কবির জন্ম হয়—সহস্র বর্ষের প্রকাশের বেদনা যখন জাতির মধ্যে অব্যক্ত ভাষায় গোঙায়, তখন একজন কবির জন্ম হয়। কোনো একজন সামান্য নারীর উদর ফেঁপে ওঠে—তারই জাতির ভাষার একজন স্রষ্টাকে জন্ম দিতে। এরই তো নাম কবি।
আর আমরা কবিরা কাব্য সৃষ্টি করি—আমাদের নিজস্ব মাতৃভাষা থেকে। আমি মনে করি, বেদনায় জন্ম নেয়া একজন কবির কাজ—তার জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। এ স্বপ্নকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না। খালি চোখে দেখা যায় না। আবার তা ফেলে দেওয়াও যায় না। আর এ স্বপ্ন জাতির জন্য তৈরি করেন একজন কবি। কবি অবহেলায়, অবজ্ঞায় থাকতে পারে না। কবিসত্তা কোনো কালে, কারো কাছে মাথা নতও করে না। তারা কালে কালে বিভিন্ন ধরনের কষ্ট করেছেন, জেল খেটেছেন, অবশেষে ফাঁসিতে ঝুলেছেন, তবু মূল জায়গা থেকে সরে যাননি। কিন্তু তাদের রচিত রচনাগুলোতে মিল আছে। আছে অন্ত্যমিল। এই যে, অন্ত্যমিলটা এটি প্রত্যেক জাতির কবিরা অন্তরের অন্তঃস্থলে নীরবে প্রস্তুত করে চলেন।
এই সময়ে আমি আর কোনো গ্রন্থের সমালোচনা করি না। কারণ, আমি নিজেও একজন গদ্য লেখক। আমি মনে করি, আমার হাতে দুটি তরবারি আছে। একটি কাব্যের, অন্যটি গদ্যের। আমার মতে, মানুষের ভাষা যে সব দেশে বিবর্তিত হয়েছে, তা হয়েছে গদ্যের কারণে। গদ্য কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। গদ্যে মিল না থাকতে পারে, কিন্তু ছন্দ একটা আছে, তরঙ্গ আছে। কখনো মনে হয় গদ্য স্বপ্নের মতো। কিছু কথা আছে আমি দেখতে পাচ্ছি, অন্য কেউ দেখতে পারছে না, আবার কেউ কিছু ধরতে পারছে না। ফলে আমার ভেতর কম্পন সৃষ্টি হয়, শব্দ হয়। এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি হয়। এ উদ্দীপনা প্রকাশ পায় কবির কবিতায়।
যারা মানুষের ভাষা নিয়ে কাজ করে আমরা তাদের কবি বলি। কবিরা শব্দে শব্দে কুতুব মিনার বানিয়ে দেয়। শ্বেতপাথরে ইমারত সৃষ্টি করে। নির্মাণ করে ভিন্ন পৃথিবী। দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণ শিখা থেকে কবিতার জন্ম। আর কবিতা মানুষের কোনো উপকার না করলেও কখনো ক্ষতি করে না।
আরব সাহিত্যের বর্বরতার যুগে ইমরুল কায়েস নামে এক লোভী কবি ছিল। তার একটি কবিতা ছিল। কবিতাটির নাম মনে পড়ছে না। কবিতার ম্যাসেজ এ রকম যে—একদা আরব দেশে তাঁবুতে বসে একজন পেঁয়াজ কাটতে ছিল, তাতে খুব ঝাঁজ বের হচ্ছিল চতুর্দিকে। একটা অজানা, অপরিচিত ভাষা ছিল তা সকলের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছে পেঁয়াজের গন্ধ ছড়ানোর মতো। আর এটা কবিদের দ্বারাই সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়া। কবিতার দ্বারাই সম্ভব—জাতিকে স্বপ্ন দেখানো।
মানুষের ভালোবাসা, একজন কবির জন্য বড় অর্জন। মানুষের ভালোবাসা আমাকে এগিয়ে যেতে প্রাণিত করেছে। আমি অনেক ঘুরেছি, অনেক দেখিছি। খোঁজ করেছি কবিতার। যৌবনকালে পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি। দেখেছি বহুপথ। জানবার জন্যে, বুঝবার জন্যে। সাহিত্য হলো চর্চার বিষয়। ব্যাপক পড়াশোনা করার বিষয়। ক্লান্তি যেন পথ নিঃশেষ করে না দেয়। দুটো কাজ একজন লেখকের কর্তব্য, এক. অধ্যয়ন, প্রচুর পরিমাণে পাঠ করতে হবে। দুই. ভ্রমণ। ভ্রমণ লেখকের জীবনে খুব দরকার। অনেক কিছু দেখা যায়। শেখা যায়। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই বিষয়ে উত্সাহিতও করেছেন মানবজাতিকে। আর আমি আমার জীবনে এ দুটো কাজ প্রচুর করেছি। প্রচুর পড়েছি আর সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছি। এ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শহরগুলোতে ফুটপাত ধরে আমি অনেক হেঁটেছি। একবার প্যারিস গিয়েছিলাম। সাদা তুষার, বরফগলা বৃর্িষ্টতে রাস্তা দেখা যাচ্ছিল না। ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি রাস্তার মধ্যে হেঁটে চলা এক তরুণীকে পথ দেখিয়ে দিতে বলেছিলাম। আমি বিদেশি মানুষ; ইশারা করেছিলাম হাত দিয়ে পথের সন্ধানে। সে আমার হাতটি সরিয়ে বলল—আমি জানি না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। তখনি আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি—পথের সন্ধানে কখনো কোনো নারীর সহযোগিতা চাইব না।
আমাদের কবিদের ঘুরতে হবে, দেখতে হবে, বুঝতে হবে। তারপর কবিতা লিখবেন, কবিতা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আমি মনে করি, বাস্তবতা এবং স্বপ্ন—এ দুইয়ের মিশেলে নির্মিত হয় শিল্প-সাহিত্য। এটাই তো শিল্প-সাহিত্যের নিয়ম। তবে হ্যাঁ, আমাদের বাংলা কবিতা নিজের জায়গা খুব সুন্দরভাবে অর্জন করে নিয়েছে। অনেক উঁচুতে আসন নিয়েছে। গিয়েছে অনেক দূর। আরো যাবে ইনশাআল্লাহ্।
আরেকটা বিষয়—নতুন যারা সাহিত্যে আসতে চায়, কবিতা লিখতে চায় তাদের অভিনন্দন। এবং তাদের বলব—আপনারা যখন কবিতা লিখবেন; কমিটমেন্ট ঠিক রাখবেন। অর্থাত্ পাঠকের পক্ষ থেকে নিজেকে প্রশ্ন করবেন কী লিখছেন, কার জন্য লিখছেন, কেন লিখছেন? উত্তর যখন পেয়ে যাবেন—তখনই একটি ভালো কবিতা হয়ে উঠবে। সত্যিকার কবিতা হিসেবে পরিচয় পাবে। পাঠককে আকৃষ্ট করবে পড়তে। ছড়িয়ে যাবে বিশ্বে। অনুবাদ অনুবাদ বলে হাহাকার করতে হবে না। কবিতাই তার জায়গা করে নিবে আপন ঘরে। সময়ের প্রয়োজনে প্রতিটি ভালো কবিতাই অনূদিত হবে। চলে যাবে দেশ থেকে দেশান্তরে। তার জন্য (কবিতা অনুবাদের) কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। কবিতা না লিখে প্রতিষ্ঠান দিয়ে কী হবে? অনুবাদের জন্য করতে হবে না কোনো দলাদলি, অথবা কোনো চেষ্টা-তদবির। কালো হোক, সাদা হোক যেকোনো বর্ণের মানুষ কবিতা লিখুক, টিকে যাওয়ার মতো কবিতা লিখলে, তা অনুবাদ হবেই অর্থাত্ মূল্যায়ন হবে।
খ
কবিতার কাজ হলো মানুষের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলা। সেটা কেবল এক জাতীয় মানুষের মধ্যে নয়, পৃথিবীর সকল নর-নারীর মধ্যে। কবিতা যেমন স্বপ্ন সৃর্িষ্ট করে, তেমনি কবি হয়ে উঠেন কালের সাক্ষী। সে ক্ষেত্রে কবি ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনাও দিয়ে থাকেন।
কবিতা হলো—মানুষের উপকারী বাক্যের বন্ধন। একের সাথে অপরের যোগসূত্র তৈরি করে; দেশের সাথে দেশের, জাতির সাথে জাতির। কবি ভবিষ্যত্ বক্তা নন, তবু কবিতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে—একজন কবির দূরদৃষ্টি। অসাধারণ অলৌকিক শক্তি থাকে। আর এ জন্যই ঐতিহাসিকগণ কখনো কখনো কথা বলার সময় কোনো কবির লাইন আবৃত্তি করে বলেন—অমুক কবি এই লাইনটি লিখেছিলেন।
কী আশ্চর্য! কবি সত্য কথা বলেন না বটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ কবিকে মিথ্যাবাদী বলেনি। মানুষের ভাবনার জগত্ কখনো কখনো কবিরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। অথচ কবি দর্শনের ধার ধারেন না। তিনি একা চলেন, একা বলেন। এবং নিঃশব্দে, নির্জনে তার জীবনের অবসান ঘটে। আর সব জাতি তাদের নিজেদের মধ্যে একজন কবির আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এবং যখন একজন কবি জাতির মধ্যে জন্ম নেয়, তখন সমস্ত জাতি ঐক্যতানে বলে ওঠে—‘এই তো আমাদের কবি, এই তো আমাদের সৌভাগ্যের ধ্রুবতারা’। তার হাতের বীণায় বাজতে থাকে আনেন্দের ধ্বনিতরঙ্গ। তিনি সুখ-শান্তির জন্য দু’হাত তুলে দোয়া করেন মহান রবের নিকট।
কবিরা স্বপ্নে, বাস্তবতায় একই সাথে লুটোপুটি খান। কবিরা শুধু নিজের দেশের বিবরণই লিপিবদ্ধ করেন না, তার আশপাশের দেশগুলো সম্বন্ধেও কবির চেতনা এবং বিবেচনা তার মনে বিরাজ করে। যখনই কবি কোনোকিছু লিখতে যান তখন তার দেশের সীমানা প্রয়োজনবোধে তার জ্ঞানের সাহায্যে অতিক্রম করে একটি সুন্দর ও সর্বজনগ্রাহ্য বিষয় তুলে ধরেন। দেখা যায়, কবি কালিদাস তার ‘মেঘদূত’ রচনার সময় মেঘ যেসব দেশের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে চলছেন। এখানে নর-নারী ছাড়াও সব প্রাণী ও প্রকৃতির বিবরণে তিনি একজন দ্রষ্টা।
কবি অমরতার পঙিক্ত সৃষ্টি করেন, তার দৃষ্টি কুয়াশাচ্ছন্ন হলেও বহুদূরের বিষয়বস্তু তার দৃষ্টির মধ্যে, চোখের তারকার মাঝে ধরা দিয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে। তিনি ধন-সম্পদ তুচ্ছ করে অমরতার বাণী বিশ্বের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। তিনি স্বপ্নের নির্মাতা, তিনি দ্রষ্টা একই সাথে তিনি স্রষ্টা। তিনি সৃজন করেন, সৃজনের কম্পনে জগেক কাঁপিয়ে দেন। তিনি যা বলেন তা তার কালে সত্য হয়ে না উঠলেও কেউ কোনোদিন কবিকে মিথ্যাবাদী বলতে সাহসী হন না। এই চেতনায় কবি লিখে যান কবিতা। সাজান আপন সংসার।
গ
কবিতার ঘরসংসারে এভাবে কাটছে আমার সময় ও সামান্য কবিকৃতি। বারুদ ও গন্ধকের নদী সাঁতরে আমরা কয়েকজন লেখক উঠে দাঁড়িয়েছি। এ দাঁড়ানো সার্থকতার কোনো উপকূল কি-না জানি না, তবে আমাদের জন্য বিশ্রামের। কবিমাত্রই একটা সামাজিক আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। আর আমরা তা আমাদের নিজেদের শক্তিতেই নির্মাণ করেছি। সাহিত্যকে এখনো যারা জীবনের বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ বলে মনে করেন, আমি তাদের দলেই থাকতেই চেয়েছিলাম, এখন তাদের দলেই আছি। এখনো এই সময়ে পরোয়া করি না কে আমাকে কী চোখে দেখে। আমি তো আমার দেশবাসীকে ভালোবেসেই সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছি। আর একটা কথা—আমি সারাজীবন কবিতা লিখে, গল্প-উপন্যাস লিখে কাটিয়ে দিতে পারব তা কখনো ভাবিনি। কিন্তু আমার পরম সৌভাগ্য এই যে, আমি সারাজীবন লিখেই কাটিয়ে দিয়েছি। স্বপ্ন দেখিয়েছি জাতিকে।