ডোরবেলের বাটনে চাপ পড়িবার পর বেশি দেরি হয় নাই। এক সুদর্শনা দরজার ফাঁক গলাইয়া উঁকি দিল। কাকে চাই, এইরূপ শুধাইবার আগেই বলিলাম, ভিতরটা একটু দেখিতে চাই।
উর্বশী কিছুই না বলিয়া তাকাইল। কেউ একজন বলিল—কে আসিয়াছে?
নারী কণ্ঠ শুনিয়া ভিতরপানে তাকাইবার সুযোগটি নিতে আমাদের ভুল হইল না। দেখিলাম মহিলা আগাইয়া আসিলেন এবং বলিলেন, দারোয়ান তো আসে নাই। অন্দরমহলে আসিতে দিতে পারি না। এই বলিয়া তিনি ধড়াম করিয়া কপাট লাগাইয়া দিলেন।
আমি কিছুটা বিচলিত হইলাম। পলাশকে মোবাইল ফোনে ধরিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু পাইলাম না। ও লাইন কাটিয়া দিল। হয়তো ব্যস্ত রহিয়াছে কোন কাজে। এখন গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিবার উপায় কী?
শহিদ বলিল, বুঝিয়াছি। এইখানে দুই নম্বর কাজ হইয়া থাকে।
আসলে ফর্সা তন্বীদের দেখিয়া হয়তো ওর এমনটা বোধ হইয়াছে। আমার কিন্তু তেমন মনে হয় নাই। বরং মনে হইয়াছিল প্রথম যে মেয়েটি দরজা খুলিল, সেই মেয়েটিকে বোধ হয় কিছুক্ষণ আগে রাস্তায় দেখিয়াছি। মুহূর্ত পরেই মনে হইতে লাগিল, মেয়েটিকে আগে বুঝি বা কোথাও দেখিয়াছি! নাকি সুন্দরী মেয়ে মানুষ দেখিলে পুরুষের এমনই মনে হইয়া থাকে—কে জানে।
এই গরমে ছয়তলা সিঁড়ি ভাঙিয়া উপরে উঠিলে গা হইতে ঘাম ঝরিবারই কথা। আমাদের দুইজনেরও ঘামিয়া জবজবা অবস্থা। বেশিক্ষণ এইখানে দাঁড়াইয়া থাকিয়াও লাভ হইবে না। যে দরজা বন্ধ হইয়া গিয়াছে তাহা আর খুলিবার চেষ্টা বৃথা মাত্র। অগত্যা নিচে নামিতে লাগিলাম। সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া নিচে নামিতে কষ্ট কমই হয়। তবে সাবধান থাকিতে হয়। কোন ভাবে যাহাতে পড়িয়া যাওয়ার উপক্রম না হয়। নামিতে নামিতে শহিদ আবারও বলিল, ‘এইখানে দুই নম্বরী কাজ হয়।’
আমি তখন ওর কথা খেয়াল না করিয়া অন্য চিন্তা করিতেছি। যাহা জানি না, কিংবা দেখিতে পাই নাই তাহাই সত্য হিসাবে ধরিয়া লওয়া সঠিক হইতে পারে না। তদুপরি অন্যের ব্যাপারে নাক গলাইবার ইচ্ছাও আমার নাই। শুধু কষ্টের কথা, যাহা দেখিতে আসিয়াছি, তাহার দেখা মিলে নাই। আমি একা হইলে এক রকম, শহিদকে সাথে নিয়া আসিয়াছি। রাস্তা চিনিতেও সময় লাগিয়াছে। দুই-চারজনকে জিজ্ঞাসা করিতে হইয়াছে। ভুলটা আমারই হইয়াছিল। ক্রিসেন্ট রোডের বদলে আমার মনে আসিতেছে কেবল ব্যানানা স্কয়ার। একসময় হয়তো বা প্রচুর কলাগাছ ছিল এই এলাকায়। সেই কারণে নাম হইয়াছে ব্যানানা স্কয়ার। যেমনটা ভূতের গলি। ভূতেরাই কি এইখানে বাস করিত, নাকি ভূতেদের এইখানে আড্ডা জমিত। ব্যানানা স্কয়ার আর ক্রিসেন্ট রোড ভূতের গলির সন্নিহিতই বলা যায়।
নানাজনকে জিজ্ঞাসা করিয়া যখন ক্রিসেন্ট রোডের সেই বাড়িটি খুঁজিয়া পাইলাম, তখন বাহির পানে থাকিয়াই বুঝিলাম আমাদের উদ্দেশ্য সাধন হইবে না। প্রধান সড়ক হইতে ভিতরে, আশপাশের পরিবেশটাও ভাল ঠেকিল না। তবুও আসিয়াছি যখন, দেখিয়া যাইতে অসুবিধা কী!
নীচে নামিয়া শহিদ মোটরসাইকেল স্টার্ট দিতে যাইবে এমন সময় আমার মনে হইল দারোয়ানকে বলিয়া দেখিতে পারি। তাহাতে কৌতূহল কিছুটা তৃপ্ত হইবে বৈকি।
দারোয়ানকে ঘটনা খুলিয়া বলিলাম। কেন আসিয়াছি, কে পাঠাইয়াছে তাহাও বলিলাম। দারোয়ান বলিল, ‘আপনারা প্রথমেই যদি বলিতেন, তবে আমি নিজেই লইয়া যাইতাম। এখন চলেন যাই।’
সাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত দারোয়ানকে ‘চাচা’ সম্বোধন করিয়া বসিল শহিদ। লিকলিকে গড়ন, বয়স ষাটের অধিক হইবে। সেই তুলনায় শরীরে শক্তি-সামর্থ্য ভালোই আছে। দ্রুত সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া উপরে উঠিতে লাগিল। আমরাও পিছন পিছন চলিলাম। জানিতে চাহিলাম, ‘লিফট কবে লাগিবে?’
‘লাগিবে’, চাচা বলিল।
—ভবনটির বয়স কত হইবে।
—৩/৪ বছর।
সিঁড়ির গোড়ায় লিফট লাগাইবার জন্য খালি জায়গা বরাদ্দ দেখিয়া সহজেই মনে হইতে পারে যে লিফট বসিবেই। কিন্তু এত দিনে কেন বসে নাই, সেই প্রশ্নটিও মনের মধ্যে উঁকি দিয়া গেল? এইখানকার নিরাপত্তা নিয়াও মনে সংশয় জাগিল। প্রধান ফটকে ঢুকিবামাত্র দারোয়ান জিজ্ঞাসা করিল, ‘কয়তলায় যাইবেন?’ সাথে সাথেই উত্তর—ছয় তলায় যাইব।
কোথাও এন্ট্রি করিতে হইল না। আধুনিক আবাসিক ভবনে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই হইয়া থাকে। নিরাপত্তার এই শিথিলতাও পছন্দ হইল না। আমরা দুইজন পুরুষ দিব্যি উপরে উঠিয়া গেলাম। কেন আসিলাম, কার কাছে আসিলাম তাহাও কেহ জিজ্ঞাসা করিল না। বরঞ্চ মোটরসাইকেলটি যথাস্থানে রাখিবার পরামর্শ দিয়া দারোয়ান চাচা এমন ভাব দেখাইলেন, আমরা যেন আগেও এই বাড়িতে বহুবার আসিয়াছি।
এইবারও বেলটি বাজিতেই দরোজা খুলিল। দারোয়ান চাচা নিজেই বলিল উনারা বাসাটা দেখবেন। বাসা বলা ঠিক হইল কি না, জানি না। আসলে ফ্ল্যাট বিক্রয়ের সংবাদ শুনিয়াই আমরা সেইখানে গিয়াছিলাম। দরজা ঠেলিয়া দারোয়ান চাচা আমাদের ভিতরে ঢুকাইয়া দিয়া বলিল, ‘আপনারা দেখেন। আমি নিচে যাই।’
বলিলাম, ‘ঠিক আছে।’ কেননা, তাহাকে আমাদের আর দরকার নাই। আমি এদিক ওদিক দেখিতে লাগিলাম। ঢুকিতেই চোখে পড়িল বসার ঘর। তাহাতেই আন্দাজ করিলাম বাসাটি লম্বাটে। যেমনটি এই বাসার ভাড়াটিয়াও। বৃদ্ধ লোকটি কুচকুচে কালো। তবে লম্বায় সাধারণের মতন নহে। টুপি হাতে নামাজ পড়িতে চলিলেন, আমাদের দেখিয়া বোধ হয় থামিলেন। আর যিনি দরোজা ঠাস করিয়া বন্ধ করিলেন, তিনি বলিলেন, ‘আগে দারোয়ান নিয়া আসিলেই হইত।’ দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিলাম, ‘আসলে ভুল হইয়া গিয়াছে। আপনাদের অসময়ে বিরক্ত করিতেছি। কিছু মনে করিবেন না।’
ততক্ষণে ভিতরের কক্ষগুলি দেখিতে লাগিলাম। প্রথমেই যে সুদর্শনা দরজা খুলিল, সেই মেয়েটি কক্ষগুলি দেখাইতে আগাইয়া আসিল। বলিলাম, ‘কক্ষগুলি তো ছোট।’ বসার ঘরকে মাঝখানে রাখিয়া এক পাশে রান্নাঘর এবং রান্নাঘরের পরে দুইটি শোবার ঘর। একটি খোলাই ছিল। অন্যটি ভিতর হইতে আটকানো। সে দিকে না নিয়া ওই মেয়েটি বলিল, ‘সবগুলি এই কক্ষটির মতন।’
উল্টোদিকে আসিয়া আরেকটি কক্ষ দেখিতে যাইব তখনি থামিতে হইল। ইহাও ভিতর হইতে বন্ধ করা আছে। দু’একবার নক করিলেও খুলিবার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া বলিলাম, ‘থাক। যাহা দেখিয়াছি তাহাতেই চলিবে।’
এইবারে আমাদের বসিতে বলা হইল। বিলম্ব না করিয়া আমি বসিয়া গেলাম। যদি এককাপ চা দিবে কিনা জিজ্ঞাসা করে, তাহাও রক্ষা করিব। আসলে সত্যি কথা কি, যেইভাবে দরজা বন্ধ হইয়া গিয়াছিল সেই দরজা যখন খুলিল, তখন ইহা প্রমাণ করিতে চাই যে এই দুইজন পুরুষ অন্যের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এরা খারাপ কোনো উদ্দেশ্যে এইখানে আসে নাই।
কথায় কথায় বৃদ্ধ লোকটিও বসার ঘরের এক পাশে রাখা খাটের কোনায় বসিলেন। শহিদ বসিল পাশের সোফায়। আমার সামনে সেই মহিলাটি আরেকটি সোফায় উপবিষ্ট। অন্যজন দণ্ডায়মান। বৃদ্ধ লোকটাকে বলিলাম, ‘মনে হয় আপনি অবসর জীবনে আছেন।’
—হ্যাঁ।
—কোথায় ছিলেন।
—সচিবালয়ে, কর্মকর্তা ছিলাম।
সচিবালয়ে কর্মকর্তা বলিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হইবে না যে তিনি কোন ধরনের কর্মকর্তা। তিনি কি ক্যাডার অফিসার, নাকি প্রমোটি। সেদিকে না যাইয়া বরং বাড়ির কথাই জিজ্ঞাসা করিলাম। বলিলেন, নেত্রকোনা। ততক্ষণে মনে হইল উপস্থিত অন্যরাও আমাদের প্রতি সহূদয় হইলেন। ধরিয়া নিলাম প্রথম দরোজা খুলিয়াছে যে তাহার নাম রুবাবা ও যে বন্ধ করিয়াছে তাহার নাম উলালা। উলালা আমার সামনের সোফায় বসিয়া এমন ভাবে আমার দিকে দৃষ্টি দিল, আমি ইহাতে বিশেষ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। ফর্সা মুখখানিতে মনে হইল প্রচুর পাউডার মাখান হইয়াছে। গোলগাল মুখখানি, চোখ দুটি টানা, অপেক্ষাকৃত ছোট। মুখের আকার অনুযায়ী চোখের আকার বেশ ছোট বলিয়াই মনে হইল। যদিও আমার চোখ দুটিও ছোট। তাই অনেকেই আমাকে বাঙালি না বলিয়া উপজাতি কিংবা জাপানিদের সঙ্গে মিলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এই দুই জাতির চোখ যত ছোট, আমার চোখ ততটা নয়। তবু কেহ বলিলে তাহার মুখ তো আটকাইতে পারি না। যে যাহা বলিয়া আনন্দ পায় তাহাকে সেটিই করিতে দেওয়া ভালো। বলিয়া রাখি, শুধু যে বাংলাদেশে আমাকে নিয়ে ঐরকম মন্তব্য করিয়াছে তাহা নহে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই শহরেও একই ঘটনা ঘটিয়াছে। কোম্পানির ব্যবসার কাজে একবার জরুরি ভিত্তিতেই আমাকে দুবাই যাইতে হইয়াছিল। সেখানে সফিটেল হোটেলে প্রাতরাশ করিতে গেলে এক মেয়ে আসিয়া আমার দিকে ঝুঁকিয়া বলিল, ‘তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ। টোকিও?’
কথাটি শুনিয়া আমি অবাক না হইলেও কী উত্তর দিব, তাহা স্থির করিতে পারিলাম না। বলিলাম, ‘হু। তুমি?’
সে এই হোটেলেই কাজ করে জানিতে পারিয়া বলিলাম, ‘আমি বাংলাদেশের এক সাধারণ নাগরিক। স্মিত হাসিয়া নিজের কাজে চলিয়া গেল সে।’
লক্ষ্য করিলাম উলালা ওর ছোট কিন্তু টানা চোখ জোড়া দিয়া আমার দিকে তাকাইয়া আছে। তাহার পিছনে সোফায় হাত রাখিয়া রুবাবা দাঁড়াইয়া ছিল। বলিল, ‘আপনি কি ফ্ল্যাট কিনিবেন?’
কথাটির উত্তর কিভাবে দিই। আসলে আমি আসিয়াছি অফিসের বড় কর্তার মেয়ের জন্য ফ্ল্যাটটি পছন্দ হয় কিনা তাহা দেখিতে। ফ্ল্যাটটির মালিক পলাশ আমার ছোট ভাইতুল্য। ঢাকায় নানান ব্যবসায় জড়িত। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী কথাটি পলাশকে দেখিলে মনে পড়িয়া যায়। একদিন কথার ছলে সে বলিয়াছিল যে ফ্ল্যাটটি বিক্রি করিয়া দিবে। তাহার আরও কয়েকটি রহিয়াছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই এইখানে আসা। সাথে শহিদকে নিয়া আসিলাম। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। মাঝখানে কয়েক বছর আমেরিকায় কাটাইয়া আসিয়াছে। ভাল টাকাকড়ি করিয়াছে। তাই ওর সাথে থাকিলে নিজেরও টাকার গরম অনুভূত হয়। চক বাজারের ব্যবসায়ী বলিয়া কথা। ওখানকার তাপমাত্রায় ও আরও বেশি গরম হইয়া থাকে। যাহাই হউক, আমার উত্তর দিতে দেরি হইতেই শহিদ বলিল, ‘উনিই কিনিবেন।’
মনে মনে ভাবিলাম, এই শহরে আমাদের মতন লোকদের চাকুরি করিয়া বাঁচিয়া থাকাই বড় কথা। ইহার বেশি আশা করা যায় না। করিলে নানান বিপত্তিও দেখা দিতে পারে। রোগবালাই হইতে পারে। টেনশন, উচ্চ রক্তচাপ আর ডায়াবেটিসের কথা এখন প্রায় লোকের মুখেই শুনি। তদ্রুপ চাপ সহ্য করিবার ক্ষমতা আমার নাই। এমনিতেই দুই-চার পয়সা বাড়তি আয় করিতে গিয়া অনেক টেনশন লইতে হয়। এইখানে ফ্ল্যাটটি পছন্দ হইলে উভয়পক্ষ হইতে কিছু দালালি পাইতাম। তাহা আর হইতেছে না বুঝিয়া গিয়াছি। বসের মেয়ের জন্য এই ধরনের বাসা মানায় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট করিলাম।
রুবাবা বলিল, ‘ভাড়া দিবেন নাকি নিজেরা থাকিবেন?’
আমি বুঝিলাম রুবাবা এই বাসাটি ছাড়িতে চাহে না। সেই কারণেই এই প্রশ্ন করিয়াছে। ভাড়া দিলে তাহারাই থাকিয়া যাইতে পারিবে। অন্যথায় তাহাদের অন্যত্র বাসা দেখিতে হইবে। এই বাসা বদলানোর ঝক্কিঝামেলা পোহাইতে চাহিতেছে না রুবাবার পরিবার। যেই কারণে প্রচণ্ড গরমে প্রায় সিদ্ধ হইবার দশা, তবু বাসাটি ছাড়িতেছে না।
আশ্বস্ত করিলাম যে, ভাড়া দেওয়া হইবে। যাহাতে রুবাবা নিশ্চিত হইতে পারে যে, শীঘ্র তাহাদের এই বাসা পরিত্যাগ করিতে হইবে না।
কথার ফাঁক গলিয়া আমি কয়েকবার রুবাবার পানে তাকাইলাম। লক্ষ্য করিলাম রুবাবাও আমার দিকে তাকাইয়া আছে। সামনে তার জ্যেষ্ঠা ভগ্নি। তাহাদের দেখিয়া আমার ভিতরে কেমন যেন দুর্বলতা অনুভূত হইতে লাগিল। লক্ষ্য করিলাম শহীদও দুই বোনকে ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিতেছে। কী দেখিতেছে তাহা না বুঝিলেও আমি ভাবিলাম কাজ একটা হইবে। রুবাবাকে আমার মনে ধরিয়াছে। চোখ জোড়ার দিকে কোনো যুবক তাকাইলে মনে হইবে যেন সমুদ্রের অতলে সে তলাইয়া যাইতেছে। উলালার মতন অতখানি ফর্সা না হইলেও উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রুবাবাকে যেকোনো ছেলেই প্রথম দর্শনেই পছন্দ করিবে।
মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ জানাইলাম। ফ্ল্যাট বিক্রির দালালি না হউক, ঘটকালির ফি’টা নিশ্চিত করিতে পারিব। এই মেয়ের জন্য ভাল পুরস্কার পাইব। তত্ক্ষণাত্ আমার ড্রয়ারে থাকা কয়েকটি বায়োডাটার কথা খেয়াল হইল। বলিয়া রাখি, পেশাদার না হইলেও বাড়তি রুজির জন্য মাঝেমধ্যে ঘটকালির কাজটি করিয়া থাকি। অফিসের লোকেরাও জানে। যদিও এক সহকর্মী বসের কাছে নালিশ করিয়াছিল। আমি নাকি কাজকাম রাখিয়া সারক্ষণ ঘটকালি লইয়া ব্যস্ত থাকি। বস্ আমাকে ডাকিলেন। বলিলাম, ‘স্যার এই সওয়াবের কাজটি করিতে বাধা দিবেন না। গরিব মানুষ, বিনিময়ে কিছু সম্মানি পাই।’
বস্ আর কথা বাড়ায় নাই। নালিশটি বরং শাপেবর হইল। পুরো অফিস জানিল এবং পরের দিন হইতেই ছেলেমেয়েদের বায়োডাটা জমা হইতে লাগিল।
ধান্ধার কথা মনে পড়িতেই আমি তাহাদের পিতার সহিত আরও কিছুক্ষণ কথা বলিতে চাহিলাম। শহীদ বলিল, ‘এইবার ওঠা যাক।’ দেরি না করিয়া আমি সোফা হইতে উঠিয়া পড়িলাম। পিছন পিছন বয়স্ক লোকটি অর্থাত্ উলালা ও রুবাবার পিতাও উঠিলেন। তিনি নিচের দিকেই নামিবেন বলিয়া মনে হইল এবং তাহাই করিলেন। তাহার কন্যা দুইটি দরজা পর্যন্ত আমাদের আগাইয়া দিতে আসিলেন। লক্ষ্য করিলাম এইবার আর দরজা বন্ধ না করিয়াই উহারা আমাদের সিঁড়ি ভাঙা দেখিতেছে।
নীচে আসিয়া আমি লোকটিকে বলিলাম, আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন।
—ছেলে নাই। চারটে মেয়ে।
—বিবাহ দিয়াছেন?
—বড় মেয়েটার বিবাহ হইয়াছে। কিন্তু টিকে নাই। ভুল করিয়াছিল। আচ্ছা বলেন তো, টাকাপয়সাই কী সব! জাতপাতের বিষয় আছে না?’
জাতের প্রসঙ্গ তুলিয়াই তিনি নিজের পরিবারের ফিরিস্তি দিলেন। কয়েক মিনিট দাঁড়াইয়া সেই ফিরিস্তি শুনিয়া বুঝিলাম, আগের দিনের বনেদি পরিবারের লোক। কালক্রমে ঐতিহ্য হারাইয়াছে। যদিও আমি ইহা মানি না। বাঙালির ইতিহাস যাহারা জানেন, যবনদের ইতিহাস যাহারা জানেন, তাহারা বাঙালিয়ানায় পরিবারিক আভিজাত্য বলিতে কিছু মানিবেন না। বরং ইহা বলা যাইবে যে, যাহারা যত আগে লেখাপড়ার সনদ নিয়াছেন, ব্রিটিশদের কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের দালালি করিয়াছেন, গরিব গৃহস্তের ঘর হইতে ধমকাইয়া বেশি খাজনা তুলিয়াছেন, তাহারাই বিভিন্ন পদবি পাইয়াছেন।
তাহার সহিত কথা লম্বা হইতে দেখিয়া শহীদ বারবার তাগাদা দিতে লাগিল। বলিল, ‘দীপু রাত অনেক হইয়াছে। শুক্র-শনিবারে না হয় আবার আসিব।’
তিনি বলিলেন, ‘খুউব ভাল হয়। যদি আসেন।’ এই বলিয়াই তিনি আবার তাহার নানার বাড়ির গল্প শুরু করিলেন। শুনিতে শুনিতে আমি দেখিলাম কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিও তাহার আত্মীয় বটে। জানাইলাম যে, এই ধরনের দুই-একজনকে আমিও চিনি-জানি।
—তাহা হইলে আপনি বুঝিবেন আমরা কেমন পরিবারের লোক। যেনতেন ঘরে তো মেয়ে দিতে পারি না। কষ্ট করে সব মেয়েকেই মাস্টার্স পড়াইয়াছি।
—তাহা, ঠিকই। তবে ছেলেটা ভাল হওয়া চাই। এমন ছেলে পাইলে মেয়ের বিবাহ দিবেন?
এই কথা শুনিবার পর তিনি খপ করিয়া আমার হাত ধরিলেন। বলিলেন, মা-মরা মেয়েগুলি লইয়া আমি বিপদে আছি। আশপাশের লোকেরা নানান কথা বলে। যদি পারেন বড়ই উপকার হইবে।
শহীদ বাইক চালু করিয়া তাড়া দিতে লাগিল। আমি বলিলাম, ‘অবশ্যই পারিব।’
—তাহা হইলে কবে আসিবেন। ঘরে বসিয়া কথা বলিব।
—আসিব, সামনের শুক্রবারেই আসিব। আমার ভিজিটিং কার্ডটা হাতে দিয়া তাহার মোবাইল নম্বরটা নিলাম। আবারও বলিলাম, ‘আসিব, সামনের শুক্রবারেই আসিব।’