আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবেন। তখন গাড়িতে করে ছুটছেন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। এই প্রচণ্ড গতির মধ্যেই হাসতে হাসতে সাক্ষাত্কার দিলেন বাংলাদেশের তরুণ পেসার তাসকিন আহমেদ।
সবে মাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছেন। এখনও দু' চোখ ভরা স্বপ্ন আর বিশাল একটা লক্ষ্য। পেসারদের স্বপ্নভূমি ওয়েস্ট ইন্ডিজে রওনা দেয়ার আগে নিজের স্বপ্ন, নিজের আদর্শ আর বিশ্ব কাঁপানোর লক্ষ্য নিয়ে কথা বললেন এই তরুণ সেনসেশন।
তাসকিনের স্বপ্নীল সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়—
তাসকিন বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিয়েছেন?
হ্যাঁ, গাড়িতে আছি। বিমানবন্দরের পথে।
কেমন লাগছে? জাতীয় দলের সঙ্গে প্রথম সফর....
হ্যাঁ, আমার জীবনের প্রথম সফর এটা বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাথে। এটা আমার জন্য অনেক অনেক বড় একটা ব্যাপার। এক সময় এটা ছিল আমার স্বপ্ন। এর আগে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া গেছি। এতো দিন ওটারই গল্প করতাম। আর এবার তো জীবনের একটা বড় ঘটনা। জাতীয় দলের হয়ে যাচ্ছি, তাও আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে গেছেন এর আগে?
না, ওয়েস্ট ইন্ডিজ কখনোই যাইনি। আমরা যারা পেস বোলার, আমাদের জন্য এটা তো ধরেন স্বপ্নের জায়গা। ঠিক আমরা যেসব দ্বীপে যাবো, ওখানে না হলেও এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই তো গ্রেট সব ফাস্ট বোলার জন্মেছেন—গার্নার, মার্শাল, হোল্ডিং, তারপর ওয়ালস। আমরা ওনাদের খেলা ভিডিওতে দেখেছি। খুব ইচ্ছা আছে, কাউকে যদি একটু দেখতে পারি।
কী করবেন, যদি এইসব কিংবদন্তির কারো সাথে দেখা হয়ে যায়?
একটু কথা বলার সুযোগ পেলে, টিপস নিতে পারলে তো জীবন ধন্য হয়ে যাবে। শুধু দেখতে পারলেও আমি খুশী।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেটে বল করাটা একসময় পেসারদের স্বপ্ন ছিল।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনেকে অবশ্য বলে পেস বোলিং ট্র্যাক। কিন্তু দলের সিনিয়ররা বলে, টিভিতে দেখি এখন আর আগের মতো ফাস্ট-বাউন্সি উইকেট নেই। আমাকে ভালো জায়গায় বল করতে হবে, ভালো বল করতে হবে। আমার ইচ্ছা আছে, নিজের সেরা বল করার। যেমন বল এর আগে কখনো করিনি।
জাতীয় দলের সঙ্গে প্রথম সফরের আগেই তারকা হয়ে গেছেন মনে হয়। এটা কী চাপ হয়ে উঠছে?
হা হা...। না, না। আমি নিজে মনে করি, আমি তারকার 'ত'-ও না। আমার নিজের স্বপ্ন অনেক বড়। একটা-দুটো ম্যাচ খেলে কী আর তারকা হওয়া যায়! হ্যাঁ, হয়তো প্রথম ম্যাচটা ভালো বল করায় একটু প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি সেটা চিন্তা করে কোনো চাপ নিতে চাই না।
একটু বলেন তো তাসকিন, ফাস্ট বোলার কেন হলেন?
আসলে ছোট বেলায় তো ব্যাটিং পেতাম না। বড় ভাইয়েরা ব্যাটিং করতো, আমি শুধু বল করতাম। অনেক বলতাম, একটু ব্যাটিং করতে দেন। এর মধ্যে আমি জোরে বল করি, লম্বা ছিলাম। তখন একটা বন্ধু বললো, ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে একটা অ্যাকাডেমিতে অনূর্ধ্ব-১২ কিছু খেলোয়াড় নেবে। প্রথমে যাইতে চাইলাম না। কারণ, কিছুদিন আগেই পরীক্ষায় খারাপ করেছি বলে বাবা বকা দিয়েছেন।
বাবা তাহলে ক্রিকেট খেলার জন্য বকা দিতেন?
হ্যাঁ, দিতেন। তারপরও বাবাকে কনভিন্স করে আবাহনী মাঠে চলে গেলাম। ওখানে সাজু স্যারের ডিসকভারি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। উনি বোলিং দেখে বললেন, তুমি ফাস্ট বোলার হতে পারবা।
পূর্ণকালীন ক্রিকেটার হয়ে উঠলেন ঠিক কোন্ সময় এসে?
ওখানেই আসলে খেলতে খেলতে একসময় জীবনের সবকিছু ক্রিকেটই হয়ে গেল। পড়াশোনা, কোচিং; সবকিছুর চেয়ে ক্রিকেটের গুরুত্ব যেন বেশি। পড়াশোনা তো এখনও করি। ইংরেজীতে অনার্স করছি। কিন্তু জীবনের স্বপ্ন তখন একটাই—জাতীয় দলের জার্সি পরতে হবে। কেমন করে পরবো, কী ভাবে সুযোগ পাবো, জানি না। জানি শুধু জাতীয় দলে খেলতে হবে।
আপনার আইডল ছিলেন কেউ?
হ্যাঁ, প্রথম আইডল ছিলেন মাশরাফি ভাই। বাইরের মরনে মরকেল বা ডেল স্টেইনকে ভালো লাগে। কিন্তু আইডল বলতে যা বোঝায়, শুধু খেলোয়াড় হিসেবে না, মানুষ হিসেবেই আমার আইডল মাশরাফি ভাই। উনি মাঠে, মাঠের বাইরে যা করেন, আমার ভালো লাগে।
মাশরাফির সঙ্গে প্রথম পরিচয় কোথায়?
বাংলাদেশ বিমানে খেলতে গিয়ে। এর আগে ওনার খেলা তো দেখিই। যখনই দেখতাম, ভালো লাগতো।
এখনও কী মাশরাফির প্রতি ওই ভক্তিটা আছে?
আছে তো। এখনও ওনার পাশে পাশে বসার চেষ্টা করি, উনি যা বলে শুনতে মজা লাগে।
প্রথম জাতীয় দলে এলেন তো সেই মাশরাফির বদল হিসেবেই।
হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। আসলে ওটা যে আমার কেমন একটা অনুভূতি ছিল! আমি ডাক পেয়েছি, আমার খুব খুশী লাগছে। কিন্তু কি যেন একটা নেই। স্বপ্ন ছিল মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গেই জাতীয় দলে খেলবো। কিন্তু উনি না থাকায় খুব খারাপ লাগছিল। প্রথম দিন কী হল, আমি ড্রেসিং রুমে ঢুকলাম। দেখি কয়েকটা সিট ফাঁকা। শুনলাম, এর একটা মাশরাফি ভাইয়ের সিট। আমি কী যেন একটা ভেবে ওনার সিটে বসে পড়লাম। আমি মনে মনে বললাম, 'আল্লাহ, মাশরাফি ভাইয়ের সিটে বসলাম। ওনার নামের মর্যাদা যেন রাখতে পারি।'
পরে তো মাশরাফির সঙ্গেও জাতীয় দলে বল করেছেন?
হ্যাঁ। এই তো ভারতের বিপক্ষে। যেদিন পাঁচ উইকেট পেলাম। আমি আর মাশরাফি ভাই দুই প্রান্ত থেকে বল করছিলাম। উইকেট পাওয়ার পর লাফ দিয়ে ওনার সঙ্গে বুকে বুক মিশিয়ে একটা সেলিব্রেশনও করেছিলাম। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
আপনি সম্প্রতি বলেছেন, ১৫০ কিলোমিটারে বল করতে চান।
না, এটা তো বলে কয়ে করা যাবে না। রাতারাতিও হবে না। একটা সময় হয়তো হবে। সে জন্য আরও শক্তিশালী হতে হবে। তারপরও একটা ছন্দে যেদিন বল করতে পারবো, সেদিন হবে। আমার পেস খারাপ না। এটাকে ওই জায়গায় নিতে হবে। ১৫০ কিলোমিটারই নয়; তার ওপরে বল করতে হবে। আমি আসলে বিশ্বের দ্রুততম বোলার হতে চাই। আমি বোলিং করবো, শুনলে ব্যাটসম্যানরা যেন ভয় পায়। মানে আমি ব্যাটসম্যানদের আতঙ্ক হবো।