অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের কাঠমান্ডুর আকাশে বেশ ঝকঝকে রোদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত নেপালের এই রাজধানী শহরটি তুলনামূলকভাবে নেপালের সবচেয়ে ব্যস্ত শহর। অপেক্ষাকৃতভাবে সবচেয়ে বেশি জনবসতিও এখানে। আছে দোকানপাট, নাগরিক আবাসন। অবিন্যস্ত ও অগোছালো বেড়ে ওঠা এই রাজধানী শহরকেন্দ্র থেকে আমরা ছুটে চলেছি নেপালের অন্যতম পর্যটনপ্রিয় অঞ্চল পাতান দেখতে। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পাতানের অবস্থান। এক সময় তিনটি স্বাধীন নগরী থেকে তিনজন স্বাধীন রাজা নেপাল শাসন করতেন। এই রাজারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাজিয়েছিলেন তাদের প্রশাসনিক কেন্দ্রসমূহ। কাঠমান্ডু, পাতান আর ভক্তপুর— এই তিন অঞ্চলে ছিল তাদের তিন রাজার ভিন্ন ভিন্ন সাম্রাজ্য।
আজ পাতান দেখার জন্য আমার সঙ্গী হয়েছে তরুণ স্থপতি যুগল রাকিব আর মিশু। যেকোনো সঙ্গী ছাড়া আমার পক্ষে ঘুরে বেড়ানো প্রায় অসম্ভবই। কারণ, আমার সঙ্গে থাকবে অন্তত দুটো ক্যামেরা, ট্রাইপয়েড, আরো কিছু খুচরা জিনিসপত্র। পোখরা পর্যন্ত আমার সঙ্গী ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রিয়াদ। কিন্তু কাঠমান্ডু এসে তাকে খুব পাওয়া যাচ্ছে না। সে উঠেছে অন্য এক হোটেলে। তার সঙ্গে তার বন্ধুরা। সেমিনারেও তাকে খুব কাছে দেখি না। আমার ট্রাইপয়েড টানার ভয়ে কি সে আমার থেকে আড়াল থাকে! বুঝতে পারি না। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার খুব সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয় না। আজ সেমিনারের ব্রেকে রাকিবদের বলা মাত্রই রাজি করানো গেল। ক্যামেরা-ট্রাইপয়েড-হ্যাভারসেক রাকিবই নিচ্ছে। আমি অনেকটাই মুক্ত। আমরা যেখানে যাচ্ছি— এটা কাঠমান্ডুর অতি কাছে, এবং প্রায় সংলগ্নই। কিন্তু যেতে যেতেই ট্যাক্সিওয়ালা আমাদের বলে, কাঠমান্ডু জেলা ছাড়িয়ে আমরা এসেছি ললিতপুর জেলায়। এই ললিতপুরেই পাতান দরবার।
আমাদের পুরান ঢাকার মতো ঘিঞ্জি এলাকা দিয়ে কিছুদূর যাবার পরই যে জায়গাটিতে এসে নামলাম, বুঝতে বাকি থাকে না, এটাই সেই দরবার মহল।
পাতানে এটাই আমার প্রথম আসা নয়। ১৯৯৮ সালে একবার এসেছিলাম এখানে, সঙ্গে ছিল তৌকির। এবার সঙ্গী অপর দুই স্থপতি। সেবার লেখাপড়া না শেখা এক আধা ইংরেজি জানা কিশোর আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল পুরো চত্বর। ১৫ বছরের ব্যবধানে দেখি, এ জায়গাটির কোনোই পরিবর্তন নাই। ৪০০ বছর আগে যে চত্বর যেভাবে বানানো হয়েছিল, ১৫ বছরে তার পরিবর্তনই বা কেন চোখে পড়বে?
গেটের কাছে নেমেই আমি ক্যামেরা বসাই ট্রাইপয়েডের ওপর। আমার কাছে এক পৌঢ় এসে দাঁড়ায়। আধা ইংরেজি, আধা হিন্দি মিলিয়ে তিনি যা বললেন, তার মানে হচ্ছে তার নাম রামকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ। বিগত ১৮ বছর ধরে তিনি গাইডের কাজ করছেন। ইংরেজি, হিন্দি যেকোনো ভাষায়ই কথা বলতে পারবেন, দু ঘণ্টা সময় লাগবে তার এ জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে এবং এ জন্যে তাকে দিতে হবে ৫০০ নেপালি রুপি। দেখলাম, লোকটির কণ্ঠস্বর যথেষ্ট ভালো, যেটুকু ইংরেজি বলে, তাতে বোঝা যায় তিনি কী বলতে চেয়েছেন। আমি বললাম, রাজি। তবে একটা শর্ত আছে।
—কী সেটা?
—এই নিন আমার ভয়েস রেকর্ডার। এটা আপনার পকেটে ঢুকিয়ে রাখেন, আর এই মাইক্রোফোনে আপনি কলারের সাথে এভাবে ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখেন। আপনি যা বলছেন, সবই রেকর্ড হবে। আপনাকেও আমার ক্যামেরায় আমি ধারণ করব। এটা বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশনেও হয়তো দেখানো হতে পারে। রাজি?
—কোনো সমস্যা নাই। চলেন, শুরু করি।
শুরু করার কথা উঠতেই আমাদের নিয়ে গেল মূল গেটের ঠিক সামনে একটা একতলা দালানের ছাদে। আমাকে বলল, ওখান থেকে আপনি পাতানের সবচেয়ে ভালো ফটোটা তুলতে পাবেন। সবাই তাই করে।
আমি তাকে অনুসরণ করি। এর মধ্যে আমার দুজন রেডিমেড মডেল কাজে লেগে যায়। রাকিব আর মিশুকে বলা হয়েছে, তোমরা এমন ভাব দেখাবে যে, বাংলাদেশ থেকে আসা দুজন স্থপতি, পর্যটক এবং ফটোগ্রাফার, এই গাইডের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে শুনে তোমরা এই দালানগুলোর ছবি তুলবে। ব্যস, শুরু হয় সুটিং পর্ব। এখানে এসে দাঁড়িয়ে যান আমাদের গাইড। তিনি বলেন, পাতান নগরের জন্ম খ্রিষ্টজন্মের প্রায় ৫৭০ বছর আগে। মানদিভের নাতি ভারবী পাতান নগরের গোড়াপত্তন করেন। আর পাতানের রাজা সিদ্ধি নরসিংহ মল্ল এখানে এই দরবার চত্বরে তার প্রথম রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। তার শাসনের মধ্য দিয়েই নেপালে মল্ল রাজবংশের সূচনা ঘটে।
রামকৃষ্ণের ইংরেজিটা অনেক আহ্লাদি। খুব ভালো করে শুনলে তার মর্মার্থ বোঝা যায়। যেমন, তিনি যখন বলবেন, ‘মেনি মেনি ইয়ার্স বিফোর, দেয়ার লিভিং থ্রি কিং থ্রি প্লেস’, তখন এর মানে বুঝতে হবে— তিনি বলতে চাইছেন, ‘বহু বছর আগে নেপালে তিনজন রাজা তিন জায়গায় থেকে রাজত্ব করতেন।’
তার ইংরেজির ঢংটুকু আমরা বুঝে নিয়েছি। আরেকটা জিনিস বুঝতে পেরেছি যে, তাদের নেপালি ভাষায় অসংখ্য সংস্কৃত শব্দ আছে। যেমন হিন্দিতে। তার কথার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগুলো বাংলা করে তর্জমা করে নেই। তিনি তার নাম বলেন ‘রামকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠা’। আমরা ডাকি ‘রাম কৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ’। তিনি তাতে খুশি। যেটাকে তিনি ‘ইয়ামুনা’ বলছেন, আমরা শুনছি ‘যমুনা’ ‘নারসিমহা’কে ‘নরসিংহ’— এসব।
কথা বলতে বলতে রামকৃষ্ণ আমাদের নিয়ে এলেন এক জায়গায়। বলেন, এটির নাম সুন্দরী চক। ১৬১৮ সালে যখন এখানে প্রথম প্রাসাদটি গড়ে ওঠে তখনই এই সুন্দরী চকের জন্ম। সুন্দরী চকের একদিকে প্রাসাদ সদৃশ একটি ভবন। এটি মল্ল রাজাদের গোসলখানা। এই গোসলখানাকে নেপালিরা বলে টসোটি। লাল ইটের তিনতলা উচ্চতার এই ভবনটিতে দুই ধরনের জানালা। বর্গাকার ছোট ছোট কাঠের জানালাগুলোর মাঝখানে বৃত্তাকার জালি নকশা। এই জানালাগুলো খোলা যায় না। এগুলো দিয়ে ভেতর থেকে বাইরের দিকটা দেখা যায় কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরের দিকে দেখা যায় না।
অন্য ধরনের জানলা একটু বড় জালি এবং খোদাই নকশার কারুকাজ খচিত। এই জানালাগুলো খোলা যায়। সেকালে রাজপরিবারের সদস্যরা এ জানালাগুলোর পাশে দাঁড়িয়েই বাইরের দৃশ্য উপভোগ করতেন।
এই গোসলখানার বাইরের রাস্তার ওপর অনেকগুলো মূর্তি। কোনোটা হনুমানের, কোনোটা হাতির, কোনোটা ইঁদুরের।
গাইড বলছেন, ওগুলো সবই দেব-দেবী। কিন্তু এদের সম্পর্কে আমাদের কারোই খুব বেশি ধারণা নাই। বুঝতে পারেন গাইড মহোদয়। রামকৃষ্ণ বলেন, নেপাল সাংবিধানিকভাবে পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। এখানে মোট জনসংখ্যার ৭৫% হিন্দু, ২২% বৌদ্ধ এবং ৩% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। হিন্দু ধর্মে লাখ লাখ দেব-দেবী আছেন। এদের মধ্যে ব্রহ্মা-বিঞ্চু এবং শিব প্রধান দেবতা। ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা। বিঞ্চু প্রতিরক্ষার দেবতা আর শিব হলো মনোস্কামের দেবতা। প্রত্যেক দেবতার আছে একের অধিক বাহু। কারো চার হাত, কারো বা আট-দশ হাত, কারো বা তারও বেশি। যত বেশি হাত, তত বেশি শক্তি। যত বেশি মাথা তত বেশি শুভচিন্তা।
গাইডকে বলি, চলেন, ৪০০ বছর আগের রাজাদের গোসলখানাটা দেখি!
এটা দেখার উদ্দেশ্য ছিল আলাদা। কারণ, যে সময় নেপালের লোলিতপুরের রাজা রাজগোসলখানা বানিয়ে গোসলের আয়োজন করেছিলেন, সে সময় ইস্তাম্বুলের ওসমানি সুলতানেরা বানিয়েছিলেন হাম্মামখানা। ভারতের আগ্রা-দিল্লির মুঘল শাসকদেরও ছিল একই রকমের রাজকীয় গোসলের বিষয়, আতর-গোলাপ, ফুলের পাঁপড়ি, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর রমণীয় মোহন ছিল সেই সব গোসলখানার অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ।। আমার ইচ্ছা করে— হিন্দু রাজারা কেমন আয়েশি গোসল করতেন তা জানতে।
কিন্তু নিরাশ করলেন গাইড। সামনের তালা মারা দরজা দেখিয়ে বলেন, ওটা বন্ধ আছে, ভেতরে যাওয়া যাবে না। তবে এই রাজগোসলখানার দরজাটি বড় সুন্দর। এটার ছবি তুলতে পারেন। এটা একেবারে আদি অবস্থা থেকে এখন পর্যন্ত একই রকম আছে।
ইতালির পরিচালক বেতেনেলি ‘লিটিল বুদ্ধা’ নামে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন এবং ‘লিটিল বুদ্ধা’ সিনেমার একটি অংশের শুটিং হয়েছিল এই রাজগোসলখানার ভেতরে।
আমাদের ঢোকা হয় না রাজকীয় গোসলখানায়। আমরা গাইডকে অনুসরণ করতে থাকি।
রাজগোসলখানার ঠিক উল্টো দিকে সুন্দরী চকের ঠিক মাঝখানে একটি মন্দির। মন্দিরটি ছাই রঙের। আট কোনা। আস্ত একটি শিলাপাথর কেটেকুটে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে। ১৬১৮ সালে সিদ্ধি নরসিংহ মল্ল যখন এখানে প্রথম প্রাসাদটি নির্মাণ করেন সে সময়েই এই অষ্টভুজি কৃঞ্চমন্দিরটি নির্মাণ করা হয়।
রাজাদের প্রাসাদ নির্মাণের সাথে ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি মধ্যযুগে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ— সব ধর্মেই দেখেছি। সেটা ইউরোপের কোনো ক্যাসলই হোক ইস্তাম্বুল অথবা আগ্রা দিল্লির কেল্লা বা কান্ডির দন্ত মন্দির চত্বরই হোক— বিষয় একই।
এই কৃঞ্চমন্দিরের পাশেই দেখি বিশালাকৃতির ঘণ্টা।
রামকৃষ্ণ বলেন, আগের দিনে নেপালের জনগণ অনেক ধনী ছিল। পাতানের লোকজন কাঠমান্ডু যেত না, আবার কাঠমান্ডুর লোকজন পাতানে আসত না। যদি কখনো পাতানে কোনো বিপর্যয় ঘটত তখন ওপরের ওই বড় ঘণ্টি থেকে ঘণ্টা বাজানো হতো। এটিই ছিল সেকালে সংবাদ পাঠানোর উপায়। ছয়-সাত কিলোমিটার দূর থেকে এই ঘণ্টার ধ্বনি শোনা যেত।
এই তালেজু ঘণ্টার ঠিক বিপরীত দিকেই একটি ফটক। এটি প্রাসাদের মূল চকে প্রবেশের পথ। মূল চক পাতান রাজপ্রাসাদের প্রধান অংশ। এর প্রবেশ পথের দু দিকে দুটি পাথুরে সিংহকে বসিয়ে রাখা হয়েছে রাজপ্রাসাদকে পাহারা দেওয়ার জন্য।
কারুকাজ খচিত কাঠের প্রবেশ দ্বারের দু দিকে দুটি ‘চোখ’-এর ভাস্কর্যিক রূপ। ‘আইজ অব বুদ্ধা’। এই ‘চোখ’-এর বৈশিষ্ট্য কী? রাকিব প্রশ্ন করে রামকৃষ্ণকে।
রামকৃষ্ণ বলেন, আমাদের এখানে আপনারা তিন ধরনের স্থাপত্য রীতির মন্দির দেখতে পাবেন। প্রথম ধরনটি হচ্ছে শিকারা, এটি ভারতীয় স্থাপত্য ধারা, এ ধারার মন্দিরের চূড়াগুলো হয় পর্বতের চূড়ার মতো খাড়া। দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে নেপালি স্থাপত্যধারায় তৈরি মন্দিরগুলো, আমরা বলি প্যাগোডা, এটা অনেকটা চীনাদের মন্দিরের মতো দেখতে আর তৃতীয় ধারাটি হলো তিব্বতীয় স্থাপত্যধারায় নির্মিত মন্দির, আমরা যেটাকে বলি স্টুপা। তিব্বতীয় স্থাপত্যধারায় নির্মিত স্থাপনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে কাঠমান্ডুর বোদনাথ মন্দির এবং সোয়েম্ভুনাথ। ওখানেই আপনারা দেখতে পাবেন ‘আইজ অব বুদ্ধা’। তার একটা ছোট সংস্করণ পাতানের এই দরবার মহলে।
আমাদের ডান দিকের প্রাসাদটির নাম মালাপিরে। বর্তমানে আমরা একে যেভাবে দেখছি, মূল প্রাসাদটি আসলে ঠিক এ রকমই ছিল, কিন্তু এটা নয়। ১৯৩৪ সালে নেপালে বেশ বড় একটা ভূমিকম্প হয়েছিল। তখন প্রাসাদগুলোর অনেক ক্ষতি হয়। প্রাসাদগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইউনেস্কো এগিয়ে আসে। আমরা তাকিয়ে থাকি জানালাগুলোর দিকে। রামকৃষ্ণ বলেন, যে সময় রাজবাড়ির অন্দরমহলের লোকেরাই শুধু বাইরের সবকিছু দেখতে পেত, বাইরের মানুষেরা কিছু দেখত না। এই এলাকায় যারা বাস করত তারা কখনো জানতে পারত না রাজপরিবারে কতজন সদস্য বসবাস করে। আপনারা এখানে যা দেখছেন সবই প্রাসাদ। মিশু তন্ময় হয়ে কাঠের কাজ দেখে। সে শুধু দেখেই তৃপ্ত থাকছে না, কারুকাজ করা জালির ওপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রামকৃষ্ণ বলেন, এই কাজ যেসব কারিগর করেছে তাদের হাত কেটে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা অন্য কোথাও এমন কাজ করতে না পারে। সে কারণে এত সুন্দর নিখুঁত কারুকাজ আর কোনো শহরে দেখতে পাবেন না।
পাতানের মূল রাজপ্রাসাদে ঢুকেই একটি বড়সড় চৌকোনা খোলামেলা চত্বর। এই খোলামেলা চত্বরটিই মূল চক। সেকালে মূল চকে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। রাজপরিবারের সদস্যদের চরণধূলিতে ধন্য হতো তার চত্বর। আর এখন বছরের বারো মাসই পর্যটকদের পদভারে মুখরিত থাকে এটি।
মূল চকের ঠিক মাঝখানে একটি ছোট মন্দির, এটি বিদ্যাপতি মন্দির। আর তার চারপাশজুড়ে গড়ে উঠেছিল রাজপরিবারের সদস্যদের বাসভবন, মন্দির এবং অন্য ভবনগুলো। পুরো চত্বরটি ঘিরে টানা বারান্দা। আর এই টানা বারান্দাজুড়েই এক সারি কাঠের পিলার। এসব কাঠের পিলারের শরীর খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন কারুকাজ।
একদিকের বারান্দার মাঝখানে একটি পিতলের ঘণ্টাই রাজপ্রাসাদের আপত্কালীন সংকেতের জন্য বসানো। গাইড বলেন, আগামী ১৩ অক্টোবর আমাদের এখানে একটি বড় অনুষ্ঠান হবে। এখানে এই উঠোনে আমরা পাঠা বলি দেব। ওয়াটার বাফেলো, মুরগি সব মিলিয়ে ১০৮ প্রাণী আমরা বলি দেই। দেখি পিলারের গুঁড়িতে ২-৩টা ছাগলও বাঁধা। রামকৃষ্ণ বলেন, এগুলো বলির জন্য এসেছে। ওপরের যেসব দেব-দেবীর মূর্তি দেখতে পাচ্ছেন সেসব দেব-দেবীর মুখোশ পরে উপস্থিত জনগণ নাচানাচি করবে।
আমরা একসাথে ওপরের দিকে তাকাই। রামকৃষ্ণ বলেন, ওপরের যে মূর্তিগুলো দেখছেন এগুলো মা দুর্গার বিভিন্ন প্রতিরূপ। মা দুর্গা আর কালী একজনেরই দুটি রূপ।
রাজপরিবারের দেবতা হচ্ছেন ঐ তালেজু। তালেজু হচ্ছেন পার্বতীর আরেকটা রূপ, দেবতা শিবের সহধর্মিণী। আপনারা জানেন, পবিত্রতার দুজন দেবী আছেন। একজন হচ্ছেন বেনারসের গঙ্গা নদী, অপরটি হচ্ছেন পার্বতী। যেখানে আপনি পার্বতী দেখবেন সেখানেই তার বাহন কুমিরকে দেখবেন। কুমির পার্বতীর বাহন। আরেকটি পবিত্র নদী আছে, সেটি যমুনা। লোকজন এখানে এসে পবিত্রতার এই দুই দেবীকে স্পর্শ করে। একজন যমুনা, অন্যজন গঙ্গা।
এখানকার বারান্দা থেকে ভেতরের ঘরে ঢোকার জন্য আছে দরজা। আমরা ভেতরে ঢুকতে যাব, পেছন থেকে গাইড বলে ওঠেন, ‘মাইন্ড ইয়োর হেড, প্লিজ।’ দেখি বনসাই আকারের দরজা। সত্যিই, মাথা অনেকখানি নিচু করেই এ ঘরে ঢুকতে হয়। বিষয় কী? কেন এমন দরজা?
গাইড বলেন, এখানে তিনজন রাজা তিনটি নগর শাসন করত। এক রাজার সাথে অন্য রাজার যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। পাতান রাজ্যে যখন যুদ্ধ শুরু হতো তখন রাজপ্রাসাদ থেকে ঘণ্টা বাজানো হতো। পাতানের জনগণ একটি তরবারি নিয়ে ঘরের ভেতর এ রকম ছোট দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত, আক্রমণকারীরা যখন ঘরে ঢুকত তখন বাধ্য হয়ে তাদের মাথা নত করতে হতো আর সে সময় ভেতরে থাকা পাতানরা এক কোপে আক্রমণকারীর মাথা কেটে ফেলত। এটিই ছিল সে যুগের একটি কৌশল। এটা ছাড়াও, সাধারণেরা যখন রাজার ঘরে ঢুকত, তাদেরও যাতে রাজপরিবারকে সম্মান দেখিয়ে মাথা নুইয়ে ঢুকতে হয়, তার জন্য এমন।
মূল চক থেকে বেরিয়ে সামনেই যে স্থাপনাটি চোখে পড়ে এটি হরিশংকর মন্দির।
হরিশংকর অর্থ অর্ধেক শিব এবং অর্ধেক বিঞ্চু। বাইরের দিকে দেখছেন বিঞ্চু এবং শিবের বিভিন্ন অবয়ব। আর নিচের যে মূর্তিগুলো দেখছেন এগুলো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি। যেসব মানুষ নরকে যাবে তাদের কী ধরনের শান্তি দেওয়া হবে তা এখানে দেখানো হয়েছে। এই মন্দিরটিও তৈরি করা হয়েছে ১৭ শতকে। এখানেও আছে দৃষ্টিনন্দন কাঠের কারুকাজ। সবচেয়ে বড় যে মূর্তিটি এটি হচ্ছে রাজপরিবারের মূর্তি। আর এটি হচ্ছে আমাদের পাতানের রাজার মূর্তি। তার নাম যোগেন্দ্র নরেন্দ্র মল্ল। তিনি ছিলেন মল্ল সাম্রাজ্যের রাজা। তার ঘাড়ে একটি সাপ। সাপ হচ্ছে রাজার প্রতিরক্ষার প্রতীক। আমাদের এখানে হিন্দুরা মনে করে, রাজা হচ্ছে দেবতা বিঞ্চুর প্রতিনিধি। এবং লোকজন মনে করে রাজারা অমর। রাজার মূর্তি বানিয়ে তার ওপর পিতলের একটা পাখি বসিয়ে দেওয়া হয়। যখন পিতলের পাখিটি উড়ে যাবে তখন রাজা মারা যাবে। এই পিতলের পাখিটি কখনো উড়ে যাবে না। যার অর্থ হলো আমাদের রাজা কখনো মারা যাবে না। মূর্তি হয়ে এ স্তম্ভের ওপর বসে থাকবে আর রাজপরিবারের জন্য মঙ্গল কমনা করবে।
পাতান দরবার স্কয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরটি কৃঞ্চমন্দির। শিকারা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই মন্দিরটির অনন্য সৌন্দর্য দরবার স্কয়ারের অপরাপর স্থাপনা থেকে একে আলাদা করে রেখেছে। ১৬৩৭ সালে রাজা সিদ্ধি নরসিংহ মল্ল এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে যে একদিন রাতে রাজা স্বপ্নে দেখলেন যে রাধা-কৃঞ্চ রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরদিন সকালে রাজা নির্দেশ দিলেন, ঠিক সেই জায়গাতেই একটি মন্দির নির্মাণ করতে হবে। এটিই সেই মন্দির।
একটি আস্ত শিলাখ্ল কেটে কেটে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার পাথুরে শরীর খুড়ে খুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মাহাভারতের কাহিনি। আর তৃতীয় তলার পাথুরে শরীরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পুরো রামায়ণ। মন্দিরের তৃতীয় তলার ওপর থেকে সর্বোচ্চ চূড়া পর্যন্ত মোট ২১টি সোনার শৃঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নিচতলায় আছে রাধাকৃঞ্চ আর রুকমনির মূর্তি। মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় হয় শিবের পূজা। আর তৃতীয় তলায় পূজা করা হয় গৌতম বুদ্ধের।
কৃঞ্চমন্দিরের সামনের লৌস্তম্ভের ওপরও একটি মূর্তি। এটি নেপালি গরুড়। গরুড় হচ্ছে দেবতা বিঞ্চুর বাহন। অর্ধেক পাখি আর অর্ধেক মানুষের অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি। করজোড়ে ওড়ার অপেক্ষায় ধ্যানরত বিঞ্চু। আর বিঞ্চুর হাতের ওপরে বসে আছে একটি পাখি। এই পাথুরে পাখিটি কখনো উড়ে যাবে না, আর রাজা সিদ্ধি নারায়ণ মল্লেরও মৃত্যু হবে না, এমনটাই ছিল সে সময়ের রাজাদের বিশ্বাস। আজকের প্রজারা এই বিশ্বাস ধারণ করে কি না, জানি না। তবে প্রচুর কৌতূহলী পথচারী বা পর্যটক এর নিচের প্লাটফর্মে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারে, বিশাল এই মধ্যযুগীয় রাজধানী চত্বরে ঘুরে বেড়ানোর ক্লান্তি সারাতে এ জায়গাটি চমত্কার।
এই প্রাসাদের সামনে গরুড়ের ঠিক উল্টো দিকে আরেকটি প্রাসাদ। সোনার পাতে মোড়ানো এক তোরণ। এই গোল্ডেন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে সারি সারি বর্গাকার কাঠের পিলার। পিলারের শরীরজুড়ে কারুকাজ। পাতান চত্বরের অপরাপর প্রাসাদের কাঠের পিলার থেকে এই পিলারগুলো একটু আলাদা। এই পিলারগুলোর রং কালো। জার্মান এবং অস্ট্রেলিয়া সরকারের অর্থায়নে এই পিলারগুলো আবার নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে।
গোল্ডেন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই একটি বড়সড় উঠোন। এটি পাতান দরবার স্কয়ারের কেশব নারায়ণ চক। এটি দরবার স্কয়ারের শেষ চক। কেশব নারায়ণ চকের সাথে মূল চকের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এই প্রাসাদেই বসবাস করতেন সে সময়ের ক্ষমতাসীন রাজা তার রানিদের নিয়ে। সেকালে রাজাদের রানির সংখ্যা কত ছিল সেটা সম্পর্কে জনসাধারণের কোনো ধারণা ছিল না। তারা সব সময় মনে করত রাজা ৩৩ জন রানি নিয়ে এই প্রাসাদে বসবাস করেন। রাতে শোয়ার সময় রাজা সব সময় দুইজন রানিকে সঙ্গে রাখতেন। একজন রানি থাকতেন রাজার ডান দিকে, অন্যজন বাম দিকে।
এই জায়গাটিতে সুলতানি বা মুঘল রাজাদের সাথে এই নেপালি রাজাদের একটা তফাত্ পেলাম। সুলতানি বা মুঘল বাদশাহদের ‘হেরেম’ ছিল, শত শত নারী সেখানে বসবাস করত। সেখান থেকে বাদশাহর পছন্দের এক এক নারী এসে রাজার সাথে রাত্রিবাস করে যেত। এদের কেউ কেউ রাজার উপপত্নী বা পরবর্তীতে পত্নীও হতো।
কেশব নারায়ণ চকের চারদিকের এই ভবনগুলো এখন সবই নেপাল সংস্কৃতি রক্ষা জাদুঘরের বিভিন্ন ভবন। আমরা ঢুকে পড়ি এদের একটিতে। এখানে বিভিন্ন শোকেসের মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেকালে ব্যবহূত বিভিন্ন তৈজসপত্র, গৌতম বুদ্ধের মূর্তি, কাপড়চোপড়— এসব। এটাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে গেলেই আরেকটি মন্দির। এটি ভীম মন্দির। ১৬৮০ সালে শ্রীনিবাস মল্ল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কারুকাজ খচিত তিনটি সোনার জানালা এই মন্দিরটিকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে রেখেছে।
এক নাগাড়ে অনেক কথা শুনে শুনে আমরা বেশ ক্লান্ত। এক জায়গায় বসে রামকৃষ্ণের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা হয়। তাকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, ভীম কে ছিলেন? রামকৃষ্ণ বলেন, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব— এরা ছিল ৫ ভাই। দ্রৌপদীকে বিয়ে করেছিল তারা। এদের বলা হয় পঞ্চপা্লব। এই পঞ্চপা্লবের মধ্যে ভীম ছিল ব্যবসায়ী। এটি হচ্ছে ভীমের মন্দির। যারা এখানে ব্যবসা করে তারা দোকানপাট খোলার আগে এখানে পূজা করতে আসে। ভীমসেন মন্দিরের পাশেই বিশ্বনাথ মন্দির। মন্দিরের দুদিকে দুটি হাতির মূর্তি। হাতি হচ্ছে দেবতা গণেশের বাহন।
বিশ্বানথ মন্দিরের পাশেই সারি সারি কয়েকটি স্থাপনা। এগুলো সেকালের রাজাদের অতিথিশালা। দূর-দূরান্ত থেকে যখন ব্যবসায়ী বা জনগণ রাজার সঙ্গে দেখা করতে আসত তারা এখানে অবস্থান করত রাত্রি যাপনের জন্য। পথচারীরাও বিশ্রামের জন্য অবস্থান করত। মূল অতিথিশালাটির নাম মনি ম্লপ।
প্লাটফর্মের ওপর চৌচালা কতকগুলো ছাউনি। এক সময় রাজবাড়িতে বেড়াতে আসা বা রাজদর্শনে আসা নাগরিকদের ওয়েটিং লাউঞ্জ হিসেবে এটা ব্যবহূত হতো। রাতে ঘুমানোরও ব্যবস্থা ছিল এখানে। এখন নাই। এখন স্থানীয় লোকজন, বেকার গাইড বা পর্যটকেরা এখানে বসে বসে পাতান চত্বরের স্থাপনা, পর্যটকদের আনাগোনা, এসব দেখেন।
অতিথিশালার পাশেই নিচুমতো একটা জায়গা। আপাতভাবে দেখে মনে হচ্ছে খোলা একটা বেজমেন্ট ফ্লোর। ছোট সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হয়। তার কিনারা বরাবর কতকগুলো পানির কল। সেই কল থেকে অবিরাম পানি পড়ছে। কিছু মহিলা-কিশোরী এই নল থেকে বড় জগ বা কলসি ভরে পানি নিয়ে যাচ্ছে। রামকৃষ্ণ বলেন, এটাই সে সময়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের একমাত্র পাবলিক বাথ আর জলাধার ছিল। যেহেতু এই পুরো জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ফুট উঁচুতে, এখানে স্বাভাবিক পানির স্তর পাওয়া যায় না। হিমালয় থেকে গড়িয়ে আসা পানি পাওয়া যায় ১০-১৫ বা ২০ ফুট নিচে। সে কারণে পানির ওই স্তরেই নল বসিয়ে দিতেন পাতান রাজা, সাধারণ নাগরিকরা এখান থেকেই পানি নিত। এখন যদিও মটর লাগিয়ে পানি নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, তার পরও একদম বিশুদ্ধ মিনারেল ওয়াটার পাওয়ার জন্য স্থানীয়রা এখান থেকে পানি নিয়ে যায়। আসলে পাতান হচ্ছে সিটি অব আর্ট, সিটি অব বিউটি। ইউরোপ এবং কাঠমান্ডুর ব্যবসায়ীরা এখান থেকে বিভিন্ন শিল্পকর্ম কিনে গিয়ে তাদের শো-রুমে বিক্রি করে। এখানে যাদের দেখছেন তারা সবাই চারু এবং কারুশিল্পী। নেপালের এই এলাকাটা চারু এবং কারুশিল্পীদের জন্য বিখ্যাত।
পাতানের সোনার মন্দির
পাতানের এই দরবারমহলটি যে খুব বড়, তা নয়। কিন্তু দেখার মতো এত এত জিনিস যে খানিকক্ষণ ঘোরার পরই চোখ ছানাবড়া হয়ে আসে, আসে ক্লান্তিও। এই বিরাট চত্বরটি একেবারেই উন্মুক্ত জাদুঘর। অনেকটা প্যারিস বা প্রাগের মতো। বরং কোনো ক্ষেত্রে এটা তার চেয়েও যেন খানিক বেশি। এত সহজে এত কাছ থেকে ৩-৪শ বছরের কারুকাজ করা কাঠের ভাস্কর্য, ভারতি, তিব্বতি আর নেপালি স্থাপত্যরীতির ভিন্ন ভিন্ন মন্দির বা প্রাসাদ এত সহজে কাছ থেকে দেখার সুযোগ কম জায়গায়ই হয়।
আমরা আছি আমাদের গাইড রামকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠর সঙ্গে। বারবার তিনি ঘড়ি দেখছেন এবং তাড়া দিচ্ছেন। মুখে বলছেন, আমি তো অন্যদের এক ঘণ্টায় শেষ করে ফেলি, আপনারা এত সময় নিচ্ছেন! দুই ঘণ্টা হয়ে গেল, এখনো আরো অর্ধেক বাকি আছে।
আমরা বলি, আমাদের একটু সময়ই লাগবে। দেখছেন না, দুই-তিনটা ক্যামেরায় স্যুট হচ্ছে আপনাকে! এবার তিনি কিঞ্চিত্ ক্ষেপে যান। বলেন, আমি স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান ভাষাও পারি। ইউরোপিয়ানরা আমাকে ইউরো দেয়। এতক্ষণ তাদের সঙ্গে থাকলে নির্ঘাত ৫০ ইউরো পেয়ে যেতাম। রাকিব ঘড়ি দেখে। বলে, এখন তো ৪টা বাজে। ৫টায় সন্ধ্যা নামবে। আপনি কি এখন নতুন কোনো ট্যুরিস্ট পাবেন, আপনাকে ৫০ ইউরো যে দেবে?
রামকৃষ্ণ হাসেন, বলেন, আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চাইছেন দেখে আমারও ভালো লাগছে। বাংলাদেশে আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি। আপনাদের ভাষা আমি পুরোপুরি বুঝি। বলতে পারি না। আপনাদের ভাষাও সংস্কৃত থেকে এসেছে, আমাদেরটাও সংস্কৃত থেকে। সে কারণে আমাদের অনেক কিছু আপনারা সহজে বুঝে ফেলেন। এবার ওঠেন, আরো কিছু দেখব।
আমরা রামকৃষ্ণকে অনুসরণ করি। পাতানের দরবারমহলের বড় বড় মন্দির আর রাজপ্রাসাদ পেছনে ফেলে আমরা একটা গলিপথের ভেতর দিয়ে ঢুকি। এই পথটা অনেকটা আমাদের শাঁখারী বাজারের মতো। ডানে-বামে নানা রকমের দোকানপাট, তার ওপরে দুই-তিনতলা বিল্ডিং। বোঝাই যাচ্ছে, এখানে ওপরে লোকজন থাকে, নিচে দোকানের পশরা।
রামকৃষ্ণ বলেন, এখন যাকে আমরা পাতান দরবার স্কোয়ার হিসেবে জানি, সেটি ছিল এক সময় ললিতপুর জেলা। পুরো নেপালের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ কারুশিল্পীদের বাস ছিল এখানে। কাঠের ওপর নানা রকম ভাস্কর্যিক উপকরণ তৈরি করতেন তারা।
আমরা একটা দোকানের ভেতর ঢুঁ মারি। এটা একজন চিত্রকরের শো-রুম। দোকানের সামনে নানা রকমের ওয়েল পেইন্ট ও ওয়াটার কালার ফ্রেম করে রাখা। কিছু ফ্রেম ছাড়াও। ভেতরে শিল্পী নিজের মতো করে নতুন একটা ছবি আঁঁকছেন। এক সময় হয়তো তাদের পূর্ব পুরুষেরা কাঠ খোদাইর কাজ করত। এখন ছবি আঁঁছেন। বিভিন্ন ফর্মের, বিভিন্ন ফরম্যাটের কারুশিল্পের দোকান আছে এই গলিপথে। কোনোটি মুখোশের দোকান তো কোনোটি বিভিন্ন ধাতব দিয়ে তৈরি গয়নার। আবার কোনো দোকানে বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় শিল্পীদের আঁঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম। মুখোশ, গয়না, ঘর সাজানোর তৈজসপত্র সবকিছুর গায়েই আছে শিল্পীর তুলির ছোঁয়া, না হয় খোদাইকর্ম। দশহারা নবরাত্রিতে মানুষ এখানে এসে নাচগান করে। নাচের সময় তারা কাঠের তৈরি এই মুখোশ পরে। কোনোটি হাতির, কোনোটি হনুমানের, কোনোটি ড্রাগনের। আছে আফ্রিকান মানুষের কিছু মুখের প্রতিকৃতিও। যদিও এর সবই হিন্দু পুরাণের চরিত্র এবং ধর্মীয় তাত্পর্য বহনকারী, কিন্তু ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে পর্যটকেরা এখান থেকে কিনে নিয়ে যায় স্রেফ ললিতকলার শহর পাতানের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াই। রামকৃষ্ণ বলেন, এটাই সেই সোনার মন্দির, নেপালের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। এটা বৌদ্ধদের বানানো ১১৯২ সালে।
গৌতম বুদ্ধের জন্ম এই নেপালে, খ্রিস্টজন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে। কিন্তু তিনি লুম্বিনী থেকে চলে যান ভারতে, তার বাণী ও আদর্শগুলো ছড়ান সেখানে। সে কারণে বৌদ্ধধর্ম নেপালে খুব বেশি বিকশিত হয়নি। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে হিন্দু রাজারা রাজত্ব কায়েম করতে থাকেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরনো যেসব উপাসনালয় নেপালে আছে, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে পুরনো। আমরা একটা ছোট্ট প্রবেশ তোরণের সামনে দাঁড়িয়ে এই মন্দিরটা দেখি। গোল্ডেন টেম্পলের প্রবেশ পথের দুধারে দুটি সিংহ মূর্তি। এই সিংহ মূর্তি দুটো পবিত্র এই ধর্মশালাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।
ছোট্ট গেট দিয়ে ঢুকেই দেখি একটি লম্বা পরিসর। এটি পেরিয়েই আবার আরেকটি প্রবেশদ্বার। এ প্রবেশদ্বারের শরীর খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি।
ভেতরে ঢুকেই দেখি, আগে দেখা অন্য সব চত্বরের মতো এটাও একই রকম একটা চত্বর। মাঝখানে একটা উঠোন, তার চারপাশে টানা বারান্দাওয়ালা কতকগুলো ঘর। উঠোনের মাঝখানে একটা স্তুপ। পশ্চিম পাশে কয়েকটা চালাসর্বস্ব একটা ছাউনি। ওখান থেকে পিতলের পাত দিয়ে বানানো একটা লম্বা সিঁড়ি নেমে এসেছে উঠোন বরাবর। আমি প্রথমে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। পিতলের তৈরি অনেকগুলো গামলার আকৃতির কিউব থরে থরে সাজানো। একটিতে হাত দিলাম। রামকৃষ্ণ বলেন, এটি হচ্ছে একটি জাদুকরি জিনিস। এটি অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি। যাদের মাইগ্রেন আছে, যারা ডিপ্রেশনে ভোগে, যাদের বাতের ব্যথা আছে তাদের জন্য এটি খুব কাজে আসে। আমরা মেডিটেশন করি না। আমরা হিলিং থেরাপি নিই। অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি এই গামলা মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এরপর এটিতে হালকা তাপ দেওয়া হয়। ফলে মানুষের শরীর থেকে মাথাব্যথা, বাতের ব্যথা দূর হয়ে যায়। আমরা এটাকে বলি জাদুকরি গামলা।
আমি সামনের পাত দিয়ে বানানো সিঁড়িটা দেখাই রামকৃষ্ণকে। তিনি বলেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মনে করে এটি স্বার্গীয় পথ। এই পথ স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এসেছে। গৌতম বুদ্ধের মত ও পথ সঠিকভাবে অনুসরণের মাধ্যমে এই পথ ধরে পৌঁছে যাওয়া যাবে স্বর্গে।
স্বর্ণমন্দিরের ছোট্ট চৌকোনা উঠোনের ঠিক মাঝখানে একটি ছোট্ট মন্দির। এটি সম্ভুনাথ মন্দির। এখানে প্রথম স্বর্ণমন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল খ্রিস্টজন্মের ১৫ বছর আগে। পরবর্তীকালে চতুর্দশ শতকে গৌতম বুদ্ধের স্মরণে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। মন্দির তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সোনামিশ্রিত পিতল। সে কারণেই মন্দিরের নাম হয়েছে স্বর্ণমন্দির।
এই মন্দিরের চারদিকে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ধর্ম চরকা। সম্ভুনাথ মন্দিরের চার কোণে চারটি প্রাণীর মূর্তি।
এই সুয়ামবুনা মন্দির ঘিরেই গড়ে উঠেছে মূল স্বর্ণমন্দির। মাঝখানের উঠোন ঘিরে টানা বারান্দা। এই বারান্দায় ওঠার জন্য রয়েছে প্রবেশপথ। এই প্রবেশপথের দুদিকে দুটি ধাতব হাতি। এই হাতিদের মধ্যে যেটি ডান দিকের সেটি পুরুষ আর বাম দিকেরটি নারী হাতি। সিঁড়ির ধাপ মাড়িয়ে বারান্দায় উঠলেই লম্বা বারান্দার রেলিংজুড়ে ধর্ম চরকা। ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধরা যখন এই বারান্দা দিয়ে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করেন তখন হাত ছুঁয়ে যান ধর্ম চরকাতে আর একের পর এক ধর্ম চরকা ঘুরতে থাকে। এসব ধর্ম চরকার গায়ে খোদাই হরফে যা লেখা তা আমরা পড়তে পারি না। রামকৃষ্ণ আমাদের অনুবাদ করে বোঝান। এখানে লেখা, ‘হে মহাপ্রভু, আমার হুদয়কে পদ্ম পাপড়ির মতো কোমল করে দাও।’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যখন এই চরকা স্পর্শ করে যান তখন মনে মনে এই আপ্ত বাক্যটিও আওড়ান তারা।
রামকৃষ্ণ বলেন, কিন্তু মন্দির চত্বরটি কেবল প্রার্থনাকারীদের জন্যই নয়। যেকোনো ধর্মের যে কারোরই অধিকার আছে মন্দির চত্বর ঘুরে দেখার। বিভিন্ন ধর্মের পর্যটকেরা অবলীলায় ঘুরে দেখছে মন্দিরের সমূহ চত্বর। কিন্তু প্রতিদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত স্থানীয়রা আসে এখানে পূজা দিতে। এই মন্দিরে পূজা দিয়ে তারা দিনের কাজ শুরু করে।
মন্দিরের চার কোণে চারটি বানরের মূর্তি। এসব বানরের হাতে আলাদা ফল। কোনো বানরের হাতে নারকেল তো কোনো বানরের হাতে কাঁঠাল। এই চত্বরের দক্ষিণ পাশের একটি ঘরে একটি ছোট্ট বৌদ্ধমূর্তি। তার সামনের বারান্দায় ২৫-২৬ বছরের মাথা কামানো এক তরুুণ দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখিয়ে আমাদের গাইড রামকৃষ্ণ বলেন, উনি হচ্ছেন এই মন্দিরের পুরোহিত।
এত দিন বুড়ো লোকদের পুরোহিত হিসেবে দেখে এসেছি, এখানে দেখি একেবারেই এক তরুণ। তার সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি হাত নাড়লেন এবং বললেন, ‘হাই!’ বাহ! তিনি কি তবে ইংরেজি জানেন? কাছে গিয়ে ক্যামেরা ধরলাম। অনেক কথা হলো। এই তরুণ পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। একটা কম্পিউটার তৈরির কারখানায় কাজ করেন। এক মাসের জন্য চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। এটা তার প্রশিক্ষণের একটা অংশ। এই এক মাস তিনি এই মন্দিরে থাকবেন, পূজারীদের পূজা গ্রহণ করবেন এবং বৌদ্ধধর্মের দীক্ষাবাণী শোনাবেন।
আমি তার বেশ কাছে গিয়ে ছবি তুলতে চাই। তিনি পিছিয়ে যান। মুখে বলেন, দয়া করে আমাকে ছোঁবেন না। আমি নিশ্চিত নই যে আপনি পুরোপুরি পবিত্র কিনা, আপনি সারা দিন বাইরে ঘুরছেন, আপনার শরীরে অশুভ কোনো ধুলোবালিও যদি থাকে, তাহলে সেটা আমাকে অপবিত্র করতে পারে।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে এক পৌঢ় এসে হাজির হন। তিনি তার মা। মা, খালা এবং ছোট বোনকে নিয়ে তিনি এখানে একটি ঘরে এই এক মাস থাকছেন। এরপর আবার কাজে যোগ দেবেন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমরা বেরিয়ে আসি সোনার মন্দিরের ভেতর থেকে। রামকৃষ্ণকে বলি, আমাদের পাতান দেখা কি শেষ?
রামকৃষ্ণ এবারও হাসেন। বলেন, পাতানের আরো অনেক কিছু দেখার আছে। আমি বলি, আর কিছু দেখব না। সবই আমার কাছে এখন একই রকমের মনে হয়। আমরা রামকৃষ্ণকে নিয়ে হাঁটতে থাকি। ডানে-বামে আরো কিছু মন্দির চোখে পড়ে। কোনটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির আর কোনটি বৌদ্ধদের সেটা সাদা চোখে বুঝে ওঠার উপায় নেই। দুটি ধর্মের অনুসারীদের কাছেই এসব মন্দির সমান পূজনীয়। হিন্দুরা পূর্ণবিশ্বাসে যেমন গৌতম বুদ্ধের পূজা করছে তেমনি বৌদ্ধরাও সমান বিশ্বাসে শিব বা কৃঞ্চের পূজা করছে।
বিকেলের আলো নেমে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে পাতান দরবারমহলে। আমরা চলে আসি একটি হিন্দু মন্দিরের সামনে। এটি দুর্গামন্দির। এই সন্ধ্যায় অনেক পুণ্যার্থীই জড়ো হয়েছেন মা দুর্গার প্রতি তাদের ভক্তি আর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।
ঘণ্টা বাজে মন্দিরে। কাঁসার ঘণ্টা। পিতলের মোমদানিতে জ্বলে ওঠে ছোট ছোট প্রদীপ। মন্দিরের ভেতর যে পুরোহিত বসে আছেন তার কাছে অর্ঘ্য সমর্পণ করার জন্য পূজারীরা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে। আমরা ঠিক করলাম দিনের আলোর শেষ আভা নিভে যাবার আগে ললিতপুরের এই প্রাচীন রাজকীয় মহল ছেড়ে যাব।
আবার ফিরছি সেই পথ দিয়ে। ঘণ্টা তিনেক আগে এ পথ দিয়েই আমরা হেঁটে এসেছিলাম। দেখি, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাচীন রাজপ্রাসাদটিকে মুখ করে মন্দিরের সামনে এক লৌহস্তম্ভের ওপর করজোড়ে বসে আছেন পিতলের রাজা নরসিংহ মল্ল। তার মাথার ওপর একটা সাপ, তার ওপর সেই পাখিটিও আছে। পাখি উড়ে গেলে রাজা মরে যেতেন। কিন্তু পাখিটি কখনো উড়বে না। ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে পাতানের সেই রাজারাও আছেন, আছে তাদের সেই কারুকাজ চিহ্নিত পরিসরের নিদর্শনও।