সরকারিভাবে হূদরোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিত্সা সেবার একমাত্র প্রতিষ্ঠান জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট। অথচ হূদরোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালের পাঁচটি ক্যাথ ল্যাবের মধ্যে তিনটিই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এগুলো ব্যবহূত হয়েছে। সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এগুলোর আর সেবা দেয়ার মত অবস্থা নেই।
প্রতিদিন প্রতিটি ক্যাথ ল্যাবে ১০ থেকে ১৫টি এনজিওগ্রাম পরীক্ষার পাশাপাশি এনজিওপ্লাস্টি করা হয়ে থাকে। সারাদেশ থেকে প্রতিদিন অনেক রোগী আসায় এই দুটি ক্যাথ ল্যাব দিয়ে সব রোগীকে সামাল দেয়া যায় না। রোগীদের এনজিওগ্রাম পরীক্ষা শেষেই বাইপাস সার্জারি, পেস-মেকার স্থাপন, ওপেন হার্ট সার্জারি, বেলুনিংসহ সব ধরনের সার্জারি হয়।
অথচ যেসব হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকসহ জনবল নেই কিংবা ক্যাথ ল্যাব বসানোর ব্যবস্থাও নেই সেসব হাসপাতালে কোটি কোটি টাকার ক্যাথ ল্যাবের যন্ত্রপাতি পড়ে আছে বাক্সবন্দী। বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি ও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুটি ক্যাথ ল্যাবের যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়েছে অনেক আগে। অথচ এগুলো কোন কাজে আসেনি।
জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন স্রোতের মতো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংকটাপন্ন হূদরোগীরা চিকিত্সার জন্য আসছে। তাদের অধিকাংশেরই এনজিওগ্রাম পরীক্ষার প্রয়োজন। আগত রোগীদের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ ভাগই দরিদ্র। প্রাইভেট হাসপাতালে তাদের পক্ষে ব্যয়বহুল পরীক্ষা ও চিকিত্সা করানো সম্ভব নয়। তিনটি ক্যাথ ল্যাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সঙ্কটাপন্ন হূদরোগীদের বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এনজিওগ্রাম পরীক্ষার অভাবে সময়মতো চিকিত্সা সেবা না পাওয়ায় বেশিরভাগ রোগী মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানান। অনেকেই মারাও যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, দরিদ্র ও গরিব রোগীদের স্বার্থে জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটে বিছানা ও ক্যাথ ল্যাব বৃদ্ধিসহ সম্প্রসারণ দ্রুত করা হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, সব ধরনের হূদরোগীদের চিকিত্সার চাপ এই ইনস্টিটিউটের উপরে পড়ছে। এখানে দরকারি যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে যেখানে জনবল নেই ও ব্যবস্থা নেই সেখানে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, এক আলোচিত ঠিকাদারের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের আমলে গত ৫ বছরে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার ক্যাথ ল্যাবসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়। এগুলোই ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে। তারা জানে যেখানে জনবল নেই সেখানে নিম্নমানের এই যন্ত্রপাতি পাঠানো হলে সেগুলোর বাক্স খোলারও প্রয়োজন পড়বে না। এসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে স্বাস্থ্য খাতের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেট ওই আলোচিত ঠিকাদারের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত্ করেছে। বর্তমানে ওই ঠিকাদার মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরের সিন্ডিকেটের সঙ্গেই পূর্বের ন্যায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে জাতীয় হূদরোগ ইন্সটিটিউটের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি, বিছানাপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রীর অভাবে চিকিত্সা সেবা নিতে গিয়ে রোগীরা অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক, নার্স ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও হিমশিম খাচ্ছেন। রোগীরা সময়মতো চিকিত্সা না পাওয়ায় বিনা চিকিত্সায় মারা যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের ও অধিদপ্তরের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন।
জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের বেডসংখ্যা ৪১৪। প্রতিদিন রোগী থাকে ৭৫০ থেকে ৮০০। সঙ্কটাপন্ন ও জটিল হূদরোগীদের মেঝেতে, ওয়ার্ডের বারান্দায় গাদাগাদি করে বিছানা দিয়ে কর্তৃপক্ষ চিকিত্সা সেবা দিচ্ছেন। এসব রোগীর বিছানা সঙ্কট দেখিয়ে ভর্তি না করালে রাস্তায় তাদের মৃত্যু অনিবার্য। এ কারণে এসব হূদরোগীর জীবন রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে ভর্তি করতে বাধ্য হন বলে এক কর্মকর্তা জানান।
এখানে শিশুদের জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নেই। তাদের এনজিওগ্রাম পরীক্ষার জন্য আলাদা কোনো ক্যাথল্যাব নেই। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক হার্ট ছিদ্রসহ নানা জটিলতা নিয়ে শিশু হূদরোগী চিকিত্সার জন্য আসছে। এসব শিশুরও বিছানার অভাবে গাদাগাদি করেই চিকিত্সা সেবা নিতে হয়।
হূদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল শাফী মজুমদার বলেন, বেড সংখ্যা ও ক্যাথল্যাব বৃদ্ধিসহ ইনস্টিটিউট ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের প্রস্তাব বহু আগেই মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এ প্রস্তাবের কোনো সাড়া মেলেনি। কয়েকজন চিকিত্সক বলেন, মন্ত্রণালয়ের ও অধিদপ্তরের অধিকাংশ শীর্ষ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হূদরোগের সমস্যা হলে তারা এ ইনস্টিটিউটে আসেন না। তারা চলে যান বিদেশে। এ কারণে এ ইনস্টিটিউটের চিকিত্সা সেবার উন্নয়নের জন্য তারা মাথাও ঘামান না। তারা শুধু নিয়োগ, বদলি ও কেনাকাটার ফাইল নিয়েই ব্যস্ত।
উল্লেখ্য, এই ইনস্টিটিউটের বাইরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটসহ হূদরোগীদের মোটামুটি চিকিত্সা সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিডফোর্ড হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ পুরাতন কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে সীমিত আকারে হূদরোগীদের চিকিত্সা সেবার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।