মুসলিম বিশ্বে দুইটি বড়ো উত্সব গভীর উত্সাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে উদ্যাপন করা হয়। এই উত্সবের একটির নাম ঈদুল ফিতর অন্যটির নাম ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর হচ্ছে সিয়াম ভাঙার আনন্দ উত্সব এবং ঈদুল আজহা হচ্ছে কুরবানির আনন্দ উত্সব। এই দুই ঈদেরই গুরুত্ব অপরিসীম, তবে আনন্দ বৈভবের নিরিখে ঈদুল ফিতর সবচেয়ে বড় উত্সব। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ উত্সব আছে, আমাদের আনন্দ উত্সব এই ঈদ। আনন্দ উত্সব যা প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট নিয়মে ফিরে ফিরে আসে এবং যা নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর পালিত হয়।
প্রিয়নবি হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা মুকাররমা হতে মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে এসে এখানে স্থাপন করলেন একটি মসজিদ এবং এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললেন একটি সুখী-সুন্দর সমাজ কাঠামো। তিনি মদিনায় এসে লক্ষ করলেন যে, এখানকার মানুষ প্রতি বছর অতি উত্সাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে দুইটি উত্সব পালন করে যাতে কোনো পবিত্রতার বালাই নেই, নেই কোনো পরিচ্ছন্ন মননের ছোঁয়া। অশ্লীল আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, নিরর্থক আমোদ-ফুর্তির মধ্য দিয়ে প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে এই উত্সব দুটি নির্দিষ্ট সময়ে মদিনার মানুষ পালন করত। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আনাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনাতে এসে দেখলেন যে, তাদের দুইটি উত্সবের দিন রয়েছে। সেই দুইদিন তারা আমোদ-ফুর্তি, খেলাধুলা প্রভৃতি করত। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : এই দুই দিন কিসের জন্য? তারা বলল : এই দুই দিন অন্ধকার যুগে আমরা খেলাধুলা করতাম।
এই কথা শুনে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : আল্লাহ এই দুই দিনের পরিবর্তে অধিকতর উত্তম দুইটি দিন তোমাদের দিয়েছেন আর তা হচ্ছে ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।
জানা যায়, ইসলাম পূর্ব যুগে যে দুইটি আনন্দ উত্সব পালিত হতো তার একটির নাম ছিল নওরোজ ও অন্যটির নাম ছিল মেহেরজান। তদানীন্তন পারস্যে এই দুইটি উত্সবের ব্যাপক প্রভাব ছিল বলে জানা যায়। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে আসার প্রায় ১৭ মাস পরে আল্লাহ জাল্লা শানুহু মুসলমানদের জন্য সিয়াম বা রোজার বিধান দিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন :রমাদান মাস, যাতে নাজিল হয়েছে মানুষের জন্য দিশারী সত্য পথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের মধ্যে পার্থক্যকারী আল কুরআন। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস প্রত্যক্ষ করবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ শা’বান রমাদান মাসে সিয়াম পালন করবার বিধান নাজিল হয়। এরই ১৪/১৫ দিন পর মাহে রমাদানুল মুবারকের আগমন হলে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত উত্সাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে রমাদানের সিয়াম পালন করেন। সেই বছর রমাদানের চাঁদ মদিনা মনওয়ারায় এক অনন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার বাস্তব অনুশীলন অনুভবে সমুজ্জল হয়ে উদিত হয়েছিল যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দীর্ঘপথ পেরিয়ে এসে আজও বিশাল দুনিয়ায় সমান ভাবে রয়েছে। এর পূর্বেও সিয়াম পালনের রেওয়াজ মদিনায় ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল। তারা মুক্তির দিবস হিসেবে ১০ মহররম আশুরার সিয়াম পালন করত।
মদিনায় হিজরত করে এসে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আশুরার সিয়াম পালন করেছেন এবং তাঁর নির্দেশে সহাবায়ে কেরামও আশুরার এই সিয়াম পালন করেছেন। কিন্তু রমাদানের সিয়াম পালন করবার বিধান নাজিল হলে আশুরার সিয়াম ঐচ্ছিক সিয়ামে পরিণত হয় আর রমাদানের সিয়াম বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। যে বছর প্রথম রমাদানের সিয়াম পালিত হয় সেই বছরের সেই রমাদানেই সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ গাযওয়ায়ে বদর। সেই রমাদান শেষেই সর্বপ্রথম মুসলমানদের নিজস্ব আনন্দ উত্সব ঈদুল ফিতর পালিত হয় মদিনা মনওয়ারায়। সিয়াম পালনের সেই প্রথম রমাদান মাসটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রবাহে সমৃদ্ধ। সেই রমাদান মাসের শেষ দিন প্রিয়নবি হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নতুন এক আনন্দ উত্সবের ঘোষণা দিলেন। সেটাই ছিল ঈদুল ফিতরের ঘোষণা। ঈদুল ফিতরের অর্থ সিয়াম ভাঙার আনন্দ উত্সব।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১ শওয়াল প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইমামতিতে প্রথম ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত ওয়াজিব নামাজ ছয় তকবিরের সাথে আদায় করেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তারপর থেকে প্রতি বছর রমাদান শেষে ঈদুল ফিতর পালিত হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ রমাদান বদর যুদ্ধের বিজয়ের ১৩/১৪ দিন পর মদিনায় সর্বপ্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হয়েছিল আর ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২১ রমাদান মক্কা বিজয়ের ৮/৯ দিন পর মক্কা মুকাররমায় সর্বপ্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হয়েছিল। ঈদুল ফিতরের সঙ্গে বিজয়ের যেন এক মহা যোগসূত্র রয়েছে। রমাদান মাসের এক মাস ধরে দিবাভাগে সবটুকু সময়ে সুবহ্সাদিকের পূর্ব মুহূর্ত হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকারের পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে নিজেকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বিরত রেখে সায়িম বা রোজাদার নফসের সঙ্গে রীতিমতো যে কঠিন যুদ্ধ চালিয়ে যায় তারই বিজয় অনুভব ভাস্বর হয়ে ওঠে ১ শওয়াল ঈদুল ফিতরের দিনে। একটি হাদিসে আছে যে, সশস্ত্র যুদ্ধ হচ্ছে ছোট যুদ্ধ আর নফসের সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে বড় যুদ্ধ।
যে মানুষ নফসকে দমন করতে পারে, ষড়রিপু অর্থাত্ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাত্সর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই কেবল প্রকৃত মানবতা গুণে গুণান্বিত হতে পারে। রমাদান মাসে সিয়াম পালনের মাধ্যমে সেই বিরাট সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়। যে কারণে রমাদানের সিয়াম পালন করার পর ঈদুল ফিতরের আগমন এক বিশেষ অনন্যতা লাভ করেছে। হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, লোভ নয়, অহমিকা নয়, কাম নয়, ক্রোধ নয়, সংযমী জীবন, সংযম ও সহিষ্ণু জীবনই প্রকৃত মনুষ্য জীবন। তাই সব মানুষ মিলে এক মহামিলনের বিশ্ব গড়ার অনুভব অনুরণিত হয় ঈদুল ফিতরে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন : হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। (সুরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)। ঈদুল ফিতরে এই চেতনার বাস্তব স্ফুরণ ঘটে।
ঈদুল ফিতরকে দানের আনন্দ উত্সবও বলা হয়। ঈদুল ফিতরের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হচ্ছে দরিদ্রদেরকে সাহায্য করা। বিত্তবানদের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে বিত্তহীনদের মধ্যে ফিতরা বিতরণ করা। কী পরিমাণ ধন-সম্পদের অধিকারী হলে ফিতরা দিতে হবে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
ঈদের দিন সকালেই ঈদের নামাজ আদায় করতে যাবার পূর্বেই ফিতরা প্রদান করা উত্তম। প্রিয়নবি (সা.) বলেছেন : ফিতরা সিয়ামকে কুকথা ও বাহুল্য বাক্য হতে পবিত্র করে এবং গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের আহার্য জোগায়। তিনি আরো বলেছেন : ফিতরা যারা দেয় তোমাদের সেই সব ধনীকে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র করবেন এবং তোমাদের মধ্যে যারা দরিদ্রদেরকে দান করে আল্লাহ তাদেরকে তার চেয়ে অনেক বেশি দান করবেন।
ঈদ পরিচ্ছন্ন আনন্দের দিন। আল্লাহর মহান দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করার দিন। এই দিনে যাতে গরিব-দুঃখীরা ধনীদের সঙ্গে আনন্দের সমান ভাগীদার হতে পারে সেজন্য গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার দিন। যাকাত পাবার অধিকারী যারা, ফিতরা পাবার অধিকারী তারাই। ইসলাম ধনীদের ধন-সম্পদে দরিদ্রদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে দিয়েছে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে ন্যায্য অধিকার রয়েছে ভিক্ষুকের এবং বঞ্চিতের। (সুরা যারিয়াত : আয়াত ১৯)।
রমাদানের একমাস সিয়াম পালনের মাধ্যমে সায়িম ধৈর্য, দয়া, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সংযম এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের যে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে সেই প্রশিক্ষণকে জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের দৃঢ় শপথে বলীয়ান হবার আনন্দ উত্সব হচ্ছে ঈদুল ফিতর। এই দিন আনন্দ করবার এবং আনন্দ বিলাবার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত। এই দিন পারস্পরিক প্রাচুর্য কামনার লক্ষ্যে প্রত্যেকের মুখে প্রাণের গভীর থেকে ঈদ মুবারক উচ্চারিত হয় বার বার।
ঈদ সব মানুষকে একই উঠোনে এনে দাঁড় করায় এবং সকলকে বুকে বুকে মিলিয়ে, গলায় গলা মিলিয়ে এক আনন্দ সৌকর্য বিমণ্ডিত হূদয় দেয়া নেয়ার অনন্য অনুভব জাগিয়ে তোলে। ঈদ কেবল পার্থিব আনন্দ উত্সব নয়, এ কেবল পার্থিব আমোদ নয়, ঈদ ইবাদতেরও অন্তর্গত। ঈদ মানুষকে আত্মিক উত্কর্ষ ও পরিতৃপ্তির পথ নির্দেশনা দেয় এবং আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের সুপ্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করে। যুগ শ্রেষ্ঠ সুফি অলিয়ে মাদারজাদ হজরত মওলানা শাহ সুফি তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন : প্রকৃত রোজাদারের জন্য ঈদ পৃথিবীতে জান্নাতি সুখের নমুনা।
ঈদ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার তাকিদে সমুজ্জ্বল! সমগ্র পৃথিবীর মানুষ একটি জাতি—কুরআন মজিদে উল্লেখিত এই অনন্য চেতনার অনুরণন ও স্পন্দন ঈদুল ফিতরে ভাস্বর হয়ে ওঠে। মানুষে মানুষে ঐক্যও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক সংযমী জীবনের চেতনায় ঈদুল ফিতরের চেতনা এবং এখানেই নিহিত রয়েছে সিয়াম ভাঙার এই উত্সবের প্রকৃত আনন্দ বৈভব।