মানুষের শরীর যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে তখন তার বোধ এবং মস্তিষ্ক একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে। বোধ যা কামনা করে মস্তিষ্ককে জানায়, তা-ই তার আকাঙ্ক্ষার বিষয় হয়ে ওঠে। সেই অর্থে ওই কামনাগুলো নেহাত্ই জাগতিক। বাক্স থেকে নতুন জুতো বের করে শিশু আনন্দিত হয়, নতুন চামড়ার ঘ্রাণ তাকে মোহিত করে, কিন্তু পায় দেওয়ার পর সে আর জুতোটার ঘ্রাণ নেয় না। তখন মস্তিষ্ক তাকে নিবৃত করে। এককালে বালকদের যেমনখুশি তেমন ব্যবহার করার জন্যে ‘নটি বয় শ্যু’ কিনে দেওয়া হত। তার আকৃতি শোভন ছিল না, কিন্তু জুতো ছিল মজবুত। সারা বছরে চামড়া উঠে গেলেও ছিঁড়তো না। সহপাঠীর নতুন আকৃতির জুতো দেখে তা বোধ খবর পাঠাল মস্তিষ্ককে। মস্তিষ্ক তাকে বায়না করতে শেখাল। সেই বায়না যদি অভিভাবকরা আমল না দিয়ে আবার সেই ‘নটি বয় শ্যু’ কিনে দেন তাহলে তার বোধ ও মস্তিষ্ক আহত হল। সে রেগে গেল, কাঁদল, কথা বলা বন্ধ করলে কেউ কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলা হল—তার মন খারাপ।
শৈশব এবং বালক বয়সের প্রাথমিক পাঠ বোধ ও মস্তিষ্ক মিলে মিশে যে প্রতিক্রিয়া দেখায় তাকে বলা হল—ওর মন খারাপ অথবা ওর মন ভালো। এখানে জাগতিক চাওয়া পাওয়ার আশা-হতাশাকেই খারাপ ভালো বোঝাতে তাদের আগে মন শব্দটা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার হলে কঠিন প্রশ্ন আসায় ভাল লিখতে না পারার জন্য মন খারাপ তৈরি হয়ে গেল। তার বোধ বলল মস্তিষ্ককে, মস্তিষ্ক প্রতিক্রিয়া জানাল।
কিন্তু একটা সময় এল, প্রতিটি মানুষের জীবনে যা আসে, তার বোধ, মস্তিষ্ক, জাগতিক চাওয়া পাওয়ার বাইরে ধীরে ধীরে একটা অনুভূতি তৈরি হল। সেই অনুভূতি মানুষ বিশেষ দুর্বল বা সবল হয়। হয়ে মানুষের সঙ্গে ভান করে বন্ধুর মত। শরীরের বাইরে সেই বন্ধুর নাম—মন। এটা তার দ্বিতীয় অস্তিত্ব। সেই মন কখনও ভালো থাকে, কখনও ভালো থাকে না। কখন কি কারণে সেটা হচ্ছে তা কোনো ব্যাকরণ মেনে হয় না। সেই মন সম্পূর্ণ স্বাধীন কিন্তু বড় স্পর্শকাতর। বিকেল শেষে সূর্যের কাতর আলো দেখে বিষণ্ন হয়ে গেল সেই মন। তার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটল মনে। কেউ জিজ্ঞাসা করল ম্লানমুখে জবাব আসবে, ‘মন ভাল নেই।’ তখন আর মন খারাপ হয় না, মন ভালো থাকে না বললেই ঠিকঠাক বলা হয়। ভোরের বেলায় ঘুম ভাঙতেই কানে এল, ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার—।’ সঙ্গে সঙ্গে মন ভালো হয়ে গেল। কি পেল মন? সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সব ম্লানতা ক্ষমা করে দেওয়া যায়। ওই প্রভাত শুধু অন্ধকার দূর করার ভূমিকা নেয় না, প্রাণের সোনার ঘট আলোয় পূর্ণ করে দেয়। এই মনন, যার শরীর নেই অথচ প্রবলভাবে আছে, তার হাত ধরে জীবনের বাকী পর্বগুলো হেঁটে যেতে হয় আমাদের।
পনের বছর বয়সে যে মেয়েটি আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে বাধ্য হয়েছিল সে আমায় দেখে গান গেয়েছিল— ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব—!’ তখনও মন আমার বন্ধু হয়নি। বোধ মস্তিষ্ককে খবরটা দিতেই মস্তিষ্ক সতর্ক করেছিল, ওই ন্যাকা মেয়ের কাছাকাছি যেয়ো না। যে আমাকে জোর করে চুমু খেয়েছিল কিন্তু তার স্বাদ পোড়া বিড়ির মত লেগেছিল। আশ্চর্য আমি কোনোদিন পোড়া বিড়ি খাইনি। সে চলে গিয়েছে, আর দেখিনি কখনও। একুশ বছর বয়সে রাত নটায় যখন একা হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে, তখন রেডিও থেকে ভেসে আসা গান কানে এল, ‘ হয়তো কিছুই নাহি পাব—!’ শোনা মাত্রই কি রকম অসাড় হয়ে গেল মন। বুঝলাম, এখন আমার মন ভাল নেই। ছয় বছর পরে একই গান আমার মনকে বিষণ্ন করল। সেই মেয়েটি মুখ কল্পনা করলাম। সে কি এখনও ওই গান গায়? কাকে শোনায়? দুটো দিন মন ভালো ছিল না।
সকাল থেকে আকাশে মেঘ, আলো প্রায় নেতিয়ে। ভর দুপুরে মেঘেরা আকাশের দখল নিয়েছে। সেদিকে তাকাতেই মনে ভার জমল। এই রকম দিনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার, দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার—হায় রে’। কিন্তু তাঁর তো প্রবল চাওয়া ছিল। তিনি প্রতীক্ষায় ছিলেন যার জন্যে সে যদি তাঁকে খুঁজে না পায় তাই চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু তারপর তাঁর কবিমন অনুভব করল, ‘বাদল-দিনের দীর্ঘশ্বাসে জানায় আমায় ফিরবে না সে— / বুক ভরে সে নিয়ে গেল বিফল অভিসার।’ সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটা বদলে গেল। যে মন বাদল দিনের দীর্ঘশ্বাস এমন বার্তা শুনতে পায় সে অনেক ধনে ধনী।
মন ভালো নেই। আমাদের চারপাশে যা ঘটে যাচ্ছে তা দেখে, কাগজে পড়ে দেখি মন কিরকম মুষড়ে আছে। অসৌজন্য, অশালীন শব্দাবলী, যার একটাও আমাকে উদ্দেশ্য করে নয়, যা আমার জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে না, তা আমার মনকে প্রভাবিত করছে। মন ভালো থাকতে পারছে না। যে শিশুকে স্কুলের ভেতরে ছয় বছর বয়সে মারা যেতে হয় সে তো আমার কেউ নয়। তবু সকালে টিভিতে তার ছবি দেখার পর মনের অশৌচকাল শুরু হয়ে গেল। কিছুতেই তার ওপর চেপে বসা ভার কমছিল না। কবি যতই বলুন—‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। / তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। ... নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, / নাহি নাহি দৈন্যলেশ’—এমন ভাবনা তো সহজে আসে না।
অল্প বয়সে যেসব ইংরেজি শব্দ শুনিনি তার একটি হল, ডিপ্রেশন। শরীর নয়, মস্তিষ্ক নয়, আমার সঙ্গী ‘মন’ ভালো না থাকতে থাকতে যখন নেতিয়ে পড়ে তখন ওই শব্দটাকে ব্যবহার করা হয়। এই অবস্থা মানুষের বোধ বুদ্ধিকে অসাড় করে দেয়, সামনে যখন ধূ ধূ শূন্যতা তখন আত্মহননের পথ বেছে নিতে চায় কেউ কেউ। সেই সময় একটাই ওষুধ দরকার, মন পরিচর্যা চায়, বন্ধুর স্পর্শ পেয়ে ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পায়, নেতিয়ে পড়া মন আবার সোজা হয়ে ওঠে। মন কতটা ভালো না থাকলে এই ডিপ্রেশন উদয় হয়? কতটা অবসাদে?
মনের বিশারদরা বলেন এটা ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভর করে। কেউ বহু আঘাত সামলেও স্থির থাকেন, মন ভালো না থাকলেও তাকে সহজ করে নিতে পারেন। আবার কেউ সামান্যতেই সামলে উঠতে পারেন না। আবার সেই রবীন্দ্রনাথ। এক জীবনে তাঁর মন যত আঘাত পেয়েছে তাতে তাঁর ডিপ্রেশনে ডুবে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। আমি বা আমার মত মানুষেরা হয়তো আত্মহননের পথটাই বেছে নিতাম। রবীন্দ্রনাথের মন ভালো না থাকলেও ডিপ্রেশন তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারেনি। কী অনায়াসে তিনি লিখলেন, ‘মনে যে আশা নিয়ে এসেছি হল না, হল না হে’। আচ্ছা, প্রথম হল না বললেই তো হয়ে যেত, পরের হল না হে, কেন বললেন? ওই ‘হে’ কার উদ্দেশ্যে বলা? আর তখনই মনে হয় আমাদের সঙ্গী যখন একখানা মন, যাকে নিয়ে হাসি-কাঁদি, ভালোবাসায় অথবা না-ভালোবাসায় বাঁচি তখন রবীন্দ্রনাথের অন্তত দুটি মন সঙ্গী হয়ে থাকতেন। একটি মন যখন কষ্ট পেয়ে ভাল না থাকত তখন দ্বিতীয় মন সেই কষ্টটাকে দূরে ফেলে তার জঞ্জাল থেকেই ভালোবাসার আকাশ তৈরি করত।
‘আমার দুঃখজোয়ারের জলস্রোতে / নিয়ে যাবে মোরে সব লাঞ্ছনা হতে।’ এই রকম ভাবনা সাধারণ মানুষ ভাবতে পারে না। পারে না বলেই তাদের মন ভালো না থাকার সময়টা কখন শেষ হবে, তা তারা জানে না।
সকালে ঘুম ভাঙল। লেখার কাজে বসলাম। হঠাত্ মনে এল একজনের কথা যাকে বহু বছর দেখিনি। কিন্তু কিছুতেই তার নাম মনে পড়ছে না। তার মুখ চোখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কি নাম ওর? মনে করার চেষ্টা করেও যখন পারলাম না তখন লেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই লেখা আসছে না। আমার সঙ্গী, আমার মন কেবলই তার নাম জানতে চাইছে। কার কাছে নামটা জানতে পারি? একে তাকে ফোন করে করে যখন তার নাম ও ফোন নম্বর পেলাম, দেখলাম সেটা পুরনো। নম্বর যে দিল সে জানাল বহু বছর যোগাযোগ নেই। ডায়েরিতে লেখা ছিল। যেন একটু মেঘ ছিঁড়ল, প্রবল উত্সাহ নতুন নম্বর টেলিফোন অফিস থেকে সংগ্রহ করে ডায়াল করলাম। একজন মহিলা রিসিভার তুললেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। মহিলা একটু থেমে থেকে বললেন ‘উনি গত ছয় মাস কথা বলতে পারছেন না। সেরিব্রাল অ্যাটাক হওয়ায় পক্ষাঘাতে আক্রান্ত, শয্যাশায়ী হয়ে আছেন।
এতক্ষণ নাম না মনে পড়ার জন্যে অস্বস্তি হচ্ছিল, এখন মন ভাল রইল না। সেই সুদর্শন ছেলেটির এই অবস্থা হয়েছে, এমন আশংকা থাকলে আমি কি ওর সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হতাম? না হলে মন ভাল থাকত, নাম জানার পর স্বচ্ছন্দে আমি আমার কাজ করতে পারতাম। ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ শুনেও সহজে মন ভালো করতে পারছি না। এ এক ভয়ানক জ্বালা।
সেই ছেলেটিকে জানি। অবশ্য এখন তাকে ছেলে বলা যায় না। একাত্তর সালে নকশাল আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে পুলিশ যখন অনেককে গুলি করে মেরেছিল, তখন তাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকরা। প্রথমে দাদার কাছে ছিল, পরে নিজে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। দাদার বাড়িতে থাকার সময় ও কারও সঙ্গে কথা বলত না। নিজের মত থাকত। চাকরিতে ঢোকার পর সেখান নিশ্চয়ই কাজের কথা বলত, কিন্তু তার বাইরে কাউকে বন্ধু হিসেবে নেয়নি, প্রেম করেনি, অবিবাহিত থেকে গিয়েছে। আজ তার তেষট্টি-চৌষট্টি বছর বয়স। কীভাবে এতগুলো বছর একটা মানুষ নির্বাক থাকে? নিউজার্সিতে তার বাড়িতে গেলে সে আমাকে দেখে বিরক্ত হয়েছিল, প্রশ্নটা করলে জবাব দিয়েছিল, ‘সমরেশদা আমার মন ভালো নেই। আপনি আসুন।’ প্রায় তেতাল্লিশ বছর ধরে ওর মন ভালো নেই। হায়, ওর যদি দুটো মন থাকত!
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের যেমন, তেমন মনের বয়সও বাড়ে। যত বয়স বাড়ে তত সে অভিজ্ঞতা থেকে সমৃদ্ধ হয়। তরুণ বয়সে যে আবেগে তার মন ভালো থাকে না, পরিণত বয়সে সেই আবেগ তেমন কাজ করে না। এখন জীবনের সুরে সুর মেলাতে বেলা বসে যায়।
এই বেলাকে কি শেষবেলা বলে? যে বেলায় শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনও একটু একা থাকতে চায়। একটু নিরিবিলি। তখন ‘মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে’।