যমুনা নদীর পাড়ঘেঁষা পলাশপুর গ্রামে ঢুকেই মন ভালো হয়ে যায় ঋদ্ধের। ছবির মতো সুন্দর এই ছোট্ট গ্রামটি তার মামাবাড়ি। চার বছর পর এবার সে মাত্র চার দিনের জন্য মামাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে।
কিন্তু বেড়াতে এসে একজনের জন্য ঋদ্ধের জীবনটা যেন সাক্ষাত্ নরকে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। পাভেল, তার সমবয়সী মামাত ভাই, মামাবাড়িতে আসার জন্য প্রতিদিন পাঁচবার করে ফোন করত ঋদ্ধকে। আর এখন ভালো-ভালো কথা বলে ডেকে এনে ঋদ্ধের ওপর সে আচ্ছা করে হাতের সুখ মেটাচ্ছে। ফাইনাল পরীক্ষার পর আরামের ছুটিটা যে এভাবে নষ্ট হবে, তা কখনও চিন্তাও করেনি ঋদ্ধ। শুধু কিল-ঘুসি না, পাভেল যখন বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ঋদ্ধের শরীরে চিমটি দেয়, তখন যেন ২২০ ভোল্টের ইলেকট্রিক শক লাগে। চিমটি যে এমন ভয়ানক যন্ত্রণার হতে পারে, তা পাভেলের চিমটি না-খেলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। মাত্র তিন দিনেই ঋদ্ধের সাদা চামড়ার ওপর যেখানে-সেখানে কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। তাই ঋদ্ধ ঠিক করেছে আর একদিনও সে এই কাঁকড়ার সঙ্গে সময় কাটাবে না। সে আজ বিকেলেই ঢাকা ফিরে যাবে।
পাভেল সে কথা বুঝতে পেরে বলল, ‘যমুনা নদীর পাড়ে একটা দারুণ দ্বীপ জেগেছে। সন্ধ্যার সময় পর হাজার হাজার অতিথি পাখি ভিড় করে। না-দেখলে জীবন বৃথা।’
কথাটা শুনে ঋদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সত্যিই ঢাকায় ফিরে গিয়ে সেই তো যানজট ধোঁয়া ধুলাবালি। অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করা হলেও যমুনার কোনো বিজন দ্বীপে যাওয়া হয়নি এখনও। ব্যাপারটা দারুণ রোমাঞ্চকর হওয়ার কথা।
ঋদ্ধ বলল, ‘আজ বিকেলে গেলে যেতে পারি, নইলে সন্ধ্যার বাসে ঢাকা চলে যাব।’
পাভেল আনন্দে ঋদ্ধের পিঠে চাপড় মারতে গেলে সে ছিটকে সরে যায়। গরম চোখে বলে, ‘তুই আমাকে ছুঁবি না।’
পাভেল যেন সারাটা বিকেল সুবোধ বালক হয়ে রইল। ঋদ্ধকে নিয়ে ঘুরতে গেল যমুনায় জেগে ওঠা ছোট্ট দ্বীপটাতে। এমন অপরূপ চারপাশ, শত শত পাখির কলরব, আর ঠান্ডা ভেজা বাতাস—ঋদ্ধ সম্মোহিত যেন হয়ে গেল। উদাস মনে সে পাভেলের সঙ্গে সেই চরের ওপর চ’রে বেড়াচ্ছিল আর ভাবছিল—আর মাত্র একদিন। দেখতে-দেখতে তিন-তিনটে দিন পার হয়ে গেল! সবুজ প্রকৃতি আর সতেজ বাতাসে একটু বেশি ঘুরলেই ঋদ্ধের খিদে বেড়ে যায়। স্থান-কাল ভুলে ঋদ্ধ হঠাত্ পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘বেজায় খিদে পেয়েছে রে পাভেল। কী খাওয়া যায় বল তো?’
পাভেলের ভেতরে যেন শিংওয়ালা পাভেল জেগে উঠল? চোখ মটকে ধূর্ত দেঁতো হাসি হেসে বলল, ‘কী আর খাবি। এই চরে আর কী-ই বা পাবি! চরে চরতে চরতে কষে একটা চড় অথবা একটা রামচিমটি খেতে পারিস...।’
বলতে বলতে ২২০ ভোল্টের শক খেল ঋদ্ধ। তড়াক করে লাফ দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। আতঙ্কিত চোখে পাভেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ডান কব্জিটা জোরে জোরে ডলতে লাগল ঋদ্ধ।
পাভেল দেঁতো হাসি আকর্ণ করে বলল, ‘একটা চিমটি খেতে নেই, দোষ হয়... আয় আরেকটা দিই।’ বলেই ঋদ্ধকে তাড়া করল। বড্ড হিতাকাঙ্ক্ষী সে; আরেকটা চিমটি দেবেই এবং কোনোমতেই তা না-দিয়ে ঋদ্ধের কপালে ‘দোষ’-এর ছাপ ফেলতে দেবে না।
বেড়াল যেন ইঁদুরকে তাড়াচ্ছে; সামনে খাদ্য পেছনে খাদক। প্রাণের মায়ায় দৌড় আর ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য দৌড়—পার্থক্য তো হবেই; সুতরাং ঋদ্ধ কোনোমতেই হার মানত না—যদি...।
এই ‘যদি’টা না-থাকলে এই কাহিনির কোনো উত্তেজনাই থাকত না। ঋদ্ধ অনেকখানি এগিয়ে থেকেও কী একটা পায়ে বাধা পড়ায় পাঁচ হাত দূরে বালির ওপর ছিটকে পড়ল। যেন অসাধারণ ডাইভ দিল সে, গোল বাঁচানোর দুর্দান্ত ভঙ্গিতে, অথবা রান-আউট থেকে রক্ষা পাওয়ার দুর্দমনীয় চেষ্টায়। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে রেসলিঙের ভঙ্গিতে শুভ্র ঝাঁপিয়ে পড়ল ঋদ্ধের ওপর। কিছুসময় ধ্বস্তাধ্বস্তি এবং রামচিমটির সঙ্গে সুবোধের রামচিত্কার। তারপর সব ঠান্ডা। সন্ধ্যার কালো চাদর তখন অল্প অল্প করে নদী আর আদিগন্ত প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসতে শুরু করেছে।
দু’জনের সারা গায়ে বালিতে মাখামাখি—তাতে কোনো আক্ষেপ নেই ঋদ্ধের। কিন্তু পাভেলের ওপর এবার সে সিরিয়াসলি বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। দুশো কুড়ি ভোল্টেজের জীবন্ত আতঙ্কের সঙ্গে আর যা-ই হোক বন্ধুত্ব হয় না। ঋদ্ধ অভিমানী মনে শুভ্রর সঙ্গে চিরকালীন সম্পর্ক বিচ্ছেদের কথা ভাবল। ঋদ্ধেও দুয়েকবার পাল্টা চিমটি দেওয়ার চেষ্টা করেছে পাভেলকে। কী লজ্জার কথা—ছুঁচো যেন রাগে গন্ডারকে গুঁতোচ্ছে, গন্ডার বলছে—‘ছুঁচো ভাই, কাতুকুতু দিচ্ছ কেন?’ সুতরাং এসপার-ওসপার একটা কিছু করেই ছাড়বে সে।
এতো রাগ আর অভিমানের ভেতরেও ঋদ্ধের হঠাত্ বিদ্যুত্ ঝিলিকের মতো হোঁচট খাওয়ার কারণটার কথা মনে পড়ে গেল।... একটা মোটা খেরো-খাতার মতো শক্ত কিছু... বালির ভেতর থেকে অল্পখানিকটা মুখ তুলে বেরিয়ে ছিল। সেখানেই বাধা পেয়ে পড়ে যায় ঋদ্ধ।
এরপর বাকি কাজটুকু ঋদ্ধ একান্ত গোপনে সারল। বাড়িতে ফিরেই হাত-মুখ ধুয়ে, ‘একটু আসছি’ বলে সে বেরিয়ে পড়ল একাকী। নদীর নতুন চরের ওপর একটুখানি খুঁজতেই খেরো-খাতার মতো বইটি পেয়ে গেল সে। শুক্লা চতুর্দশীর গোল চাঁদ উঠেছে সন্ধ্যা নামার আগে। ফাল্গুনের ঠান্ডা ঝিরঝিরে হাওয়ার ঝাপটা বেড়ে গেছে চরাচর আঁঁধার হওয়ার সঙ্গে। অতিথি পাখিদের কলরব তখন কানে তালা লাগার মতো। আহা! পৃথিবীটা এতো সুন্দর! এইসব পাখিদের কলবর ছাড়া সারা জগতে কেউ কোথাও নেই।
ঋদ্ধ সেই হোঁচট খাওয়ার জায়গায় ফিরে এল। সন্ধ্যা নামতেই সারা চরাচর কেমন নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে গেল, থেমে গেল পাখিদের কলরব। ঋদ্ধের হোঁচটের ধাক্কায় আলগা হয়ে উঠে এসেছে একটা চৌকোণা প্যাকেট। হ্যাঁ, প্যাকেট-ই। কালচে মোটা জলবায়ুরোধী পলিমার দিয়ে আগ-পাশ ভালো করে প্যাকিং করা। প্যান্টের পকেট থেকে নেইল কাটারটা বের করে সে, মনে করে আগেই নিয়ে এসেছিল। চতুর্দশী চাঁদের আলোয় ঋদ্ধ স্পষ্টভাবে দেখল জল-বাতাসের স্পর্শ না পেয়ে খাতাটির মধ্যে সামান্যতম বয়সের ছাপ পড়েনি।
মলাটের ওপর মোটা হরফে লেখা—রেড ডায়েরি। ব্রাকেটে লেখা—টপ সিক্রেট। লেখকের নাম রাশেদ শামীম ওরফে ট্যাপা। ভেতরে নাম-ঠিকানা, বয়স-সাল-তারিখ ইত্যদি। ইয়ারের স্থানে লেখা ১৯৮৮ টু ১৯৯৫।
ডায়েরিটার শেষের দিকে ঋদ্ধ একটু চোখ বুলিয়ে নিল—‘সুমন মামা নেই, আজ প্রায় আট বছর হয়ে গেল। মামা ডায়েরিতে লিখে গেছেন—তার এই সিক্রেট যন্ত্রটা যেন কোনোমতেই সভ্য মানুষের হাতে না-পড়ে, দরকার মনে করলে এটাকে তিনি কোনো একদিন যমুনায় ভাসিয়ে দেবেন।’ অথচ মামা এখন কোন ভবিষ্যতে হারিয়ে গেছেন! মামা শুধু আমাকেই এর ব্যবহার শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। না শেখালেই ভাল করতেন। এখন আমার বয়স একুশ, মনে হয় যেন একাশি! মামার এই সিক্রেট যন্ত্র আর এই ডায়েরি নিয়ে যমুনা নদীতে সুইসাইড করা ছাড়া আমার আর বোধহয় অন্য কোনো পথ খোলা নেই। কয়েকজন অতি ভয়ঙ্কর আর অতি ক্ষমতাবান মানুষের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আমার ওপর। তারা এই যন্ত্রের ক্ষমতা জানে, কিন্তু ব্যবহার জানে না—তাই যতো ঝাপটা সব আমার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।... যমুনার ভাঙন পশ্চিম পাড়ে এ বছর এমন শুরু হয়েছে যে, ভালই হবে সবকিছু তলিয়ে গেলে। আমিও তলিয়ে যাব...।’
পড়ে ঋদ্ধের শরীরটা শিরশির করে উঠল। ঋদ্ধের অস্পষ্টভাবে মনে পড়ল—পাভেল, মেজমামা আর সে খুব ছোটবেলায় একদিন ট্যাপাদার সঙ্গে দেখাও করেছিল। পাভেল বলত ট্যাপাকাকু, আর ঋদ্ধের ট্যাপামামা। সে তো মারা গেছে। শোনা যায়, কী এক রহস্যময় কারণে আত্মহত্যা করেছিল। এটা তাঁরই ডায়েরি! ট্যাপামামার সুমন মামা খুব নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি আত্মহত্যা করেছেন, নাকি হারিয়ে গেছেন কেউ তা জানে না।
ঋদ্ধ ডায়েরিটা প্রথম থেকে পড়া শুরু করল এবং সামান্য একটু এগোতেই সে ডায়েরির অক্ষরের জালে আটকে পড়ল। এই পূর্ণ চাঁদের আলোয় সে স্পষ্টই মোটা হরফে লেখা প্রতিটি বাক্য স্পষ্ট পড়তে পারছিল। জগত্-সংসার ভুলে ডায়েরি-কথিত টপ সিক্রেট কাহিনির গভীরে বুঁদ হয়ে গেল সে। ঠিক দিনলিপি নয়, একটানা আত্মজীবনী ঢঙে লেখা—
“সুমন মামার জন্য আমার ভারি দুঃখ হয়। এখন আমি ক্লাস টেন-এ পড়ি। পনেরো বছর বয়স, সুমন মামার ডায়েরি আর বিস্ময়কর যন্ত্রের বদৌলতে এ জগতের কতো অদ্ভুত রহস্যময় আর মজাদার ঘটনার যে চাক্ষুস সাক্ষী হলাম! আমি এই ডায়েরিটা লিখছি সুমন মামার দেখাদেখি। সুমন মামা সব কথা, সব সুখ-দুঃখ খুব সুন্দরভাবে বিস্তারিত লিখে রাখতেন। তাঁর দেখাদেখি আমিও লিখছি। আমরা আগে বেজায় গরিব ছিলাম। আমি যখন ক্লাস টু-তে পড়ি, তখন একদিন হঠাত্ সুমন মামার কী একটা থিওরি-আবিষ্কার দেশে দেশে খুব হৈচৈ ফেলে দেয়। মামা ছিলেন শুধু নিজের কাছে আর আমার কাছে বিখ্যাত; মামা তখন রাতারাতি সমস্ত জগতের কাছে বিখ্যাত হয়ে যান। আমার মা নেই, বাবাও নেই। একমাত্র প্রিয় মানুষ সুমন মামা। কী এমন মহার্ঘ তিনি আবিষ্কার করলেন যে, সপ্তাহান্তে থেকে-থেকে মামা এদেশ-ওদেশ করে বেড়াতে লাগলেন! সেই সঙ্গে মামা অর্থাত্ আমরা বেজায় ধনী হয়ে গেলাম। বিখ্যাত হওয়ার আগে সারাটাক্ষণ মামা ল্যাবরেটরিতে বসে খুটখাট-খচখচ কী সব করতেন, কী সব লিখতেন এবং একমাত্র আমারই সেখানে ছিল অবাধ প্রবেশাধিকার। এমনকি বড় মামারও না। অবশ্য বড় মামাটা ভীষণ বদমেজাজি। আজ আট বছর হল সুমন মামা বোধহয় চিরতরে হারিয়ে গেলেন, ঠিক আমারই চোখের সামনে। ঘটনাটা আগামীকাল লিখব।
পরের দিনের পৃষ্ঠায়—“খুব বিখ্যাত আর ধনী হওয়ার কিছুদিন পরই মামা কিম্ভূতকিমাকার একটা ভয়াল যন্ত্র (তখন বুঝতাম না, এখন তা হাড়ে হাড়ে বুঝি) রাতদিন খেটে-খুটে তৈরি করেন। আমি প্রায়ই, একটুখানি সুযোগ পেলেই, তাঁর পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখতাম। ওসব কাজের কিছুই বুঝতাম না, তবু মামা কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে এটা-ওটার নানা সহজ-সরল জ্ঞান বিতরণ করতেন। আসলে মামার সঙ্গটাই আমার অসম্ভব ভাল লাগতো। তাই সারাটাক্ষণ আমি তাঁর চারপাশে ছোঁক-ছোঁক করতাম; ঠিক যেমনটি আমার পুষি বিড়ালটা আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।
যন্ত্রটা তৈরি করতে গিয়ে মামাকে প্রায়ই গভীর হতাশায় ভেঙে পড়তে দেখতাম। কয়েকদিন পর আবার নবোদ্যমে কাজে নেমে পড়তেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তখন হঠাত্ হঠাত্ বলতেন, ‘বুঝলি ট্যাপা, খালি হাতে শোল মাছ ধরা কি চাট্টিখানি কথা? আমি দেখলাম, সব কলাকৌশল আমি ভালোই জানি—এবার ঠিক ধরব। তা দেখি বারবার পিছলে হাতফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কী করি বল তো? তুই একটা বুদ্ধি দে দেখি!’
সেদিন মামা, বেলা তখন সকাল এগারোটা, যন্ত্রটা অতি সফলতার সঙ্গে তৈরি শেষ করা মাত্র অসীম ক্লান্তি আর অফুরন্ত উচ্ছ্বাসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে লাগলেন। বললেন, ‘ট্যাপারে, আর কোনো চিন্তা নাই। আজ তোকে জাদু দেখাব। এই জাদু কেউ দেখে নাই।’ জাদু-ই কী? আমার পাশে আমার পুষি বিড়ালটা প্রায়ই ঘুর-ঘুর করতো, ল্যাবরেটরিতে আমার আর মামার ভেতরে তৃতীয় বোধসম্পন্ন উন্নত প্রাণী হিসেবে পুষিকেই মামা হঠাত্ গিনিপিগ বানিয়ে ফেললেন, অর্থাত্ যন্ত্রটার ওপর পুষিকে বসিয়ে যন্ত্রের দরজা বন্ধ করে দিলেন। মাত্রই মিনিটখানেক, দরজা খুলতে না খুলতেই পুষি মাটিতে নেমেই চিতপটাং।
আমার প্রাণটা ছ্যাঁত্ করে ওঠে—মরল না তো! না, সেকেন্ড কতক ওরকম ঢং শেষে পুষি লেজ উঁচিয়ে ত্রাহি চিত্কারে এমন দৌড় মারল যে, আর কখনও সুমন মামা এবং এই ল্যাবরেটরির ত্রিসীমানায় ঘেঁষার সাহস পায়নি। বেচারী! মামা ভয়ানক অবাক হলেন। এমন তো হওয়ার কথা নয়! স্বয়ংক্রিয়ভাবে, সম্ভবত, যন্ত্রটা সেট করে মামা এবার স্বয়ং গিনিপিগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন; অর্থাত্ যন্ত্রটির ভেতরে নিজেই প্রবেশ করলেন। যন্ত্রটির দরজা বন্ধ হওয়ার আগে আমি স্পষ্ট দেখলাম মামার চোখে নীল আতঙ্কের ঝাপটা। যেন অ-ন-ন্ত-কাল পর যন্ত্রটির মুখ খুলল; ততোক্ষণে, আমাকেও আতঙ্ক গ্রাস করল যেন। দরজা খোলামাত্র মামা নয়, যেন আমিই নবজীবন ফিরে পেলাম। মামা হাসতে হাসতে বেরুলেন। বললেন, ‘কতোক্ষণ আটকে ছিলামরে ট্যাপা?’
টু-তে পড়লে কী হবে, মামার প্রশ্রয়ে আমি টোটকা বিজ্ঞান-জ্ঞানে ইঁচড়ে পাকা হয়ে গিয়েছিলাম। ঘড়ি দেখা তো অতি নস্যি মাত্র, আলো কেন সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার বেগে দৌড়ানোর ক্ষমতা রাখল, আর তাতে করে জগতের কী কী মহান লাভ বা ক্ষতি হল—তার একটা খসড়া হিসাব মামা আমাকে জলবত্ তরলং করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমার এই ইঁচড়ে-জ্ঞান দেখে বড় মামা একদিন অপমান বোধ করে সুমন মামার কাছে বললেন, ‘হ্যাঁ রে সুমন, কাল রাতে ট্যাপা আমাকে আকাশের একটা লাল তারা দেখিয়ে বলল—তারাটা নাকি এখন আর বেঁচে নেই, অথচ আরও কয়েক কোটি বছর নাকি ওটার আলো দেখা যাবে! শুনে আমার এমন রাগ হল! আমার সঙ্গে ফাজলামো! আষাঢ়ে গল্পের ডিপো নিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলা? দিয়েছি কষে একখানা চড়। তা, ট্যাপা ভ্যাঁ করে কেঁদে-কেটে বলল, শোনো গিয়ে সুমন মামার কাছে। জানো তো না আলোকবর্ষ কী? কৃষ্ণগহ্বর কী? এই কৃষ্ণগহ্বরের এক চামচ মাটি তোমার মাথার ওপর এনে ঢেলে দিলে তুমি তার ভারে মাটি ফুঁড়ে পাতালে চলে যাবে! এমনসব আজেবাজে কথা বলল ট্যাপাটা। বোঝ কী বেয়াদব! তা, সত্যি নাকি রে?’
সুমন মামা গম্ভীর স্বরে বললেন— ‘হু, ট্যাপাকে মেরে দাদা তুমি মোটেই ঠিক করোনি। ও কিচ্ছুটি মিথ্যা বলেনি। যা তুমি জানো না, তা শুনলেই কি সবসময় আষাঢ়ে গপ্পো ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে? দেখো দাদা, ট্যাপা একদিন ঠিক...’
বড় মামা অপমানে বললেন, ‘বুঝেছি বুঝেছি—দেখছি তো তার নমুনা। এই ছোট ক্লাসেই কিনা এক বিষয় বাদে বাকি বিষয়ে ফেল! তা ব্যাপারটা ভেঙেচুরে আমাকে একটু বোঝা দেখি—ওই আলোর বছর আর কালো-গর্তটা ঠিক কী জিনিস। যা দেখা যাচ্ছে অথচ তা নাকি এখন আর নেই!’
সুমন মামা অসীম ধৈর্য নিয়ে একটুখানি বোঝানো শুরু করা মাত্র বড় মামা বারকয়েক বড় করে হাই তোলেন; তারপর হাঁ-করা মুখের সামনে তুড়ি মেরে ঝিমানো দৃষ্টিতে বলেন, ‘ওরে সুমন, বাকিটা কালকে শুনব; এখন যাই, তোতাটাকে আবার ছোলা খাওয়াতে হবে।’
যাই হোক, প্রথমে যা লিখেছিলাম, সুমন মামা জিজ্ঞেস করলেন, কতোক্ষণ তিনি যন্ত্রটার ভেতরে আটকে ছিলেন? আমি বললাম, হিসাব কষে— ‘সতেরো মিনিট পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড। টেনশনে দশ সেকেন্ডের গণ্ডগোল পাকিয়ে গেছে।’
মামা আকর্ণ হেসে তাঁর কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটা আমার সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘কতো বাজে বল তো?’
‘এগারোটা বেজে একচল্লিশ মিনিট।’
‘আর দেওয়াল ঘড়িতে?’
‘এগারোটা বেজে সাতচল্লিশ।’
‘মামা! দেওয়াল ঘড়ি ছ’মিনিট ফাস্ট কেন?’
মামা মুচকি মুচকি হাসলেন, ‘এটাই তো আবিষ্কার।’
আমি এবার তাচ্ছিল্যে বললাম, ‘এই আবিষ্কার! এটা তো আমিও পারি। সেদিন একটা ম্যাগনেট তোমার হাতঘড়ির তলায় রাখলাম আর অমনি ঘড়ি বন্ধ! এবার তুমি ছ’মিনিট পর ম্যাগনেট সরিয়ে নাও—তোমার ঘড়ি ছ’মিনিট স্লো হয়ে যাবে।’
মামা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘শাবাশ!’
এখন অবশ্য বুঝতে পারি ওটা ছিল ব্যঙ্গ করে বলা। আমি হঠাত্ প্রবল বিস্ময়ে বললাম, মামা তোমাকে তো কোনোদিন ডান হাতে ঘড়ি পরতে দেখিনি, এখন কেন পরেছ?’
মামাও যুগপত্ বিস্ময়ে বাঁ হাত তুলে বললেন, ‘কই ডান হাতে ঘড়ি?’
‘মামা, তুমি বাঁ হাতকে ডান হাত বলছ?’
মামা অবাক বিস্ময়ে বাঁ হাত চোখের সামনে মেলে ধরে বিড়বিড় করে বললেন, ‘এটা আমার বাঁ হাত! কিন্তু ডান হাত-ডান হাত মনে হচ্ছে কেন?’
হঠাত্ আমি আবার চিত্কার করে বললাম, ‘মামা! তোমার বাঁ কপালের আঁচিলটা ডান কপালে কী করে এল?’
মামা বিরাট ধন্ধে পড়লেন। সেই থেকে মামা ডান হাত দিয়ে লিখতে শুরু করলেন, অথচ অতীতে কোনো কালেও বাঁ হাত ছাড়া তিনি ‘ক’টি পর্যন্ত লেখেননি। বসতেন আগে ডানপাশ ঘেঁষে, এখন থেকে বসা শুরু করলেন বাঁ-পাশ ঘেঁষে। হাসলে আগে বাঁ চোখটা একটু ছোট হয়ে যেত—এখন ডান চোখ। একগালে একটুখানি টোল পড়ত, সেটাও জায়গা বদল করল। কী আশ্চর্য! মামা মাত্র সতেরো মিনিট সামথিং সময়ের ব্যবধানে চিরতরে উলটে গেলেন!
একদিন মামা আমাকে শরীরবিদ্যা থেকে প্রশ্ন করে বললেন, ‘বল তো ট্যাপা, মানুষের হূিপণ্ড কোন সাইডে থাকে?’
উত্তরটা আমার জানা—বাঁ পাশে। হঠাত্ আমি মামাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা, তোমার হূিপণ্ড কি ডান পাশে? অ্যাপেন্ডিক্স বাঁ পাশে?’
মামা চোখ গোল গোল করে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘শাবাশ ট্যাপা, শাবাশ!’ আদরে মামা গাল টিপে দিলেন। আহ্লাদে আমি গদগদ হয়ে পড়লাম! কিন্তু এমন আদর আমার বেশিদিন আর কপালে সইল না। এই ঘটনার মাত্র ছ’মাস পর মামা চিরতরে বোধহয় হারিয়ে গেলেন, ঠিক ওই যন্ত্রটির ভেতরে, আমারই চোখের সামনে!
সুমন মামার পেপার-পেন-মার্কা তত্ত্ব আবিষ্কারটাই আমাদের সবচেয়ে বড় কাল হয়ে দাঁড়াল। মামা রাতারাতি বিখ্যাত এবং ধনী বনে গেলেন। অথচ মামা যদি এতো টাকার মালিক না হতেন, তা হলে কোনোমতেই এমন কিম্ভূতাকার যন্ত্রটি তৈরি করে উঠতে পারতেন না। যন্ত্রটা আসলে কিছুই নয়, সায়েন্স ফিকশন গল্পের ফালতু একখানা ‘টাইম মেশিন’!—অমাবস্যার চাঁদের মতো ধাঁধালো; যার অস্তিত্ব কাগজে-কলমে আছে—কিন্তু বাস্তবে তা দেখা পাওয়া বা আবিষ্কার প্রায় অসম্ভব। কে না জানে, অমাবস্যার সন্ধ্যারাতে চাঁদ ঠিকই পশ্চিম আকাশে থাকে কিন্তু সূর্যের যে আলোয় চাঁদমামাকে দেখতে পাই, সেই আলোটা আমাদের, মানে, পৃথিবীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে—তাতে করে কি চাঁদের অস্তিত্ব শূন্য হয়ে যায়? মামার মতে, টাইম মেশিন তত্ত্বগতভাবে আলবত্ সম্ভব, যেমন সম্ভব মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পরম তাপমাত্রায় পদার্থের তত্ত্বগত পরম অবস্থা; কিন্তু বাস্তবে কে তা তৈরি করতে পেরেছে? কিন্তু মামা যে পারলেন। আর সর্বনাশ ডেকে আনলেন।
এখন আমি ক্লাস টেন-এ পড়ি। মামাকে যখন ওই টাইম মেশিনটার ভেতরে চিরতরে হারিয়ে ফেলি, তখন আমি নিতান্তই আট বছরের শিশুমাত্র। কিন্তু মামার সঙ্গে ন্যাওটা হয়ে থেকে আর পরবর্তীকালে মামার ডায়েরি পড়তে পড়তে ডায়েরির অন্তত পাঁচ শতাংশ জ্ঞান আমি আত্মস্থ করে ফেলেছি!
মামার টাইম মেশিনটা অদ্ভুত। দরজা খোলা অবস্থায় মামা সামান্য সময়ের জন্য আমাকে একদিন তার ঘরের ভেতরে বসিয়েছিলেন। একবারই মাত্র। আমার পুষি বিড়ালটা কেন ওটাকে যমালয়ের মতো জ্ঞান করেছিল, তা আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম; তার কারণটাও এখন আমার অজানা নয়। আসলে টাইম মেশিনের পাটাতনে দাঁড়ালে সুইচ অন করা মাত্র ওটা মাধ্যাকর্ষণ-শূন্য পরিবেশে পরিণত হয়। অর্থাত্ যে কোনো বস্তু পুরোদস্তুর ওজন-শূন্য হয়ে পড়বে। সে এক ভয়ংকর বিভীষিকাময় অনুভূতি। আর দরজা বন্ধ করতেই তা আলোর গতির সঙ্গে প্রায় অর্ধাঅর্ধি অনুপাতের অতি জটিল একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। মামার ডায়েরি পড়েই জেনেছি—আমি যদি আলোর গতির বেগে দশ বছর অবস্থান করার পর বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে আসি, তা হলে আমার বয়সের সঙ্গে দশ বছর যোগ হবে না। অর্থাত্ আমার আট বছর বয়স আট-ই থাকবে অথচ আমার সমবয়সী সবাই দশ যোগে আঠারো বছরে পরিণত হবে। কী অদ্ভুত!
সেদিন মামার রিস্টওয়াচের টাইম ছ’মিনিট কমে গিয়েছিল—তার কারণ, সতেরো মিনিট টাইম মেশিন জার্নিতে মামার গতিবেগের অনুপাত ছিল আলোর গতির তিনভাগের প্রায় এক ভাগ। আর এভাবে অতি সহজেই মামা অতীতে অবস্থান করতে পারতো, অর্থাত্ সময় চলতো ভবিষ্যত্মুখী অথচ মামা প্রায় শূন্য বা ধীরগতির ভবিষ্যতে অবিচল অবস্থান করতে পারতো। তারপর ঘটল মামার এক বিধ্বংসী মনোবাসনার বাস্তব রূপ। মামা ভবিষ্যেক জাম্প করতে চাইলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অনেক খেটে-খুটে একদিন ঘোষণা করলেন, তার দুই মাত্রার টাইম মেশিন সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। দুই মাত্রা—অর্থাত্ অতীতেও যেতে পারবে এবং ভবিষ্যতেও।
আমার খামখেয়ালি সুমন মামা প্রথমে আমার পুষিটাকে আবার গিনিপিগের মতো ব্যবহার করে ভবিষ্যতে পাঠানোর পরীক্ষা চালালেন, তারপর নিজেই...। ভাবলেই আমার গলায় কান্না আটকে আসে।
মেশিনে প্রবেশের আগে মামা বীরদর্পে বলে গেলেন, ‘ভয় পাসনে ট্যাপা, একটু দেরি হতে পারে—কিন্তু ঠিক আমি ফিরে আসব।’
একটু দেরি মানে এতোটা? আট বছর?
আমাদের বাড়িতে যে ক’জন সদস্য আছে— তাদের প্রায় সবারই অদ্ভুত এক ভীতি কাজ করে, রহস্য আর জটিলতাকে তারা ভীষণ ভয় পায় এবং সুমন মামার ঘরের সব যন্ত্রপাতিই রহস্যের আঁতুরঘর—তাই পারতপক্ষে, একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউই ছোট মামার ঘরে ঢোকার সাহস পায় না। মামার অন্তর্ধান রহস্য আমি কাউকে বলিনি; মামাই বলতে নিষেধ করে গিয়েছিলেন। অবশ্য বললেও মনে হয় না কেউ আমাকে বিশ্বাস করত! অন্তর্ধানের ছ’মাসের মধ্যে দু’জন পুলিশ এসে বড় মামার সঙ্গে কী-সব কথা বলে গিয়েছিলেন। সুমন মামার ল্যাবরেটরিতেও একটিবার ঢুঁ মেরে গিয়েছিলেন—ওই পর্যন্তই সব। ভালোই হয়েছে। ল্যাবরেটরির চাবিটা আমার কাছেই থাকে। আমি প্রায় প্রতিদিনই ওর যন্ত্র গুদামটার ভেতরে তিন-চার ঘণ্টা কাটাবই। প্রায় প্রতিদিনই দরজা খোলার সময় আমার বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে—দরজা খুলেই হয়তো দেখবো সুমন মামা অন্যমনস্ক হয়ে কোনো একটা কাজ গভীর মনোযোগের সঙ্গে করছেন। আমাকে দেখেই চোখ না তুলে তাকিয়ে বলবেন—‘ট্যাপা দেখি লম্বায় তালগাছ হয়ে গেছিস! তা আমাকে এতোক্ষণ ধরে আটকে রাখলি? এদিকে কতো কাজ বাকি। গভীর রাতে তোদের ‘বর্তমানে’ ফিরে এলাম—আর এই পড়ন্ত বেলা পর্যন্ত আমায় তালাবদ্ধ করে রাখলি? বড্ড খিদে পেয়েছে রে...’
আমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়! ধুলো-বালি, আরশোলা আর মাকড়সার জালের অভিনব প্রদর্শনী কেন্দ্র হয়ে উঠছে এই রহস্য কুঠুরিটা। পরিষ্কার করতে ভয় হয়—মামা যদি ফিরে এসে মন খারাপ করে বলেন, অসাবধানে আমার ‘এই’টা আমার ‘ওই’টা তুই নষ্ট করে ফেললি ট্যাপা? তাই যেমন আছে তেমনই থাকুক। কিন্তু আমার কৌতূহলও যে বড্ড মাত্রাতিরিক্ত! বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগটার উপসর্গ আরও বেড়ে যাচ্ছে। আসলে মামার ডায়েরি পড়ে খেয়াল করলাম, টাইম মেশিনটার হরেক রকমের কার্যকারিতা রয়েছে। তার মধ্যে একটা খুবই বিচিত্র। অতীতের বা ভবিষ্যতের কোনো বস্তু বা প্রাণীকে কয়েক মিনিটের জন্য বর্তমানে নিয়ে আসা সম্ভব। ব্যাপারটা খুবই জটিল। যতোই জটিল হোক, ব্যাপারটা একবার পরখ করে দেখতেই হবে। প্রবল জেদবশত আমি মামার ডায়েরিতে অনুপুঙ্খ লেখা যন্ত্র ব্যবহারের নিয়ম-কানুন বেশ ভালমতো আত্মস্থ করে কাজে লেগে পড়লাম। তারপর প্রতিটি শর্ত মেনেও কুড়ি-পঁচিশ বছরের ভবিষ্যত্ কোনো বস্তু বা প্রাণী টাইম মেশিনটা কিছুতেই আনতে পারলাম না। ধুর ছাই! ভাঙা আবর্জনা কোথাকার! মন খারাপ করা গালি দিয়ে যন্ত্রটির যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে রণে ভঙ্গ দিলাম এবং পরেরদিন অন্তিম চেষ্টায় হঠাত্ মাত্র সেকেন্ড দশেকের জন্য অসম্ভব একখানা কাণ্ড ঘটল! টাইম মেশিনের দরজা খুলতেই দেখি, আমাদের এলাকার সংবাদপত্রের হকার নিতাই কাকা একমনে মেশিনের পাটাতনে বসে পেপার গোছাচ্ছেন। নিতাই কাকার বয়স এখন পঞ্চাশ-একান্ন-—যথেষ্ট জোয়ান লাগে, অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে থুত্থুরে অশীতিপর বুড়োর মতো। আমি এতোটাই অবাক হলাম যে, আমার মুখ থেকে ফিসফিস শব্দে বেরিয়ে এল, ‘নিতাই কাকা!’
নিতাই কাকা চমকে উঠে ‘কে?’ বলে আমার দিকে তাকাতেই ‘আঃ!’ করে প্রবল আতঙ্কের একখানা চিত্কার জুড়ে দেন এবং ভয় পেয়ে আমিও তত্ক্ষণাত্ দরজাটা বন্ধ করে দিই। কয়েক মিনিট পর দরজা খুলতেই দেখি নিতাই কাকা হাপিস—অর্থাত্ পালিয়ে গেছেন কিন্তু...? কী বিস্ময়কর! নিতাই কাকা যে পেপারগুলো গোছাচ্ছিলেন, তা টাইম মেশিনের পাটাতনে পড়ে রয়েছে! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো অতি ধীরে পেপারগুলো হাতে তুলে নিলাম। পনেরোটা বাংলা আর নয়টা ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র! সাল ২০০১, ১৫ সেপ্টেম্বর।
আমার ভারি মন খারাপ হল—আহা! বেচারা নিতাই কাকা! নুন আনতে পান্তা ফুরোনো অবস্থা যার, এতোগুলো টাকার ক্ষতি তার সহ্য হবে কীভাবে? বেচারার ২০০১-এর ১৫ সেপ্টেম্বর দিনটা না জানি কতো খারাপ কাটবে! হঠাত্ বাংলা সংবাদপত্রটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই আমি চমকে উঠলাম। ১১ সেপ্টেম্বরের পৃথিবী তোলপাড় করা এক ঘটনা ঘটেছে। আজ থেকে আট বছর পর সারা পৃথিবীর বিশেষ পরিবর্তন আর বিবিধ বিস্ময়কর প্রতিটি ঘটনার নির্ভুল ও স্পষ্ট ছবি আজ আমার কাছে প্রকাশিত হয়ে গেল। ফরাসি ভবিষ্যত্ বক্তা মিশেল নস্ট্রাদামুসের মতো প্রবল পরাক্রমশীল একজন ভবিষ্যত্ বক্তা হিসেবে আমি অতি সহজেই বিশ্ব মাত্ করতে পারি। কিন্তু এসব কোনোকিছুর প্রতিই আমার বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ নেই। সুমন মামার জন্য আমার মন-প্রাণ দিনদিন ক্রমেই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। আগে সুমন মামা ফিরে আসুক— তারপর অন্য সব কথা।
আমি পরের দিনই পেপারগুলো যমুনায় খণ্ড খণ্ড করে ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। কিন্তু পরের মাসে আমার জন্য বড় একটা দুর্যোগ অপেক্ষা করছিল। টাইম মেশিনে অসম্ভব রকমের বিদ্যুত্শক্তি খরচ হয়, ওইটুকু সময় চালানোর দরুন পরের মাসে খুব বড় অংকের ইলেকট্রিক বিল আসে। আমার অতি কঞ্জুস বড় মামা বিল হাতে পেয়ে চেঁচামেচি-চিত্কারে পুরো বাড়িটা মাথায় তুলে ফেলেন। কীভাবে জানি ঠিক ধরে ফেলেন যে, ল্যাবরেটরিতে আমার অযথা অপকর্মের কারণে বিদ্যুত্ বিলের এই দশা। সুতরাং ল্যাবরেটরির দ্বার আমার জন্য চিরতরে ক্লোজড করে দিলেন বড় মামা। কিন্তু তা-ই কী হয়! আমার কাছে যে ডুপ্লিকেট চাবি তৈরি করা জলের মতো সহজ। মামা যখন বাড়িতে থাকতেন না, সেই ফাঁকে প্রতিদিন আমি যন্ত্রঘরে একটি বারের জন্য ঢুঁ মেরে আসতাম। পরে এমন ব্যবস্থা করলাম যে, মামা বাড়িতে থাকলেও যন্ত্রঘরে যখন-তখন আমি চলে যেতাম। অথচ বাইরে থেকে ল্যাবরেটরিটাকে ঠিক তালাবদ্ধ নিঃসঙ্গ কুঠুরি বলেই মনে হতো।
সুমন মামার ডায়েরি পড়তে পড়তে আরও বড় আরও ভয়ংকর একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য আমার কৌতূহলী মন ছটফট করতে লাগল। বড় মামার রক্তচক্ষু আর অজানা বিপদ-আপদেও আমার কৌতূহলী জেদী মন কিছুতেই পিছু হটল না। অবশেষে ঘটল আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা।
টাইম মেশিনের মাধ্যমে আজ থেকে প্রায় তিন শ’ বছর পরে একজন মানুষকে আমি ১৯৯৫-এর অতীতে টেনে নামিয়ে আনি। সে তখন একমনে আমার মতো এরকম একখানা দিনলিপি লিখছিল; নিতাই কাকার মতো এই মেয়েটিও হঠাত্ আমাকে দেখে চমকে ওঠে—‘কে তুমি?’ বলে বিস্ময়ে মুখ ঢাকে। হাত থেকে তার কলম ছিটকে পড়ে। আমি স্পষ্ট দেখলাম—মেয়েটার চোখে জল। সে কাঁদছিল। দরজা বন্ধ করতেই মেয়েটা উধাও হয়ে যায় এবং যথারীতি পড়ে থাকে তার লেখা ‘ডায়েরি’ আর ‘পেন’টা।
মেয়েটি যে আমার চাইতে প্রায় সাত-আট বছরের বড়—ডায়েরির শুরুতেই একটু প্যাঁচানো অক্ষরে লিখেছে— আর মাত্র নয় দিন? নয় দিন?? নয় দিন??? তারপর সুইফ্ট টাটল ধূমকেতুর আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে তাবত্ পৃথিবী। সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের ব্যবধানে মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে মানবসভ্যতার সবটুকু! ঠিক যেভাবে বিংশ শতকে ধূমকেতু শুমেকার লেভি-৯ ঢুকে পড়েছিল বৃহস্পতির কক্ষে এবং...।’
আমার ডায়েরিতে মেয়েটির ডায়েরির কথা বিস্তারিত লেখার কোনো মানে হয় না। কিন্তু এ কী ভয়ানক কথা! আমাকে বিস্তারিত সব জানতে হবে, পড়তে হবে... আজ রাতেই।’’
এখানে এসে শেষ হয়ে গেছে ডায়েরির কাহিনি।
ডায়েরিটা বন্ধ করে ঋদ্ধ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এ কি সত্যি? ট্যাপা মামা মারা গেছেন। এই যমুনা নদীতেই। আর তার লেখা ডায়েরি এখন ঋদ্ধের হাতে। কী এক অজানা কারণে ঋদ্ধের শরীর শিরশির করে উঠল। ঋদ্ধ হঠাত্ খেয়াল করল কোনো এক আধিভৌতিক কারণে তার চোখের দৃষ্টিশক্তি যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে। ডায়েরির আবার খুলে দেখতেই অক্ষরগুলো যেন ঝাপসা হতে শুরু করল! ঋদ্ধ নদীর পশ্চিম দিকে মুখ করে বসে পড়ছিল; পেছনে, পুব দিকে তাকাতেই ভয়ে তার মুখে রক্ত জমে গেল—অতি উজ্জ্বল চাঁদখানা একখণ্ড কৃষ্ণঘন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে ক্রমশ। চারদিকে অন্ধকারের গাঢ় ছায়া!
সে শুনেছে—অতৃপ্ত প্রেতাত্মা মানুষকে হঠাত্ হঠাত্ বেশি সাহসী করে তোলে তাদের আখড়ায় অতি সহজে নিয়ে আসার সুবিধার্থে। সে তো কোনোদিন এতো সাহসী ছিল না! তাহলে সে কি আজ অতৃপ্ত প্রেতাত্মাদের আখড়ায় নিজের অজান্তে ক্রমেই আটকে পড়েছে? আতঙ্কে স্বগতভাবে ঋদ্ধ মাটিতে বসে পড়ল এবং তখনই সে স্পষ্ট শুনতে পেল, কে যেন তার ঘাড়ের পেছনে খুব সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ঋদ্ধ ‘কে?’ বলে চিত্কার করে উঠে দাঁড়াল।
ডায়েরিটা কি সে ছুঁড়ে ফেলে দেবে?
এমন সময় দূরে সে পাভেলর গলা শুনতে পেল—তার নাম ধরে চিত্কার করে ডাকছে। আহ! কী সুমধুর পাভেলের গলা!
ঋদ্ধ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।