পরে আমি শিলচর থেকে রাজকুমার সেনারিস ও মহিম সিং নামক দুজন নাচিয়েকে নিয়ে যাই শান্তিনিকেতনে। রাজকুমার কিছুদিন পরেই চলে আসেন। তার জায়গায় “নীলেশ্বর” নামক সিলেটের আর একজন মণিপুরী নাচের শিক্ষক শান্তিনিকেতনে যান। এই নীলেশ্বর ও মহিম সিং বোধ হয় শান্তিনিকেতনে বছর দুয়েক মণিপুরী নাচ শিক্ষা দিয়েছেন।’ অন্যদিকে সিলেটে যেখানে মণিপুরী নৃত্য দেখে কবিগুরু মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই মাছিমপুর এলাকার বাসিন্দা শ্রীযুক্ত সমরেশ সিংহের বরাতে শ্রীনলিনীকুমার লিখেছিলেন, ‘মাছিমপুরের মণিপুরী বালক-বালিকাদের নৃত্য দেখেই শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য-শিক্ষক নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু মাছিমপুরের মণিপুরীরা শান্তিনিকেতনের মত দূরবর্তী স্থানে যেতে রাজি না হওয়ায় তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী মণিপুরীদের মধ্য থেকে শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষক নিয়েছিলেন।’
‘বাণীচক্রের কথা’ শিরোনামে লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়, বাণীচক্র প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বছরেই মহাসমারোহে কবিগুরুর ৮১তম জন্ম-উত্সব পালন করা হয়। এ উত্সবের মধ্য দিয়ে বিশ্বভারতীর সঙ্গে সিলেটবাসী তথা বাণীচক্রের কর্মীদের একটি ভালো যোগাযোগ স্থাপন হয় বলেও লেখায় উল্লেখিত রয়েছে। শ্রাবণ মাসে বাণীচক্রের সদস্যরা কবিগুরুর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর ১৮ আগস্ট কবিগুরু স্মরণে একটি শোকসভাও করেছে। একই বছর কবিগুরুর সাহিত্যের পঠন-পাঠন ও প্রচারের উদ্দেশে অমিয়াংশুকে সম্পাদক করে ‘রবিচক্র’ নামে একটি রবীন্দ্র-গ্রন্থাগার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। একই সংগঠন থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপ্রকাশিত চিঠি, কবিতা সংগ্রহের সিন্ধান্তও গ্রহণ করা হয়।
নলিনীকুমার ভদ্র আশা প্রকাশ করে লিখেছিলেন, ‘বাংলার প্রত্যন্ত প্রদেশের এই সাহিত্যিক আন্দোলনের বার্তা শ্রীভূমির প্রান্ত-সীমা অতিক্রম করে বাংলাদেশে গিয়ে পৌঁছেছে এবং এর প্রতি বাংলার সুধীসমাজের দৃষ্টি ও সহানুভূতি আকৃষ্ট হয়েছে।’ সিলেট সফরের পর নানা কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সিলেটের সুধীসমাজের একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখানকার সাহিত্য ও সংস্কৃতি-অনুরাগীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল অত্যন্ত গভীর। শ্রীহট্টবাসী অনেকের সঙ্গে কবিগুরুর চিঠিপত্রের আদান-প্রদানও ছিল উল্লেখ করার মতো। অবশ্য তত্কালে এ অঞ্চলে রবীন্দ্র-অনুরাগীদের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। ১৯১৯ সালে কবিগুরুর সিলেট আগমনের পর তাকে একনজর দেখতে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি সেটা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। এছাড়া কবিগুরু নিজেও সিলেটের রূপ—বৈচিত্র্যে মুগ্ধ ছিলেন।
রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল তার রবিজীবনী সপ্তম খণ্ড বইয়ে কবিগুরুর সিলেট সফর সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৭ কার্তিক [সোম ৩ নভেম্বর] আসাম-বেঙ্গল রেলপথে লামাডিং হয়ে রবীন্দ্রনাথ পুত্র ও পুত্রবধূ-সহ সিলেট রওনা হন। “শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ” প্রবন্ধের লেখক সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা করে আনার জন্য বদরপুরে যান। বদরপুর রেলওয়ে জংশনে তখন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মনোরঞ্জন চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী প্রাক্তন ছাত্রী ইন্দুমতী বাস করতেন। তাঁরা সকলে রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হন। কুলাউড়া জংশনে তাঁদের রাত্রিবাস করতে হল ট্রেনে। পরদিন [১৮ কার্তিক : ৪ নভেম্বর] সকালে সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার পর পথে মাইজগাঁও, বরমচাল, ফেঞ্চুগঞ্জ প্রভৃতি স্টেশনে ট্রেন থামলে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসে তাঁকে সংবর্ধিত করেন।’
তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘১৯ কার্তিক [বুধ ৪ নভেম্বর] প্রাতে সিলেট স্টেশনে রবীন্দ্রনাথ পদার্পণ করলে বাজি পুড়িয়ে ও সমবেত জনতার হর্ষধ্বনিতে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। তাঁকে অভ্যর্থনা করতে সিলেটের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। সুসজ্জিত বোটে রবীন্দ্রনাথ এবং বজরায় রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী সুরমা নদী পার হয়ে চাঁদনিঘাটে উপনীত হন। “চাঁদনিঘাট পত্র-পুষ্প-পতাকা মঙ্গলঘটে সুসজ্জিত, ঘাটের সবগুলো সিঁড়ি লাল শালুতে মোড়া”।’ ৮ নভেম্বর কবিগুরু আগরতলা পৌঁছার উদ্দেশে সিলেট ছাড়েন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট সফর তার কর্মবহুল জীবনযাপনের একটি সামান্যতম ঘটনা হলেও এটি এখন সিলেটবাসীর গর্ব করার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর চেয়ে বড় কথা হলো, এই সিলেট সফরে না এলে হয়তো কবির সৃষ্টিসম্ভারে স্থান পেত না ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে’ শীর্ষক কবিতাটি। রবীন্দ্র সৃষ্টিসম্ভারে কবির স্বহস্তে লেখা এ কবিতাটির ঐতিহাসিক আবেদন তাই যুগের পর যুগ ধরে অনন্য বিশিষ্টতায় উচ্চারিত হতেই থাকবে।