কাজী মোহাম্মদ হিসামুদ্দিন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। চাকরি করতে করতে তিনি অধ্যক্ষ হয়েছেন। এতে তার কৃতিত্ব বা অকৃতিত্ব কিছু নেই। জন্মিলে যেমন মরিতে হবে প্রভাষক হয়ে যেদিন চাকরিতে ঢুকেছেন সেদিনই জেনেছেন মৃত্যু না হলে প্রফেসর বা অধ্যাপক অথবা অধ্যক্ষ হবেন। হয়েছেনও। হয়ে কেমন লেগেছিল তাও এখন আর মনে নেই। আমাদের মতো চুনোপুটির কথা ভেবে লাভ নেই। জীবনের প্রারম্ভিক পর্বে পিএইচডি করা অধ্যাপকরা আমৃত্যু তা ব্যবহার করেন। উপাচার্যবৃন্দ এবং সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া সৌজন্য ও ব্যাকরণের মুণ্ডপাত করে অধ্যাপকরা ‘অধ্যাপক ড.’ লিখতে মোটেও সংকোচ বোধ করেন না, বরং কেউ এর একটা বাদ দিলেই নাখোশ হন। যস্মিন দেশে যদাচার। দু’ বছর অধ্যক্ষ থাকলেই নাকি গাড়ি-বাড়ি করা যায়। আমি পাঁচ বছর থেকেও কিছুই করতে পারিনি। একখণ্ড জমিও কিনতে পারিনি। অপদার্থ আর কাকে বলে। সেদিন আমার এক আত্মীয়া তরুণ আরেক আত্মীয়কে বলেছিল, কিরে তোর ফুফা লোকটা কী বলতো? দুই ছেলে বিদেশ থাকে, নিজে এত বছর চাকরি করেছে, শহরে থাকছে তাও চল্লিশ বছর। না একটা জায়গা, না একটা বাড়ি। অকর্মার ঢেঁকি! ঐ তরুণ দুঃখ পেয়েছিল। তাও বলেছিল, ফুফু, কত লোক কত কী করে, ফুফাতো কিছুই করতে পারলো না। কেন? ফুফু একটা দার্শনিক জবাব দিয়েছিল, লক্ষ্মী-সরস্বতী এক সাথে থাকে না। সরস্বতী থাকলে লক্ষ্মী আসে না। ঐ তরুণ ধর্মের কিছু জানে না। তবু তার মনে হয়, হলেও হতে পারে। বই-খাতা নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু সারা জীবন বই-খাতা নিয়ে থাকলে কি কিছু হয়? এসব কানাঘুষার কথা হিসামুদ্দিন জানেন। কিন্তু জেনে কী হবে? তিনি তো কাজের লোক নন, অকাজের মানুষ। যা কাজ, যা অর্থ তার পথ মাড়ানো তার খুব একটা আসে না। ফরাসী দার্শনিক প্রুধোর কথা তার খুব পছন্দ, প্রপার্টি ইজ থেপ্ট। কিন্তু তার নিকটজনরা তাতে খুব ত্বরিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। নিজেদের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই যে বাড়ি-গাড়ি করেছি, সে কি চুরি করে? আমাদের সব আর্নিংই হালাল, একটি পয়সাও হারাম নয়। মুখের ওপর তো বলা যায় না, একটা নয়, সবটাই হারাম। কিন্তু সেকথা আর বলা হয় না। এমনিই শত্রুর অভাব নেই। আবার আরো শত্রু বাড়িয়ে কী লাভ? এক আত্মীয়ের কথা জানি। তিনি অডিট করতেন। অডিটের ডাক হতো। যে প্রতিষ্ঠানের যতো ফাঁক সে প্রতিষ্ঠানের জন্য ততো হাঁক। যেখানে লাভের অর্থাত্ অর্থ পাওয়ার সুযোগ বেশি সে প্রতিষ্ঠানের জন্য ডাকও ততো বেশি। একবার এক বেরসিক প্রতিষ্ঠান প্রধান বলে ফেলেছিলেন, আচ্ছা আপনাদের যে অর্থটা দিতে বাধ্য হবো সে টাকাটা কোন্খাতে দেখাবো, ঘুষের খাতে? সঙ্গে সঙ্গে তার একজন কর্মকর্তা ও অডিট টিমের একজন সদস্য সমস্বরে বলে উঠলেন, এ নিয়ে ভাববেন না স্যার, আমরা আছি কী করতে? এতগুলো পয়সা নেব আর হালাল করে নেব না! খুঁতকে নিখুঁত করাই তো আমাদের কাজ। এর নামই অডিট। সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান মনে মনে বললেন। তার এক আত্মীয় এইরকম অডিট-সদস্য। তারা নিম্নপদের অথবা নিম্নবেতনভুক্ত বলে সুবিধা পায় বেশী। কয়েক বছর চাঁদা দিয়ে দিয়ে ঢাকার জমির মালিক হয়েছেন, সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে নিজের একাধিক ফ্ল্যাটে বউ-বাচ্চা মেয়ে নিয়ে যেমন থাকেন, ভাড়া দিয়ে তেমনি টাকাও রোজগার করেন। কে প্রশ্ন করবে, কার জমি, কে মালিক হয়? আইন নিজেই যেখানে বেআইন সেখানে কে তার বিচার করে? বহুদিন আগে ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস ‘মা’ পড়েছিলাম। বিচারক পাভেলকে জিজ্ঞেস করছেন, তোমরা আইন ভেঙ্গেছ কেন? পাভেল জবাব দিয়েছিল, যেখানে আইন নিজেই বেআইন সেখানে তা না ভেঙ্গে উপায় কি? আমরা সেইরকম একটা অবস্থার মধ্যে আছি। যেরকম আইন হওয়া দরকার বা উচিত তা নেই অথবা হয় না। কিংবা আইন থাকলেও কিছু লোকের তা না মানলেও চলে। হত্যাকাণ্ডেরই কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবল তদন্ত হয়, তদন্তকালীন তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা মানা, আর একটা সময় মানুষ দেখে ও বোঝে, ব্যাপারটা তামাদি হয়ে গেছে। যে সাংবাদিকরা খবর দেয়, তারাই তাদের খুন হওয়া সহকর্মী-দম্পতি সাগর-রুনির কোনো সংবাদ দিতে পারে না। এক সময় তারা এ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল কিন্তু এখন আবার দ্বি-দলীয় বৃত্তে ভাগ হয়ে গেছে। বিচার দূরে থাক, ঘটনার ভেতরেই তো ঢোকা যাচ্ছে না।
দুই পার্কে কয়েকজন বৃদ্ধ জড়ো হয়েছেন। প্রতিদিনই হন। সংখ্যা বাড়ে-কমে এই যা কিন্তু মোটামুটি কয়েকজন থাকেনই। পার্কের অন্যপ্রান্তে নানা বয়সের, প্রধানত তরুণ ও মধ্যবয়স্করা লাফটার ক্লাব করেছেন। হাসতে পারলে কোনো রোগ থাকে না, সকলেই জানেন। কিন্তু হাসি এমন স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার যে জোর করে তা করা যায় না। কিন্তু এখানে তাই হচ্ছে, বেশিরভাগই জোর করে হাসছেন। তরুণরা মোটামুটি প্রাণের আনন্দে হাসলেও মধ্যবয়স্কদের হাসি অনেকটা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো, টেনেটুনে খানিকটা—। তাও— বৃদ্ধরা যেখানে বসেছেন সেখানে এসে উপস্থিত হন আরেকজন বৃদ্ধ। কোনো হাসির খবর এনেছো নাকি ভাই? হাসির বড় অভাব। বৃদ্ধদের একজন জানতে চান। এনেছি, দেখুন যদি হাসতে পারেন। গতকাল জা-দলের নেতা বলেছেন— নেতা, নাকি— নেতা, এখানে লিঙ্গ নেই, লিঙ্গান্তর নেই। কমন জেন্ডার। তার চেয়েও বড় কথা— নেতা সাধারণ লিঙ্গ, তাকে লিঙ্গান্তরের প্রয়োজন নেই। ভাই, বুঝেছি। এবার আসল কথা বলুন। বলছি। নেতা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নাকি— সে কি করে হয়? ওয়াকিবহাল একজন বলেন, গতকালই তো ওদের ওয়েবসাইটে দেখেছি, তিনি বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি— সে তো পুরনো কথা, এ হচ্ছে নতুন তত্ত্ব। নতুন তত্ত্ব? হ্যাঁ, নতুন তত্ত্ব। নেতা বলেছেন। তিনি ঝেরে কাশেননি, তবে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। আচ্ছা, ওঁর ছেলেও না একই কথা বলেছেন, লন্ডনে— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই কথার জের ধরেই তো— শুনুন, ছেলে হচ্ছে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। আর লন্ডন হচ্ছে বনেদী শহর। ভাইরে, কবে একটু সাহিত্য পড়েছিলাম। ডক্টর জনশন বলেছিলেন, ইফ ইউ আর টায়ার্ড অব লন্ডন, ইউ আর টায়ার্ড অব লাইফ। সেই লন্ডন থেকে তত্ত্ব দিচ্ছে, সে কি সোজা কথা ভাই? সোজা কথা নয়, তবে এও মনে রাখা দরকার, আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন লন্ডনের বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক। টাকা হলে বাঘের দুধ যেমন পাওয়া যায় তেমনি বস্তাপচা তত্ত্বের সমর্থন পেতেও অসুবিধে হয় না এবং লন্ডনে বসেও আবোল-তাবোল বকা যায়। সেকথা তুমি বলতে পারো না ভাই জামান। তিনি তার দলের ভাইস— তা অবশ্য। সেটার জন্য তো কোনো কিছুর দরকার হয় না। নেতা চাইলেন তো পুত্র হয়ে গেলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান। তাও আবার সকলকে ডিঙ্গিয়ে সিনিয়র। আচ্ছা, তা না হয় হলো। জা-দলে কি আর ভাইস-চেয়ারম্যান নেই? থাকার তো কথা— তাহলে তিনজনের ছবি ঝুলে কেন? পিতা-মাতা ও পুত্র। এত ভেতরের খবর কী করে বলবো? আমরা হলাম বাইরের মানুষ এবং খুবই তুচ্ছজন। তুচ্ছ হয়ে এতো খবর রাখো কী করে বলতো? রাখি কি আর সাধে? প্রাণের দায়— হ্যাঁরে ভাই, প্রাণের দায়। কে কখন ক্ষমতায় এসে যায়! আমাদের কী, আমরা হলাম সাধারণ মানুষ, আম-জনতা। বাঁশডলাটা প্রথম সাধারণ লোকের উপর দিয়েই যায়। আমাদের তো রাজনৈতিক ভাই-বন্ধু নেই যে গিয়ে বলবো, আমরা আগে থেকেই জা-দল করতাম। বললেও কে তা শুনতো বা শুনবে? শুনবে। তবে তা বলার মতো বলতে জানতে হবে। কি রকম? এই ধর গতবার জা-দল ক্ষমতার আসার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তি জা-দলীয়— দল করে জানান দিল, তারা তাদের লোক, সেভাবে সুযোগ-সুবিধাও নিল। কিন্তু পরের বার যখন আ-দল ক্ষমতায় এল রাতারাতি তাদের রং বদলে গেল। কী না, বাধ্য হয়ে আমরা তখন তা করেছিলাম। কিন্তু জানেনই তো, আমরা মনে-প্রাণে আপনাদেরই লোক। আ-দলও মেনে নিল, হ্যাঁ, তাইতো। সাম্প্রতিকতম সুবিধাপ্রাপ্তিতেও তারা আর বঞ্চিত নেই। চরিত্রহীনদেরই সবাই পছন্দ করে। তার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। একে পণ্ড করতে তাদের আর জুড়ি নেই। মহান এই ঘটনার বাস্তবতা ও আবেগের এতো বেশি বাণিজ্যিক ব্যবহার এর আগে বোধহয় আর হয়নি। আরে ভাই, যাচ্ছিলেন চীন, চলে গেলেন জাপানে— মানে? মানে কিশোর কুমারের গান, উল্টোপাল্টা ব্যাপার আর কি, হচ্ছিল তিমূর্তির কথা— পিতা, মাতা ও পুত্র। হ্যাঁ, তাইতো হবে। দেশটা নামেই জনগণের। আসলে ও বাস্তবে পরিবারের, পরিবারের কয়েকজন সদস্যের। সংবিধানে আছে জনগণই সকল ক্ষমতার উত্স কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার কাদের? তাদের জনপ্রতিনিধিদেরই তো? জনস্বার্থ ও জনকল্যাণে তার প্রয়োগ হয় কতটুকু? আদৌ কি হয়? সুতরাং প্রয়াত, বর্তমান ও আসন্ন ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে কারা ক্ষমতা ভোগ করে তার জলজ্যান্ত একটা ছবি তিনজনের এই ফটোগ্রাফ। প্রয়াতের আবেগ ব্যবহার, বর্তমান নেতৃত্বের সুযোগ ব্যবহার করে ভবিষ্যতের পথ করে দেয়ার এক প্রয়াস এই তিন ছবির আসল উদ্দেশ্য। তার সঙ্গে মুখরোচক এই কথা, জাতির ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব তুলে দিতে তরুণ প্রজন্মের হাতে, যাতে বংশ পরম্পরায় আমরা এই দেশ শাসন করতে ও ক্ষমতা ভোগ করতে পারি। আরে ভাই, তুমি তো বেশ ভালোই ব্যাখ্যা দিতে পারো। টেলিভিশনে রাতের টক শো-গুলোতে যাও না কেন? ডাকলে তো যাবো। আমাদের কে ডাকে? কয়েকজন চেনামুখই তো ঘুরেফিরে আসে। সেখানেও স্বার্থ। ও ভাই, তরুণ নেতৃত্ব আগেরবার কী করেছিল মনে নেই? মনে তো আছে। কিন্তু ওরা ভাবে, মানুষের স্মৃতি বড় ভঙ্গুর ও দুর্বল। দ্রুত ভুলে যায়। ভুলে— আবার তাদের ভোট দেবে—? দেবে। তাছাড়া উপায় কী? রহিম খারাপ হলে করিমকে ভোট দাও, করিম খারাপ হলে রহিমকে— এই ভরসাতেই তো ওরা থাকে। আমাদের ভোট না দিয়ে ওরা যাবেটা কোথায়? হরে ভাই, হ। এদেশে ইতিবাচক ভোটে কিছু হয় না। নেতিবাচক ভোটে হয়। যেমন খারাপ এই সমাজে কারো টাকা রোজগার যত সহজ সাদা টাকা রোজগার সেইরকম অথবা তার চেয়ে বেশি কঠিন। এরই ফলে হত্যাকাণ্ড আমাদের কাছে ডাল-ভাত। তার নিচের কোনো ঘটনায় সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় না।
তিন কাজল আরেফিন হিসেব করে দেখেছে, এখন তার বয়স কত হয়েছে। হায় আল্লাহ, ষাট পেরিয়েছে কতদিন হয়ে গেছে। আর তো নিজেকে কমবয়েসী ভাবার কারণ নেই। সে চুলে কলপ লাগায় না। কিছু কিছু কাঁচা অর্থাত্ কালো চুল আছে। ফলে মাথাটা একেবারে সাদা হয়ে ওঠেনি, পেছনে যদিও বেশ ভালোই টাক পড়েছে। শেক্সপীয়রের মতো নিজেকে সে এখন বাল্ডহেডেড জেন্টলম্যান বলতে পারে। তার চেয়ে তরুণ সঞ্জয়ের চুল আরো বেশি পেকেছে কিন্তু এখনও তরুণ দেখায়। তাদের মধ্যে তরুণতম বন্ধু হাফিজের চুল একেবারে ঘ্যাচঘ্যাচে কারো। সে অবশ্য কলপের গুণে। কিন্তু কত আর খেয়াল রাখা যায়? মাঝে মাঝে সাদা ছোপ বেরিয়ে পড়ে। এ নিয়ে তার পরিচিত জালাল বলেছিল একটা মজার কথা। একদিন সে পত্রিকায় একটা খবর পড়ে। ‘পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধের মৃত্যু।’ কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে জালালের কেবল মনে থাকে— ‘পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ’। পঞ্চাশেই যদি বৃদ্ধ, তবে ষাটের পর আমরা কী? ভাগ্যিস, এখনও বার্ধক্যটা টের পাচ্ছি না এবং নিজেকে তরুণ ভাবতেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কাজল ভাবে, তবে বয়স তো একটা মেজর ফ্যাক্টর। মাঝে মাঝে রোগ বা রোগের ধাক্কা বুঝিয়ে দেয়, বয়স হয়েছে, সবকিছুকে তুড়ি মেরে আর উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কখনো কখনো মনে হয়েছে, এই বুঝি সময় হলো চলে যাওয়ার কিন্তু পরক্ষণেই আবার ফিরে এসেছে। প্রাতভ্রমণের মিষ্টি বাতাসের মতো ঐরকম ফিরে আসাটাকে বেশ কয়েকবারই উপভোগ করেছে কাজল। কিন্তু কতদিন আর করা যাবে জানে না সে। পার্কে বৃদ্ধদের একটা আড্ডা বসে। এতদিন ভেবেছে, নাই কাজ তো খই ভাজ জাতীয় ব্যাপার সেটা। কিন্তু সেদিন আবছা ভাবে যা কানে আসে তাতে মনে হয়, সিরিয়াস ব্যাপার নিয়েও ওরা ভাবেন। মা ও পুত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতির তত্ত্ব নিয়েও ওঁদের মাথাব্যথা। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জা-দলের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেছিলেন, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত কে রাষ্ট্রপতি ছিলেন? সরকার ব্যবস্থা তো শূন্য থাকতে পারে না। বলেই আবার বলেছিলেন, এ তাঁর ব্যক্তিগত মত, দলের ব্যাখ্যা নয়। এইরকম একটা বিষয়ে ব্যক্তিগত মত দিতে তিনি আসেনইবা কেন, সেই প্রশ্ন না তুলেও বলা যায়, সে কি কাউকে বা কোনো পক্ষকে খুশি করার জন্য? সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তোতাপাখির বুলি আওড়ানো বেশ প্রচলিত। ব্যক্তি ও গোষ্ঠিকে খুশি বা তোয়াজ করতে পারলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। ১৭ এপ্রিল বা তার আগে যে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় তারও একটি প্রেক্ষাপট আছে। কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটে জা-দলের প্রতিষ্ঠাতার কোনো জায়গা নেই। একবার ভুল অথবা ইচ্ছা করে। যেভাবেই হোক নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি যে স্বাধীনতার ‘ঘোষণা’ করেন তাতে তার কোনো অধিকার ও বৈধতা ছিল না। দ্রুতই তিনি তা সংশোধন করেন এবং জীবদ্দশায় তা নিয়ে আর কোনো কথা বলেননি। সংশোধনীতে অথবা পরবর্তীকালে তিনি যা বলেছিলেন তাতে আমাদের ‘গ্রেট লিডারে’র নেতৃত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করেই যা বলার বলেছেন। তাহলে তার ‘প্রথম’ রাষ্ট্রপতি হওয়ার ভিত্তি কী? ভ্রান্তি না হঠকারিতা, নাকি মিথ্যাকে সত্য করে তোলার গোয়েবলসীয় অত্যুত্সাহ? এখন আবার শুনছি শেখ মুজিব নাকি অবৈধ প্রধানমন্ত্রী। তিনি নাকি পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে এসেছেন, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া পর্যন্ত নাকি অপেক্ষা করেননি? ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ সম্পর্কে এরকম প্রশ্ন হয় অতি মূর্খ অথবা অতি চালাকই করতে পারে। ইতিহাসে যা স্বাক্ষরিত হয়েছে তাকে এভাবে ভুল অথবা মিথ্যে প্রমাণ করা যায় না। তবে ফেরেশতারা যেখানে পা দিতে পারে সেখানে বোকারা কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারও হয়েছে সেই দশা। লন্ডনে বসবাসকারী অতি-বুদ্ধিমান ভাইস চেয়ারম্যান কিন্তু আরেকটি কূট প্রশ্ন তুলেছেন। জানতে চেয়েছেন সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই শেখ মুজিব কী করে প্রধানমন্ত্রী হলেন। স্বাধীনতার ঘোষণায় (প্রক্লেমেশন-এ) ছিল: শেখ মুজিব গণপ্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি। শেখ মুজিব দেশে ফিরেছিলেন ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী হন ১২ জানুয়ারি। কিন্তু এর মধ্যে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১১ জানুয়ারি প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার জারি করেন যার ফলে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে তিনি ঐ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি চৌধুরী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। অতএব—। ১৯৭২-এ দুজন দালালও বলেছিল শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ছিল অবৈধ। কারণ ২৪ জানুয়ারি জারিকৃত দালাল আইনে অন্যদের সঙ্গে ঐ দুজনেরও বিচারের ব্যবস্থা ছিল। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পর দালালদের সুরে কথা বলা তাহলে কিসের ইঙ্গিত বহন করে? সে যাই হোক, কাজল আরেফিনের মনে হয় ভিন্ন কথা, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী, এ লিটল লানিং ইজ এ ডেঞ্জারাস থিং। কিন্তু তার চেলারা বলে তিনি রাষ্ট্রনায়ক। সফল রাষ্ট্রনায়ক। বাগাড়ম্বরের বাগাড়ম্বর। কাজলের মনে পড়ে, পরিবর্তনের কথা বলে এই সরকার যখন আগেরবার ক্ষমতায় এসেছিল তখন তার বন্ধু সঞ্জয় জানতে চেয়েছিল, পরিবর্তন যে হয়েছে বা হচ্ছে কিংবা হবে তা কেমন করে বুঝতে পারবো তখন কাজল বলেছিল, অত তত্ত্বকথা বলতে বা বোঝাতে পারব না। একটা ছোট বাস্তব কথা বলি। আত্মীয়স্বজন থাকার সুবাদে আপনার তো পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া-আসার অভিজ্ঞতা আছে, সেখানকার খোঁজ-খবরও রাখেন। ওদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল কে প্রকাশ করে? শিক্ষা পর্ষদের একজন কর্মকর্তা— তারপর সে ফল সবাই ওয়েবসাইটে দেখে। ওটা একটা রাজ্য আর আমাদেরটা রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের এখানে কী হয়? শিক্ষামন্ত্রী সব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান, ফটোসেশন ও নানা কথা হয়। তারপর প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে তার সূচনা করেন। সামনে তো একটা ফল প্রকাশিত হবে। যদি দেখেন আগের সরকারের মতো এই সরকারও ফল প্রকাশের একই রীতি অনুসরণ করছে তাহলে বুঝবেন পরিবর্তন কিছু হয়নি শুধু নয়, পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। এর মধ্যে আমরা জেনে গেছি, কী হয়েছে ও কী হয়ে চলেছে। সঞ্জয় ও হাফিজকে আমি আরো বলেছি, আপনাদের ছেলে-মেয়েরা তো সেই পর্যায় অতিক্রম করে গেছে, তবুও জানেন নিশ্চয়ই মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা একটা জিনিস চালু করেছে— গোল্ডেন এ— অর্থাত্ সকল বিষয়ে ৮০ শতাংশ বা তার ওপর নম্বর পাওয়া। গোল্ডেন এ পাওয়া মানে বাংলা ও ইংরেজিতেও ৮০ বা তদুর্ধ্ব নম্বর পাওয়া। এখন এরকম একটি ছেলে বা মেয়েকে স্বাধীনভাবে বাংলা ও ইংরেজিতে যদি একটি অনুচ্ছেদ লিখতে দেয়া হয় এবং সে যদি একাধিক বানান ভুল করে এবং বাক্যবিন্যাসে ত্রুটি থাকে এবং কাব্যগুলো শিথিল হয় তাহলে ঐ গোল্ডেন এ কী অর্থ বহন করবে? সে কি অশ্বডিম্ব হবে না? ‘রাষ্ট্রনায়ক’ মানেও তাই। যারা রাজনীতিকে সাধারণভাবে একটু সুস্থ ও সহনীয় করতে পারলো না তারা হয়ে যাচ্ছেন রাষ্ট্রনায়ক। অর্থাত্ এরা বাগাড়ম্বর চান। কী অর্জন করেছেন সেটা কথা নয়, চেলারা কী নামে তাদের জয়ধ্বনি দেয় সেটাই কথা। মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের মতো সন্তানরা কিছু শিখুক বা না শিখুক, তাদের যেমন গোল্ডেন এর নাম কিনতে হবে, রাজনীতির প্রাথমিক অর্জন হোক না হোক, তাদেরও রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক হতেই হবে। এ হচ্ছে শেক্সপীয়রের ভাষায় (এখানে কাজল এ বছর তাঁর সার্ধ চতু-শতবর্ষে একটু নীরব থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়) সেই গল্প যা হৈচৈ-এ ভরা কিন্তু তাত্পর্যের দিক থেকে শূন্য। বাংলা ভাষায় এক কথায় মাকাল ফল।
চার বাতাসে এই খবর আগেই রটেছিল এবার মোদী এবং তার দল ও জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে। প্রগতিশীল মানুষেরা এতে শঙ্কাবোধ করেছিলেন, তাই যদি হয় তাহলে উপমহাদেশের ভবিষ্যত্ কী। ফল বেরুলে দেখা গেল, বিজেপি একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। জোটের যে অবস্থান তাতে অন্য কারুর কাছে হাত পাতার একেবারেই দরকার নেই। যেহেতু একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এই রায় সেহেতু তাকে অস্বীকার করা যায় না। যে কারণেই হোক, জনগণ কংগ্রেস ও জোটের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নেতিবাচক ভোট দিয়েছে। কিন্তু নেতিবাচক হোক বা ইতিবাচক, এ হচ্ছে জনগণের রায়, তাকে মানতেই হবে। ভারতে এর প্রতিক্রিয়া যাই হোক, বাংলাদেশে সঞ্জয় দেখছে এর অদ্ভুত প্রকাশ। আ-দল জা-দল উভয় পক্ষই মোদীকে স্বাগত জানাবার জন্য এগিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে দেরি না হয়ে যায় এজন্য সবাই অস্থির। রাজনীতিতে সুবিধাবাদ আছে, সঞ্জয় এটা জানে, কিন্তু সে এও জানে, যেখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু তবু একটু যেন খারাপ লাগে তার। সত্যিই নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস? জেতাটাই কি একমাত্র ও চূড়ান্ত সত্য, তার ওপর কিছু নেই? বাস্তবে সে তো তাই দেখছে। দেখছে আর বিষণ্ন হচ্ছে। এদিকে গণজাগরণ মঞ্চ বাস্তবে ভেঙ্গে গেছে। শাহবাগের আবেগ কি জনসাধারণের মধ্যে থিতিয়ে এসেছে? যারা এক সময় সমর্থন দিয়ে ফায়দা তুলেছে তারা এখন কাজ ফুরাবার পর পাজি হয়েছে। মনে হচ্ছে, এখন আর তাদের মঞ্চের প্রয়োজন নেই। যে রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের একাধিক রায়ে সন্ত্রাসী ও অপরাধী দল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে তাদের বিষয়ে খোদ আইনমন্ত্রী বলছেন, তেয়াত্তরের আইনে তাদের সংগঠনগত বিচারের সুযোগ নেই। হায়, এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে? আকাশ-বাতাসে যে কানাঘুষা চলেছিল আজ সত্যিই তা বাস্তব হতে চলেছে। প্রাতভ্রমণের সময় কাজল আরেফিনের কাছে প্রশ্নটা তুললাম। তিনি আমাদের জ্যেষ্ঠাগ্রজ। তিন ভাইয়ের সবাইর বড়। কাজল, সঞ্জয় ও হাফিজ। হিন্দু-মুসলমান মিলে তিন ভাই। সঞ্জয়ের মনে পড়ে শওকত ওসমান কথিত কামরুল হাসানের কথা, সেই পটুয়া কামরুল হাসান, যিনি একাত্তরে ছবি এঁকে জানোয়ারদের হত্যা করার কথা বলেছেন, সেই কামরুল হাসান, যিনি জাতীয় কবিতা পরিষদের মঞ্চে সভাপতিত্ব করতে করতে ও কবিতা শুনতে শুনতে বিশ্ববেহায়া স্বৈরাচারী শাসকের ছবি এঁকে লিখেছিলেন ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ এবং তারপরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। তিনিই একবার গোয়েন্দা বিভাগের জনৈক কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, অজিত গুহ তার ভাই। সেই ব্যক্তি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, প্রফেসর তো হিন্দু, তিনি কী করে আপনার ভাই হতে পারেন? শিল্পী বলেছিলেন, পারেন, তবে সবাই তা বুঝতে পারেন না। তিন ভাইয়ের ব্যাপারটাও সবাই বুঝতে পারে না। বয়সে বেশি বড় না হলেও আমরা কাজল আরেফিনকে ‘স্যার’ই বলি— কাজল স্যার। তো সেদিনও জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁ কাজল স্যার ইন্ডিয়ান ইলেকশন নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? — সবে তো মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। এখনও বলার মতো কিছু হয়নি। লেটস ওয়েট অ্যান্ড সী। - তবুও। -তবুও যদি বলেন, তাহলে আমাদের এখানে অর্থাত্ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে ভোঁতা প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, তাই হয়েছে। সবাই ভেবেছে এখন ধর্মানুভূতি জয়ী হয়েছে। কিন্তু ভোটের মনস্তত্ব অত সহজ নয়। এর সঙ্গে যেহেতু জনগণের নানাধরনের বিচিত্র ও জটিল বিষয় ও উপাদানসমূহ জড়িয়ে থাকে সেহেতু সামগ্রিকভাবে কী ঘটেছে তা না বুঝে যদি এর সরলীকরণ করা হয় তবে আমরা একটা বড় ভ্রান্তিতে পড়ব। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু ক্ষমতা বোঝে এবং তাদের যাবতীয় তত্পরতা সেখানে থাকা ও পাওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যেই ঘুরপাক খায় সেহেতু তারা ‘সোজা’ বোঝে এবং যেভাবেই নিজেদের তত্পরতাও নির্ধারণ করে। ভারতীয় জনগণ হয়তো গুজরাটের তথাকথিত উন্নয়ন মডেল ও মোদীর দক্ষ প্রশাসনিক ক্যারিশমায় ভুলেছে অথবা পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টকে ত্যাগ করার মতো কংগ্রেসকেও ত্যাগ করেছে। জনগণের প্রতি দীর্ঘ নির্লিপ্ততা, যা ভদ্র আচরণ দিয়েও দূর করা যায় না, ভারতে মোদীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয় অর্জন তারই এক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। — ভারতের জনগণ কি এতো কিছু বুঝে ও এতো হিসেব করে ভোট দিয়েছে? জিজ্ঞেস করে হাফিজ। - না, তা হয়তো দেয়নি। কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত তাই দাঁড়িয়েছে। তাতে এও বলা যায়, বোঝার ব্যাপারটা ও হিসেবটা এর মধ্যে ছিলই। - বাংলাদেশে এর ফল কী দাঁড়াবে? - কী দাঁড়াবে সে তো সময়ই বলবে। তবে ধর্মানুভূতির কথা ভেবে যারা সেদিকে ঝুঁকে পড়ছে তাদের বিষয়ে সাধারণ কথা বলা যেতে পারে। - বলুন। হাফিজ ও সঞ্জয় দুজনেই সমস্বরে বলে। - তার আগে পাকিস্তানের কথা বলা দরকার। বেশিরভাগ লোকের ধারণা ধর্মের জন্য পাকিস্তান হয়েছে। কিন্তু তারা ভাবে না অথবা দেখে না সাতচল্লিশ পূর্বকালে পূর্ববাংলায় রায়তদের অবস্থা কী ছিল, তারা কেন পাকিস্তান চেয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে ধর্মীয় উপাদান যেমন ছিল তেমনি তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল চীনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদে রায়তদের দাবি। তেভাগা আন্দোলন ও কৃষক প্রজা পার্টিকে ডিঙ্গিয়ে মানুষ যে মুসলিম লীগকে বেছে নিয়েছিল তার মূল কারণ তারা ভেবেছিল, প্রজা পার্টি ও তেভাগার চেয়ে বেশি কার্যকর হবে মুসলিম লীগের সংগঠিত শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সেজন্য পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম তাত্ত্বিক আবুল মনসুর আহমদ ও কবি ফররুখ আহমদরা ভেবেছিলেন, পাকিস্তান সমাজতন্ত্রের চেয়েও উন্নততর রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে। কিন্তু নজরুল অভিজ্ঞতা থেকে জানতেন তা হবে না। কারণ তিনি দেখেছেন, মুসলিম লীগ নেতারা কওমের খেদমত করতে অথবা ত্যাগ করতে করতে জমিদার অথবা মন্ত্রী বনে যান। সেজন্য ‘নবযুগ’ পত্রিকা ও নানা লেখা ও কর্ম তত্পরতায় তিনি পাকিস্তান প্রত্যয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। - প্রমাণ? - প্রমাণ কয়েকটা সাক্ষ্য। কবি গোলাম মোস্তফা ‘নজরুল কাব্যের অপর দিক’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘নজরুলকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলিয়া অনেকে মনে করেন। কিন্তু নজরুলের সবচেয়ে বড় অপবাদ যদি কিছু থাকে, তবে এই।’ আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আত্মকথা’য় লিখেছেন, “নতুন পর্যায়ে ১৯৪০-এর অক্টোবরে নবযুগের প্রকাশ শুরু হলে এর কোন একটি সংখ্যায় নজরুল ‘পাকিস্তান’কে ‘ফাঁকিস্তান’ বলতে মুসলিম লিগ মহলে আগুন লাগিল।” আর মুজিবুর রহমান খাঁ, যিনি ‘আজদ’-এ চাকরি করতেন এবং ছিলেন পাকিস্তানের সক্রিয় তাত্ত্বিক ‘মোহাম্মদী’তে প্রবন্ধ লিখে বলেছেন ‘নজরুল নিজে পাকিস্তানের নিন্দা করেছেন।’ এখন এই ভদ্রলোককে আপনাদের আরো একটু চিনিয়ে দিতে চাই। - দিন। আমরা আপত্তি করছি কোথায়? - শুনুন। ষাটের দশকে আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন সাহিত্যের নানা অনুষ্ঠানে যেতাম। এর মধ্যে একটা জায়গা ছিল তোপখানা রোডের পাকিস্তান কাউন্সিল, বাংলাদেশে বদলে যা হয় ‘বাংলাদেশ পরিষদ’। পাকিস্তান আমলে এই কাউন্সিলে মুজিবুর রহমান খাঁ খুব আসতেন। ঢাকার অন্যান্য জায়গায়ও তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। তিনি পাকিস্তানবাদ নিয়ে কথা বলতেন। সাহিত্যে পাকিস্তানী আদর্শ ও চিন্তা কেন প্রয়োজনীয় সেই কথা ব্যাখ্যা করতে অক্লান্ত ছিলেন। নানা জায়গায় তাঁর মূল কথা ছিল, আমাদের সাহিত্যে কোন আদর্শ প্রতিফলিত হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের ও উদাহরণ দিতেন। বলতেন, কবি যেহেতু হিন্দু সেহেতু তিনি হিন্দু উপমা, প্রতীক, রূপালঙ্কার এসব ব্যবহার করেন। তাঁর জন্য সেটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমাদের পক্ষে তা স্বাভাবিক হতে পারে না। আমাদের জন্য স্বাভাবিক হচ্ছে আমাদের নিজেদের জীবন, তার ধরন ও সেই তাহজীব অনুসরণ করা। প্রথম দিকে আমরা বুঝতাম না বা বোঝার জন্য তেমনভাবে খেয়াল করতাম না যে, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু নন, ব্রাহ্মণ, হিন্দু জনজীবন ও সংস্কৃতির একটা প্রকাশ তাঁর সাহিত্যে আছে, কিন্তু সেটাই সব বা একমাত্র কথা নয়। হিন্দু জনজীবন ও প্রতীক ব্যবহারের একটা অন্য তাত্পর্য রয়েছে। তাই হিন্দু না হয়েও নজরুল ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ অথবা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র মত কবিতা লিখেছেন এবং হিন্দু প্রতীক ও রূপালঙ্কার ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশ হলেও আমরা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সব সময় কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। - বড় ভাই, একটা কথা বলি। - বলেন ছোট মিয়া। - প্রাতভ্রমণে এতো সিরিয়াস আলোচনা একদিনে হজম হবে না। - অতএব? - অতএব আজ তবে এইটুকু থাক। - বাকী কথা? - কাল হবে। পরদিন আবার বসে তিন ভ্রাতা। - দেখ আপস করতে করতে এমন জায়গায় এসে পড়েছি যে, প্রকাশ্যে হত্যা করতে অথবা হুমকি দিতে এখন আর বাধে না। - কাজল শুরু করে। - উদাহরণ, ভাই। - উদাহরণ ১৯ এপ্রিলের দৈনিক। একটি গ্রুপের আমির তার আগের দিন কক্সবাজারে ‘১৩ দফা আন্দোলন মানলে ভালো, না মানলে নাই’ বলেও বলেন, ‘নাস্তিকরা তোমরা মুরতাদ হয়ে গেছ, তোমাদের কতল করা আমাদের ওপর ওয়াজিব হয়ে গেছে।’ একি প্রকাশ্যে হত্যা করার প্ররোচনা নয়? একবিংশ শতাব্দীর একটি রাষ্ট্রে কি তা হতে পারে? কিন্তু ঘটনা হচ্ছে তা ঘটছে এবং কর্তৃপক্ষ বা তার সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ ও বক্তিবর্গ সম্পূর্ণ নীরব। ঐ ভদ্রলোক আরো বলেছেন, ‘নাস্তিকদের গালি দিলে কারো গায়ে লাগলে আমার করার কিছু নেই। আল্লাহর দেশে থাকতে হলে আল্লাহকে না দেখে আল্লাহর অস্তিত্ব মানতে হবে, তা না হলে তুমি আল্লাহর দেশে থাকতে পারবে না।’ কী ভাই, এটা উদাহরণ নয়? তাদের শর্তে, তাদের ব্যাখ্যায় তুমি জিম্মি হয়ে থাকবে। এটা একটা অগ্রসর রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে? - তো? - তো আমরা এমন একটা বাস্তবতায় বসবাস করছি যে, হত্যা, গুম, অপহরণ সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে। এক নারায়ণগঞ্জে ত্বকী, সাত খুন ইত্যাদি হয়েছে, ফেনীতে গুলি করে কুপিয়ে সন্তুষ্ট হয়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে, লক্ষ্মীপুরে আলক্ষ্মী ভর করেছে। এর ফলে সারা দেশ হয়েছে, হচ্ছে আতঙ্কিত। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সেমিনারে বলতে বাধ্য হয়েছেন, সরকার কে সেটাই বুঝতে পারি না। এক সাংবাদিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি সরকার। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, প্রশাসনের যুগ্ম সচিব কিংবা জমির সার্ভেয়ার হলো সরকার। ওদিকে আবার দেশের প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০২ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ছাত্রদের অপরাধের মধ্যে রয়েছে কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনের রেকর্ড শুনে পরীক্ষা দেয়া, বাইরে থেকে লিখে এনে পরীক্ষার খাতার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া আর শিক্ষকের অপরাধ তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভে তিনি বানোয়াট তথ্য দিয়েছেন। এই পিএইচডি অভিসন্দর্ভকে সন্দেহজনক উল্লেখ করে, তার বিভাগের পাঁচজন সহকর্মী পূর্বেই লিখিতভাবে তাদের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। অভিযুক্ত শিক্ষক উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি তার গবেষণার জন্য ৮০টি দেশের ১২ লাখ পঁচাত্তর হাজার সাতচল্লিশ জনের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন যাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই-কমিশনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপ-উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি পরীক্ষা করে দেখে পুরো বিষয়টি বানোয়াট। ফলে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এই ডিগ্রি প্রত্যাহারের পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিক স্খলনের দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। - তাহলে ভাই? - তাহলে ভাই, যা হচ্ছে তাই। কোথায় ও কী আমাদের ভবিষ্যত্? তিন ভ্রাতার মধ্যে স্তব্ধতা নেমে আসে। এর মধ্যেই কথা বলেন হাফিজ। - আমার একটা কথা মনে পড়ছে। - বলুন। কেউ একজন বলে। - বিবিসি-তে সেদিন সকালে জা-দলের প্রাক্তন আইনমন্ত্রীর সাক্ষাত্কার শুনছিলাম। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আপনি কেন বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে সমস্যার সৃষ্টি করলেন? সাবেক আইনমন্ত্রী বললেন, সবাই আমাকে দোষ দেয়। কিন্তু যিনিই তখন আইনমন্ত্রী থাকতেন তাকেই এই কাজটা করতে হতো। কারণ— - কারণ সবাই বোঝেন। এভাবেই দূষণ হয়, হতে থাকে— আবার স্তব্ধতা নেমে আসে, কেউ কোনো কথা বলে না। একজন হঠাত্ উঠে পড়ে। অন্য দুজন তাকে অনুসরণ করে। দুজন একদিকে, অন্যজন উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। একসঙ্গের দুজনও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না।
পাঁচ খোকনের এতদিন পরে যেন একটু আনন্দ হচ্ছে। পঁচাত্তরের ঘটনার পর এখন নতুন প্রেসিডেন্ট এই মহকুমা শহরে আসছেন। হাদিউল ইসলাম খোকনের আনন্দ হওয়ারই কথা। বাংলা কবিতা, বাংলা সংস্কতি নিয়ে আল্লাদ করলেও খোকন মনে করে, মুসলমান হওয়াই একমাত্র কাজ ও পরিচয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৮ বা ঊনপঞ্চাশে কী বলেছিলেন সেসব এখন ভেবে আমাদের লাভ নেই। এ কি কোন মুসলমান বলতে পারে? আমরা যতটা না মুসলমান তার চেয়ে বেশি বাঙালি— এটা কোনো আদর্শের কথা নয়, বাস্তব কথা? সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ঠিকই বলেছেন তাকে মহাপণ্ডিতের মতো দেখায় বটে কিন্তু তিনি আসলে তা নন। পাকিস্তান ভেঙ্গেছে ঠিকই কিন্তু জোড়া লাগতে কতক্ষণ? হাসন জামান ঢাকা রেডিও থেকে ১৯৭১-এর ১৩ কি ১৪ই ডিসেম্বর বলেছিলেন, সাহায্য আসছে, পাকিস্তান টিকে যাবে, মুমিনদের ভয় নেই। সে সময় লুকিয়ে থেকে কানের কাছে রেডিও ধরে সেকথা শুনেছিলাম। বুকে বড় আশা জেগেছিল, কিন্তু হলো না। তার আগে থেকেই অজ্ঞাত বাস। আমার খালাত আপা আমাকে লুকিয়ে রেখেছিল। বলেছিল, তোর জন্য বাইরে বেরনো এখন নিরাপদ নয়। মুক্তিযোদ্ধারা কে কখন এদিকে মুভ করবে সেটা আমার জানা থাকবে। অতএব তোর ভয়ের কিছু নেই। তুইতো জানিসই, আমার বাবা, তোর খালু বসরতউল্লাহ পাকিস্তানের সাংবাদিক ছিলেন। রাজাকারির কিছু পরিচয় দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিরা তাকে মেরে ফেলেছিল। আপারা সীমান্তের ওপারে থেকে সেকথা শুনেছিল কিন্তু আসতে পারেনি। আমাকে খবর পাঠিয়েছিল, খোকন দেখ, বাবার যদি দাফনের ব্যবস্থা করা যায়, কিছু লোক করেছিল, আমার তখন বাইরে বেরনোর উপায় ছিল না। আরো আগে থেকে পলাতক জীবন-যাপন করছি। মহকুমা এই শহর মুক্ত হলে আমার জন্য হল আরো খারাপ অবস্থা। কে-কোথা থেকে দেখে ফেলে। এবং দেখে ফেললে একদম মৃত্যু। লোকনাথ ময়দানে এক মুক্তির চুল ধরে তাকে শূন্যে তুলে ধরে বলেছিলাম, দেখুন ভাইয়েরা, এই হচ্ছে দুষ্কৃতকারী, পাকিস্তানের দুশমন। শালারা বলে, আমাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলবে। এত সাহস! আমাদের বাপ-চাচা-দাদারা যে প্রাণপ্রিয় দেশ প্রতিষ্ঠা করেছে তারা নাকি তাকে ধ্বংস করবে। সমবেত জনতার ক্রোধের শিকার হয়েছিল ঐ তরুণ। বড় নৃশংস সে মৃত্যু। কিন্তু মুক্তিরা তার প্রতিরোধও নিয়েছিল। সে সময়ও বেঁচে গিয়েছিল খোকন। আমার ভাগ্য খুব ভালো— নিজেকে সাহস দেয়, হাদউল ইসলাম খোকন। মনে পড়ে আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’-এর সনেটগুচ্ছ রচনার সময় সে তার সঙ্গে ছিল। সদ্য হওয়া পিটে খাওয়ার মতো সদ্য লেখা তাজা কবিতা বা কবিতাগুলো পড়েও সে খুব খুশি হতো ও আনন্দ পেতো। আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটিও ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন, চল না জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি; দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না; তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোহে পরস্পর হবো চিরচেনা। কবিতাগুলো ভালো লাগতো না শুধু, বেশ ভালো লাগতো। কিন্তু আবার এও মনে হতো, ভালো লাগা উচিত নয়— কিন্তু সদ্য লেখা কবিতাগুলো ভালো না লেগেও পারতো না। নির্জনে বসে ভাবতে গিয়ে মনে হতো, এ শয়তানের ওয়াসওয়াহ নয়তো? মিল্টনের কথা, এলিয়টের কথা মনে হতো। মিল্টন কনজারভেটিভ, পিউরিটান ও ধর্মভীরু— কিন্তু প্যারাডাইস লস্টে দেখি বুর্জোয়া বিকাশের লক্ষণ— শয়তানের কথাকে যৌক্তিক মনে হয়— এলিয়টও মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল লিখে— গীর্জায় পুরোহিত হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সেই দ্বাদশ শতাব্দীতেই বুর্জোয়া বিকাশের কথা বলেন অথচ তিনিও ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপন্থা ক্লাসিক ও কনজারভেটিভ। তাহলে কি সত্য প্রচলিত কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসে? আল মাহমুদের কবিতাও কি তাই? তাহলে কেন সনেটগুচ্ছতে সরল সত্যের উন্মোচন ও উত্থান? যে কবিতাগুলোতে তিনি বলেন ‘বধূ বরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল/ গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল’ সেখানে কেন এরকম পঙক্তিও লেখা হয় ‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত/ হিয়েনগাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা/ এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত/ তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীচের তকোমা’? তাহলেও মূল বিশ্বাস থেকে আমি সরে আসি না। যখন দুষ্কৃতকারীরা পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে নামে, গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন আমিও তার বিরুদ্ধে নিজের ভূমিকা পালন করি। আপার বাবার মৃত্যুতে তার একটা ক্ষোভ ছিল। ফলে সেভাবে আমার প্রতি তার একটা দুর্বলতা ছিল কিন্তু তিনি তো ছিলেন বিপরীত পক্ষের লোক। ফলে শেষের দিকে যখন যুদ্ধ শেষ হয়নি কিন্তু এই শহরটা মুক্ত হয়ে গেছে তখন বিশেষভাবে পলায়ন অথবা আত্মগোপনের দরকার হয়ে পড়ে। আপা বললো, তুই আমার বাসায় থাক। আমার বাসার কয়েকটা ভাগ, নানা জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো নানা কক্ষ। এমনভাবে থাকবি যেন কেউ দেখতে বা ধরতে না পারে। সেভাবেই থাকছিলাম। কিন্তু শেষে পড়বে তো পড় মালির ঘাড়ে। একদিন কয়েকজন মুক্তি এলো। তাদের কারো কাছে অস্ত্র, কেউ নিরস্ত্র কিন্তু ক্রোধে সবাই টগবগ করছে, যেন মুক্তিযুদ্ধের শত্রু পেলে ছিঁড়েফুড়ে ফেলবে। সেরকম অবস্থায় মুক্তিরা যখন এলো তখন দূর থেকে দেখতে পেল খোকন। পালাবার আর কোনো পথ নেই কিংবা একটু দেরি হলেই ধরা পড়ে যেতে পারে সেই ভয়ে সে কাছের চৌকির নিয়েই ঢুকে পড়লো। আর তার এমন মন্দ ভাগ্য বদমাশগুলোও সেই চৌকির ওপর এসে বসলো। ঘুরেফিরে এক সময় এলো তার প্রসঙ্গ। বলল, সেই শুয়োরের বাচ্চা কই? এ শহর থেকে হাওয়া হয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। কুত্তার বাচ্চাকে খুঁজে বের করতেই হবে। তারপর বেয়নেট চার্জ করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নড়ক যন্ত্রণা দিয়ে তাকে মারতে হবে, না হলে জ্যান্ত কবর দিতে হবে। গালাগাল আর তার সঙ্গে মৃত্যুর সব বীভত্স বর্ণনা দিয়ে আমার সম্পর্কে এমন সব কথা বলছিল মনে হচ্ছিল, যেন নিচ থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু জীবন এতো প্রিয় যে তাদের সব কথা নীরবে হজম করলাম এবং ভাবলাম, আমারও একদিন দিন আসবে। আজ সেইদিন। প্রেসিডেন্ট সাহেব এই মহকুমা শহরে আসবেন। এবার হয়তো তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যাবে না, যা বলার অহিদুল্লা খুররম সাহেবই বলবেন। কিন্তু খুররম সাহেবের সঙ্গে তো দেখা করতে হবে। সেজন্য নিজেকে প্রস্তুত করে।
ছয় মাঠটা মানুষে ভরে গেছে। নানা ধরনের মানুষ এখানে এসেছে। পঁচাত্তরের ঘটনার পর মানুষ দেখতে এসেছে নতুন এই প্রেসিডেন্ট কী বলতে চান। পঁচাত্তরের নায়ক বা খলনায়কদের কেউ কেউ বলেছেন সূর্যসন্তান। যে পরিবর্তন মনে হয়েছিল অসম্ভব তারা তা সম্ভব করেছে। এরকম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিশুকেও হত্যা করা হয়েছে। সেটা দুঃখজনক কিন্তু হয়তো তাদের দিক থেকে অকারণ নয়। যারা বাংলাদেশ চায়নি কিন্তু এতোদিন বলতে পারেনি, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে, তারাও এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। পাকিস্তান না ফিরলেও তাদের মনে আশা জেগেছে, একটা কিছু হবে। যারা গোপনে শ্লোগান দিতো জয় বাংলা, জয় হিন্দ, লুঙ্গি ছাইড়া ধুতি পিন্দ— তারাও এখন সরব হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশেরও যে নিজের পরিচয় থাকতে পারে সেটা এই ফাঁকে চাপা পড়ে গেছে। সাতচল্লিশে পাকিস্তান জন্মের পরই বোঝা গিয়েছিল, এই রাষ্ট্র টিকবে না। তারপর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর সাধারণ নির্বাচন এবং সবশেষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সমস্ত ভ্রান্তির মধ্যেও এই রাষ্ট্রের সত্তা অমোচনীয়। এটি বোঝার লোক কম। কিন্তু এরা আছে, বৃহত্ মানুষও তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কুজ্ঝটিকায় এই সত্য ঢাকা পড়ে গেছে, কিন্তু আছে। রাতের সব তারাই আছে। দিনের আলোর গভীরে। জনসভায় চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট কি এসে গেছেন? ভিড়ের ধরন দেখে বোঝা যায়, তিনি এসেছেন। ঐ তো সেনা পোশাকে তাঁকে দেখা যাচ্ছে, হাতে লাঠি। জনস্রোতের মধ্যদিয়ে তিনি এগোচ্ছেন। বলা যায়, ভেসে যাচ্ছেন। কলেজের দোতলায় দাঁড়িয়ে সব দেখছেন, কাজল আরেফিন। ষাটের দশকের প্রায় পুরোটা তাদের চোখে দেখা। ইতিহাস তার কাজ করছে আর কাজল দেখছে নিজের চোখে। তাদের চোখে দেখা ঘটনাবলী ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। হয়তো এক সময় এই ঘটনাবলীকে নানাজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করবে, দেখা যাবে কেউ কেউ পরস্পরবিরোধী বিশ্লেষণ করতেও দ্বিধা করছে না। ঘটনা এক কিন্তু তার নানা বিশ্লেষণ। যার যার স্বার্থের দিক থেকে ও তাকে রক্ষা করে তার তার বিশ্লেষণ। কিন্তু কাজলের চোখে ভাসে এখনও সেই ঘটনা। সেটা তার কাছে ভবিষ্যত্ রাজনীতির মেরুকরণকেও স্পষ্ট করে। প্রেসিডেন্টকে প্রায় ধরে ধরে এগোচ্ছেন অহিদুল্লাহ খুররম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি যা বললেন তা কাজল এখান থেকেও শুনতে পেল, বাবা গো, এতদিন কোনও কথা বলতে পারিনি। এখন থেকে পারবেন— প্রেসিডেন্ট সান্ত্বনা না সিদ্ধান্ত দিলেন সেটা এখনই এখান থেকে বুঝতে পারলো না কাজল।
সাত তবে পরে তার প্রবণতা কাজল আরেফিনের কাছে খুব একটা অস্পষ্ট থাকেনি। তখন তিনি নিয়মিত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। একদিন খবর এল অর্থাত্ মহকুমা প্রশাসন জানাল, প্রেসিডেন্ট কলেজের সামনের পথ ধরে কোথাও যাচ্ছেন। কলেজের সবাই যদি সে সময় সড়কে দাঁড়ায় তার ভালো লাগবে। কিন্তু তার আসতে অনেক বিলম্ব হয়েছিল। লান্সটাইম পেরিয়ে বিকেল চারটার ওপর হয়ে গেছে। প্রশাসনও আর জোর করেনি, যে যার বাসায় চলে গেছে। পরে পড়ন্ত বিকেলে কলেজের কাছ দিয়ে কাজল আবার উল্টোদিকে যাচ্ছিল। দেখল, উপাধ্যক্ষ কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিই তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ ছিলেন না। আপনি স্যার? না, খবর পেলাম, দশ মিনিটের মধ্যে প্রেসিডেন্ট সাহেব এই দিক দিয়ে পার হবেন। আমাদের কলেজের সামনে দিয়ে যাবেন, আমরা কেউ থাকবো না, তাই কি হয়? কিছু মনে করবেন না কাজল সাহেব, এসেই যখন পড়েছেন, একটু দাঁড়ান। কী আর করা? দাঁড়ালাম। সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িবহরের হৈচৈ শোনা গেল। প্রেসিডেন্টের গাড়িটা কলেজের গেটে এসে বেশ স্লো হলো। অত্যন্ত স্পষ্ট গলায় প্রেসিডেন্ট আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রফেসর সাহেবরা কেমন আছেন? উপাধ্যক্ষ একেবারে গলে গেলেন, দেখেছেন কাজল সাহেব, এরকম অমায়িক না হলে ও বড় গুণ না থাকলে আল্লাহ কাউকে এত বড় করেন? কাজলকে নিরুত্তর দেখে একটু হতাশ ও বিব্রত হন তিনি। আর কাজলের মনে হয়, খুবই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ এই প্রেসিডেন্ট এবং খুবই হিসেবী।
আট জামিলুর রেজা একটি দৈনিকের ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। আগে ফ্রি লান্স করতো। পরে মনে হয়েছে, এক জায়গায় থিতু হওয়া দরকার। তাই হয়েছে। নানা উত্সাহে সে টগবগ করে। বিভিন্ন ও বিচিত্র তথ্যের সন্ধানে থাকে কিন্তু তার লক্ষ্য সত্যানুসন্ধান। গণজাগরণ মঞ্চ ও শাহবাগ নিয়ে বেশ ক’টি রিপোর্ট করেছে, পাঠকের উষ্ণ সমর্থন ও অভিনন্দনও পেয়েছে। এখন গণজাগরণ মঞ্চ ও শাহবাগে ফাটল ধরানো হয়েছে। আর তা তেমন সক্রিয় হতে পারছে না। কিন্তু জামিলের আইনমন্ত্রী যা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী তা সমর্থন করেছেন। অর্থাত্ সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে তারা অনীহ। ভোট-রাজনীতি বা নগদ লাভের আশায় তারা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অথবা নিজেদের, আগলে জাতির পায়ে কুড়াল মারছেন। কিন্তু তারা জানেন না, ওরা কিন্তু বসে নেই। নানা নামে, এমনকি পরস্পরিবিরোধী বলে পরিচিত হয়েও তারা অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করছে। যতই তিনি বা তারা তাদের তোয়াজ করুন ততই তারা ‘জালিম পিতার জালিম কন্যা’ বলেই তাকে জানে ও সেভাবে প্রচার করে। এ বিষয়ে তারা দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের বুদ্ধিমান ছাত্রদেরও কাজে লাগায়। নাম বদলে তারা এমন নাম গ্রহণ করে যে তাদের চেনাও কঠিন হয়ে পড়ে। ‘মনন’ বা ‘মুক্তি’ নামের শব্দ ব্যবহার করে তারা ক্যামোফ্লেজ করে। অথচ এই রাজনৈতিক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতার পুত্র হায়দার ফারুক গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশে এসে তার মুখোশ খুলে গিয়েছিল। ঢাকার একিট দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ইসলামের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তার জন্য জামায়াত বা হেফাজতের দরকার নেই। আবুল আলা মওদুদী সম্পর্কে তার পুত্র হায়দার ফারুক বলেছেন, তার বাবা তার সন্তানদের কাউকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করতে বলেননি, তিনি তার নয় সন্তানকেই বিদেশে লেখাপড়া করিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি একটি চমত্কার উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘একজন মাদক ব্যবসায়ী যেমন চায় না তার সন্তানরা কেউ মাদক সেবন করুক তেমনি বাবাও আমাদের জামায়াতের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখেন।’ এমনকি তারা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দলের কর্মকাণ্ড দেখুক তাও তিনি হতে দিতেন না। এ দলকে হায়দার ফারুক ফ্যাসিস্টদের দল বলে মনে করেন। এ দলের আমির তার মতে, সেনাবাহিনীর প্রধানের মতো, যাকে কখনো চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার সময়ই এই দলের গঠনতন্ত্র দেখে মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, এ দেখছি ফ্যাসিস্টদের দল হবে। এ প্রসঙ্গে তার যে উপলব্ধি হয়েছে মূর্খতা অথবা মতলবের জন্য অনেক বাংলাদেশী নাগরিকের তা হয়নি। হায়দার ফারুক বলেছেন, যে কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে কারণে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনি আরো বলেছেন, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের কারণেই পাকিস্তানের যত সমস্যা ও সহিংসতা। জামিল দেখেছে, স্বার্থের কারণে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কত ভুল ও অর্ধ-সত্য অর্থাত্ সাদা মিথ্যার চেয়ে জঘন্য ও অপরাধপ্রবণ অসত্য ও মিথ্যা প্রচারিত হয়। ঢাকার একটি দৈনিক গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় তার কুত্সা রটনার জন্য হেন অসত্ পথ নেই যা বেছে নেয়নি। একদিন তাদের প্রধান শিরোনাম হয়, ‘শাহবাগে ইসলাম বিরোধী ব্লগারদের কথিত আন্দোলনের পেছনে ভারতীয় মদদের আরও এক নজির।’ বিষয়টি হচ্ছে ২০১৩’র ১৭ মার্চ প্রকাশিত কলকাতার ‘দেশ’, যেখানে তারা শাহবাগ তথা গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে প্রচ্ছদ করেছে এবং এ বিষয়ে সম্পাদকীয় লিখেছে ও প্রতিবেদন ছেপেছে। দৈনিকটি বলছে, এ বিষয়ে সাময়িকীটি নাকি ‘শাহবাগের বন্দনায় মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।’ বলা হয়েছে পত্রিকাটি ‘মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে।’ ‘বাকশাল কায়েমে উসকানি দিচ্ছে কিনা’ সে প্রশ্নও তাদের মনে জেগেছে। অথচ পত্রিকাটি কী বলেছে? সম্পাদকীয়র শিরোনাম ‘এ এক নতুন একুশে ফেব্রুয়ারি।’ তার শুরুটা জামিলের মনে আছে, ‘আজ শুধু ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ার নয়, জনজোয়ারে ভাসছে সমগ্র বাংলাদেশ। দেশের লক্ষ তরুণ আর সাধারণ মানুষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘাতক এবং রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার, আন্দোলনে উদ্বেল। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ অগ্নিতপ্ত, অশান্ত।’ তারা আরো লিখেছে, ‘একথা আজ কারও অজানা নয়, পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনের মঞ্চেই স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির বীজ উপ্ত হয়েছিল। বাংলাভাষার শক্তি ও সম্ভাবনার গভীরতা সেদিন পাকিস্তানের শাসকরা পরিমাপ করতে পারেননি। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আর নিছক একটি দিন মাত্র নয়, স্বাধীনকামী মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এই দিনটিকে রাষ্ট্রপুঞ্জ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তাই দ্বিধা করেননি। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন— মধ্যবর্তী এই কুড়ি বছর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মায়ের ভাষাকে বুকে আঁকড়ে ধরে শেকল ছেঁড়ার শপথ নিয়েছিলেন একাত্তরে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ এবং অবশেষে স্বাধীনতা। বাংলাদেশ নামে এক নবীন রাষ্ট্রের জন্ম— যার নামের মধ্যেই জ্বলজ্বল করছে বাংলাভাষা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত। তবু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় ও সম্মানীয় ইতিহাস।’ তারপরই পত্রিকাটি লিখেছে, ‘স্বাভাবিকভাবেই এই ইতিহাসে মিরজাফরদের স্থান নেই। স্থান নেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকা গণহত্যাকারী ও গণধর্ষকদের।’ এখানেই কি দৈনিকটির আঁতে ঘা লেগেছে? গণহত্যাকারী ইত্যাদির সঙ্গে যারা জোট বেঁধেছে তারাও স্বভাবতই শাহবাগের বিপক্ষে চলে গেছে। মাটিতে বাড়ি দিলে গুণাহগারের গায়েও লাগে এবং তারা স্বভাবতই চেতে ওঠে। আর সুমন সেনগুপ্তর প্রতিবেদনে শাহবাগের প্রতিবাদী শব্দগুচ্ছকে যে ‘নূপুরের রিনিঝিনি’ থেকে ‘ঢের শ্রুতিমধুর’ বলা হয়েছে কিংবা বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ নামক ছোট এই ভূ-খণ্ডের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে...’ কিংবা এই যে বলা ‘ছাত্র যুবমানসের এই পরিণতি মনস্কতাকে কুর্ণিশ না জানিয়ে উপায় নেই’ তাতেই ওদের গায়ে জ্বালা ধরে গেছে? ভালো কিছু কি ওদের সহ্য হয় না, নাকি ভালোকে খারাপ করতে বা বলতে না পারলে ওদের শান্তি নেই? সম্প্রতি এক প্রধান নেত্রী অথবা নেতা বলেছেন, কলকাতার থিয়েটার রোডে তারা যখন থিয়েটার (?) দেখছিল তখন তাদের পরবর্তীকালের প্রতিষ্ঠাতা রণাঙ্গনে ছিলেন। কিন্তু পারভেজ আলম যেমন তার বইতে বলেছেন ‘অস্ত্রহাতে যুদ্ধই রাজনীতি না’ তার ধারা অনুসরণ করে অথবা না করে সাধারণভাবেই সকলে জানেন, যুদ্ধ নিজেই এমন একটা বিশাল ব্যাপার যে, শুধু জেনারেলদের দিয়ে তা হয় না, সেজন্য যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবক, বেসামরিক ব্যক্তি। তিনিই যুদ্ধের আরম্ভ, বিরতি ও তা সমাপ্তির আদেশ দেন। বোকাদের কতই না বুদ্ধিহীনতা। যার ডাকে জামিলুর রেজা এই রেস্তোরাঁয় বসে আছে সেই সাবেরা (সুলতানা) এখনও এসে পৌঁছেনি। অনেক ভেবে ভেবে ও স্মৃতিতে ঘুরে এসে যখন সে উঠতে যাবে তখনই স্মিত হেসে তার সামনে এসে দাঁড়াল সুলতানা। নামের দুটো অংশ নিয়েই যখন যেরকম ইচ্ছে হয়, ডাকে জামিল। — নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছ। - হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে হাসিতে সামান্য উপশম হয়েছে। - এতো সিরিয়াস মানুষের এতো রস তথা রোমান্টিকতা কোথায় থাকে বলতো? - আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে। - তা থাকুক। আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারবো না। - তাই? রবীন্দ্রনাথ, তারপর রফিক আজাদ— মাধবী এসেই বলে যাই? - বলতে পারো। - এতদিনেও তোমার ধরা দেবার সময় হলো না? - না, এখনও পরীক্ষা চলছে। ফল বেরতে অনেক দেরি। তবে সবুরে মেওয়া ফলে। - তথাস্তু।
এরপর সামান্য স্ন্যাকস আর কফি খেয়ে সাবেরা চলে গেল। যাওয়ার আগে খামবই একটা কিছু দিল। জামিল খুলতে যাবে, বাধা দেয় সাবেরা। - না, এখন না। বাসায় গিয়ে ধীরে-সুস্থে খুলো। তার প্রত্যাশিত বার্তা পাবে ভেবে দ্রুত বাসায় যায় জামিল। জামাকাপড় খুলে সহজভাবে খামটা ছেঁড়ে। এ কী? এ যে কবিতা। পড়তে পড়তে ভ্রু কুঞ্চিত হয় জামিলের।
এ ঋতুর একটা ফল জাম। তোমাকে পাঠাচ্ছি একটা পয়গাম। ভেবেছ আমি তোমার প্রেম না, এ এক গেম। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রচনা করেছ এতোদিন বোঝোনি আমি কে তোমার কাছে আমার নেই কোনো ঋণ তোমার দরজায় সর্বত্র বেজে যাবে ব্যর্থ দিন আমার হয়েছে কাজ শেষ ধরে নাও নিয়েছিলাম ছদ্মবেশ তোমার পেয়েছি সব খবর যুদ্ধ ও প্রেমে সব ঠিক তুমি ভেবেছ প্রেম, আমার কাছে ছিল তা যুদ্ধ হারে যে তার ঘটে পরাজয় আমি আমি নয়, আমি নয়, আমি নয় আমার হয়েছে সব খবর জোগাড় এবার আমি যাব হয়ে যাব পার। ব্যবহূত, ব্যবহূত, ব্যবহূত হওয়ার, দুঃখ, ক্ষোভ ও জ্বালায় ধপ করে সোফায় বসে পড়ে জামিল।
নয় লতিফুর রহমান দুই ক্ষেতের মাঝখানের আইল দিয়ে হাঁটছেন। সবুজ ফসলের মাঠ দেখে মনে হচ্ছে না, এখানে খুন, রাহাজানি, অত্যাচার, নির্যাতন নিত্য ঘটনা। রাজনীতিতে এখন আর আদর্শ ও জনস্বার্থ নেই। এটা হয়ে উঠেছে পেশা অথবা ব্যবসা। পেশাও সেরকম পেশা যে পেশায় ঘুষ ও দুর্নীতি প্রধান তত্পরতা। উল্টোদিক থেকে দৌড়ে আসছিল মোহাম্মদ হান্নান। তাকে দেখে গতি ধীর করতে করতে একেবারে হাঁটার পর্যায়ে চলে এলো। - চাচা, কই যান? - কই যামুরে বাবা, হাঁটি। ছেলেটি চলে গেলে তার মনে হয়, এক সময় আমরা বলেছি, সোনার বাংলা শ্মশান কেন? এখন বলি, রাজনীতিতে অপরাধ করেনি এমন কেউ নেই। তাই তিলকে তাল করে নিজেদের বদনাম করা ঠিক নয়। লতিফুর রহমান ভাবেন, কোন্টা তিল আর কোন্টা তাল তাই তো বুঝি না। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত যিনি লিখেছেন তিনিই তো বলেছেন, সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনও করে না বঞ্চনা। সে কথা কি আমরা ভুলে গেছি, নাকি ভুলতে চাওয়ার মধ্যেই আমাদের আরাম? মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের সম্মান জানানোই যদি মূল কথা হয় তাহলে মাটির, মৃত্তিকার কোনো জিনিস দিলেই হতো, দিতাম বস্তুমূল্যহীন অর্থাত্ অমূল্য কোনো প্রতীক। কিন্তু তা না করে সোনা দিতে গিয়ে এত বড় কেলেঙ্কারি করলাম মুক্তিযুদ্ধের নামে, সে কি ঠিক হলো? সত্যি সেলুকাস—! অবসর নিয়ে গ্রামে এসে ভাবলাম, দূষণ থেকে বুঝি মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু গণমাধ্যম এখানেও ঘরে ঢুকে সব জানিয়ে দিচ্ছে— খুনের ঘটনায় কেউ আর অবাক হয় না, জানতে চায় কত নিষ্ঠুর বীভত্স আর পশুত্বের সাথে তা করা হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে বিষণ্ন হন লতিফুর রহমান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পর প্রসন্ন হতে না পারলে তো আমাদের চলবে না। একদিকে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, আরেকদিকে বাড়বে বৈষম্য ও দুর্নীতি। এভাবে তো চলে না, চলবে না। অকালপ্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আশা করেছিলেন, দিন আসবে, দিন আসবে, দিন আসবেই সমতার। তবে কি আমরা উল্টোযাত্রা করেছি, করছি? এভাবে যেতে যেতে আমরা কোথায় পৌঁছুবো? তাতে আমার নিজের ক্ষতি, নিজেদের ক্ষতি, ক্ষতি জাতি ও রাষ্ট্রেরও। অতএব ঠিক পথে যেতে হবে, ভাই। মনে মনে বিড় বিড় করেন আর হাঁটেন লতিফুর রহমান। চারপাশ দেখতে দেখতে, সামনে এগুতে এগুতে আবারও বিড় বিড় করেন তিনি, আমাদের যে ভিন্ন পথে যাবার উপায় নেই।