চিত্রনায়িকা শাবানা দীর্ঘ নিবাসে আছেন আমেরিকায়। সেখানে অদ্ভুত এক রহস্যের জালে রয়েছেন শাবানা। মিডিয়ার সাথে কোনো কথা বলেন না। দীর্ঘ প্রায় ২ যুগ কোনো ইন্টারভিউ প্রকাশ হয়নি। নতুন ফটোশুট নেই। একেবারে নিজস্ব জগতেই আসীন তিনি যেন। বাংলাদেশের মহানায়িকা শাবানার সেই সব কথা আর তার একান্ত সাক্ষাত্কারের বিচ্ছিন্ন অংশ নিয়েই ইত্তেফাক ঈদসংখ্যার এই বিশেষ আয়োজন।
আমেরিকার দিনলিপি
হাসানুজ্জামান সাকী, নিউইয়র্ক থেকে
শাবানা বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পের জীবন্ত এক কিংবদন্তি। সত্তর থেকে আশির দশক, যে সময়টাকে চলচ্চিত্রশিল্পের স্বর্ণযুগ বলা হয়, সেই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সবাইকে পেছনে ফেলে শাবানা হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত সম্রাজ্ঞী। তখন শাবানার হূদয়ছোঁয়া অভিনয় মানেই সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের চোখে জল। আর দর্শকদের চোখে জল মানেই ছবি সুপারহিট। মমতাময়ী চরিত্রে শাবানার অভিনয় তাঁকে দর্শকহূদয়ে আজো রানির আসনে স্থায়ী করে রেখেছে। অভিনয় থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে গেলেও শাবানাকে যেমন দর্শক ভুলতে পারেননি তেমনি চলচ্চিত্রশিল্পেও তাঁর অভাব পূরণ হয়নি। ‘বিউটি কুইন’খ্যাত শাবানার মতো সব ধরনের চরিত্রে সফল অভিনেত্রীর অভাব যেন পূরণ হবারও নয়।
টালিগঞ্জের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পথেই যেন হাঁটছেন বাংলাদেশের বিউটি কুইন শাবানা। চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়েছেন পনের বছরেরও বেশি সময় আগে। একটানা ৩৪ বছর দাপটের সাথে কাজ করে ১৯৯৭ সালে তিনি আর সিনেমা না করার ঘোষণা দেন। এরপর ২০০০ সাল থেকে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শাবানা যে শুধু চলচ্চিত্র থেকেই বিদায় নিয়েছেন তা নয়—বলা যায়, নিজেকে নিয়ে গেছেন একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। অনেকেই বলেন, আমেরিকায় ‘স্বেচ্ছানির্বাসন’ কাটাচ্ছেন বাংলাদেশের মহানায়িকা। কিন্তু কেন তাঁর এই চলচ্চিত্র ছেড়ে দেওয়া, এই নির্বাসন কিংবা একেবারেই অন্তরালে চলে যাওয়া—এর উত্তর আজো মেলেনি। দিন দিন এ রহস্য আরো ঘণীভূত হয়েছে।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি। বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শাবানার বড় মেয়ে সুমি আমেরিকায় নিখোঁজ হয়েছিলেন বলে কথিত আছে। পুলিশ তন্নতন্ন করে তার খোঁজ চালায়। জলে স্থলে এমনকি আকাশ পথে হেলিকপ্টারে করে চলে সন্ধান। শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ছাড়াই সন্ধান মেলে শাবানার মেয়ের। এদিকে, মেয়ের নিখোঁজ সংবাদে দিশেহারা হয়ে পড়েন শাবানা। মনে মনে ঠিক করেন, মেয়েকে ফিরে পেলে জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু ত্যাগ করবেন। এরপর আর কিছু জানা যায়নি। এর কিছুদিন বাদে আচমকা চলচ্চিত্র ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়িকা শাবানা। এরপর গুজব-কল্পনা আর ঘটনা-বাস্তবতার মাঝামাঝি বসে হিসাব মেলাতে বসে যান বাংলাদেশের দর্শকরা। যোগ-বিয়োগের ফলাফল হিসাবের খাতায় যা-ই হোক না কেন, বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশের মানুষ দেখল, তাদের প্রিয় নায়িকা আর ফিরে এলেন না রুপালি পর্দায়।
গত পনের বছরে ধারাবাহিক বিরতিতে মাঝে মাঝেই খবরের শিরোনাম হয়েছেন শাবানা। গত বছর অর্থাত্ ২০১৩ সালের জুলাইয়ে খবর বেরোয়, আমেরিকায় এক ঘরোয়া আড্ডায় শাবানা বলেছেন, নিউ ইয়র্কের স্থানীয় টিভি চ্যানেলে ও বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোতে রমজান মাসে তাঁর সিনেমা যেন না প্রচার করা হয়। এমনকি সম্ভব হলে কখনোই যেন তাঁর আর কোনো ছবিই না চালায় সেই অনুরোধও করেন টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে। দীর্ঘ অন্তরাল-জীবনে শাবানা খুব কমই লোক-চক্ষুর সামনে এসেছেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে খবর হন তিনি। সেবার, যশোরের কেশবপুরে স্বামীর নাম অনুসারে বসতবাড়ি ‘সাদিকভিলা’র উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। সেখানে ২০ শতক জমির ওপর ছাত্রনিবাসসহ একটি আধুনিক মাদ্রাসা নির্মাণের কাজও শুরু করেন তিনি। কোনো ফিল্ম ইনস্টিটিউট দূরে থাক, এমনকি স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিও নয়, আবাসিক মাদ্রাসা বানাচ্ছেন একসময়ের পর্দা কাঁপানো নায়িকা! যদিও এর অনেক আগেই তাঁর জীবনযাপন সম্পর্কে শোনা যাচ্ছিল, শাবানার ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসারী হয়ে ওঠার কথা।
একবার কী কাজে যেন গিয়েছিলেন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ২০১২ সালে। ছিলেন ঘণ্টাখানেক, তাও বোরখার আড়ালে। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার খবর হয়ে যান। বাংলাদেশের পাবনায় জন্ম নেওয়া কলকাতা ছবির মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মৃত্যুতে শাবানা ভীষণভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন—এ বছরের শুরুতে এমন খবরও বেরোয় পত্রিকার পাতায়। বেশ কিছুদিন আগে আরেকবার খবর হয়েছিলেন শাবানা। সহকর্মী এক চিত্রনায়কের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন। সেবারই প্রথম অনেকে তাঁকে সরাসরি দেখতে পেয়েছিলেন—সে এক অচেনা, ভিন্নধর্মী শাবানা। বোরখায় ঢাকা সারা শরীর, শুধু মুখটা দেখা যায়। আহা, সেই লাবণ্যমাখা মুখ!
বেশ কিছুদিন পর আবার খবর হলেন সম্প্রতি। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, শাবানা চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসছেন। ২/৩ বছর আগেও একবার এমন খবর বেরিয়েছিল। বলা হয়েছিল, মৌসুমী-শাবনূর এক সাথে অভিনয় করবেন শাবানার ছবিতে। কিন্তু খবরটি জল্পনা-কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কী হয়নি তাঁকে নিয়ে, কল্পনায় শাবানাকে রাজনীতিতেও নামিয়েছেন কেউ কেউ। সবই মিডিয়া গসিপ।
অনেকে জানেন, শাবানা থাকেন নিউজার্সিতে। আসলে, একসময় সেখানে থাকতেন তিনি। তাঁর ছোট বোনও থাকেন সেখানে অনেক বছর। তিন-চার বছর আগেই শাবানা নিউজার্সি থেকে চলে আসেন। বসবাস শুরু করেন কানেকটিকাটে। শোনা যায়, এখন স্থায়ী হয়েছেন বোস্টনে। ম্যাসাচুসেটস স্টেটের রাজধানী বোস্টন আমেরিকার এডুকেশন সিটি। সেখানে বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ লিটারেচারে পিএইচডি করছেন তাঁর ছোট মেয়ে ঊর্মি। মেয়ের কাছাকাছি থাকতেই তিনি বোস্টনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। বড় মেয়ে সুমি লেখাপড়া শেষ করেছেন আমেরিকায়। তার বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। সুমির দুটি সন্তান। নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশ ভালোই সময় কেটে যায় একসময়ের ব্যস্ত নায়িকার। ছোট ছেলে নাহিন পড়েন অ্যাকাউন্টিংয়ে। তারও দেখাশোনা করতে হয়। স্বামী ওয়াহিদ সাদিকও এখন বেশির ভাগ সময়ই থাকেন আমেরিকায়। পর্দার সেই চিরায়ত বাঙালি নারী—যে কি-না কখনো প্রেমিকা, তারপর প্রিয়তমা স্ত্রী আবার মমতাময়ী মা, পর্দার সেই দর্শকপ্রিয় নায়িকার বাস্তব চরিত্রে শাবানা এখন অভিনয় করে চলেছেন জীবনছবিতে।
নিউজার্সিতে যে নেই অনেক বছর, এ খবর যেমন নেই কারো কাছে তেমনি কানেকটিকাট হয়ে এখন বোস্টনে যে থাকছেন তাও জানেন না কেউ। এমনই এক অন্তরালে শাবানার জীবনযাপন। প্রিয় নায়িকাকে একনজর দেখা পাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে তো বটেই, কোনো সাংবাদিকের পক্ষেও প্রায় অসম্ভব। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে সুখেই আছেন তিনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়েও তেমন একটা আগ্রহ নেই তাঁর। বড় পর্দার সেই শাবানার সঙ্গে এখন বাস্তবের শাবানার কোনোই মিল নেই। একান্ত ঘনিষ্ঠজনদের সাথে কথা বলে জানা যায় এসব তথ্য। ফুলহাতা কামিজ আর সবসময় হিজাব-পর্দায় নিজেকে সম্পূর্ণ পালটে ফেলেছেন একসময়ের বিউটি কুইন। বাইরে বের হলে সবসময় বোরখা পরে থাকেন। এমনিতে বোস্টনে বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনেক কম। তাও শপিংমলে কিংবা গ্রোসারিতে কেনাকাটা করতে যান—এমন জায়গায় যেখানে বাংলাদেশিদের আনাগোনা একেবারেই নেই। বাংলাদেশি কমিউনিটির কোনো অনুষ্ঠানে কখনোই যাননি তিনি। পারিবারিক অনুষ্ঠানেও অংশ নেন না খুব একটা।
নিজের চলাফেরায় বা বেশভূষায় শুধু নয়, একেবারে পারিবারিক গণ্ডিতেও শাবানা ইসলামি অনুশাসন মেনে চলেন অক্ষরে অক্ষরে। ছেলেমেয়েদের প্রতিও কড়া শাসন তাঁর। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়েন। রমজানে একটি রোজাও মিস করেন না কখনো। হজও করে এসেছেন অনেক বছর হলো। মাঝে মাঝে স্বদেশের টানে বাংলাদেশে যান আবার চলেও আসেন আমেরিকায়। দেশেও একেবারে কাছের আত্মীয়স্বজন ছাড়া কারো সঙ্গে দেখা দেন না। জানা গেছে, এখন তিনি বাংলাদেশে আছেন। রমজানের আগে বাংলাদেশে গেছেন। ফিরবেন ঈদের পর।
শাবানা ১৯৫২ সালের ১৫ জুন ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক নাম আফরোজা সুলতানা রত্না। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামে। বাবা ফয়েজ চৌধুরী ছিলেন চিত্রপরিচালক। মায়ের নাম ফজিলাতুন্নেসা। মাত্র নয় বছর বয়সে ১৯৬২ সালে ‘নতুন সুর’ ছবিতে ছোট্ট একটি মেয়ের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর চলচ্চিত্রে আগমন রত্না নামে। এই নামে আরো কয়েকটি ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। এরপর ১৯৬৬ সালে ‘চকৌরী’ ছবিতে শাবানা নামে আত্মপ্রকাশ করেন। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক ওয়াহিদ সাদিককে বিয়ে করেন ১৯৭৩ সালে। মোট ১০ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে এই রেকর্ড আর কারো নেই।
চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়েছেন সেই কবে। ১৯৯৭ সালের পর আর কোনো নতুন ছবি করেননি। তবুও তাঁকে নিয়ে গসিপের শেষ নেই। কেউ বলেন রাজনীতিতে নামছেন, কেউ বলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনায়। কেউবা বলেন, বুটিক হাউজ খুলবেন আমেরিকায়! কিন্তু কোনোটাই বাস্তবে ধরা দেয় না। বাস্তবতা কেবল একটাই—অন্তরালে আছেন, কলকাতার মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পথ ধরেছেন বাংলাদেশের আরেক মহানায়িকা শাবানা!