এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলে শহর ও গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তর ব্যবধানের চিত্র উঠে এসেছে। গ্রামের শিক্ষার দিকে সরকারের নজর কম, তাও প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকা শহরে যেখানে পাসের হার প্রায় ৮৫ ভাগ। সেখানে যশোর বোর্ডে পাসের ভাগ ৬০ ভাগ। ঢাকার চেয়ে পাসের হারে পিছয়ে ২৫ ভাগ। এছাড়া অন্যান্য বোর্ড বরিশালে ৭১ ভাগ, চট্টগ্রামে ৭০ দশমিক ০৬ ভাগ, কুমিল্লায় ৭০ দশমিক ১৪ ভাগ, দিনাজপুরে ৭৪ দশমিক ১৪ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজর শহরের কলেজগুলোর দিকে। গ্রামের কলেজগুলো কীভাবে চলছে তা দেখভাল করছে না সরকার।
এবার উচ্চ মাধ্যমিকের সবগুলো বিষয় সৃজনশীল পদ্ধতিতে হয়েছে। গতবার চারটি বিষয়ে ৭ পত্রে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়া পর ফল বিপর্যয় হয়েছিল। গত বছর পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এবার পাসের হার বাড়লেও গ্রামের কলেজগুলো পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামের কলেজগুলোর ওপর সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে।
বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে ৬ কিলোমিটার দূরত্বে কালিদাশ বড়াল স্মৃতি মহাবিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে এবার ১৬১ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ৮৭ জন। পাস হার ৫৪ দশমিক ০৩ শতাংশ। যেখানে যশোর বোর্ডে পাসের হার ৬০ শতাংশ। সেখানে এই প্রতিষ্ঠানটির পাসের হার কম কেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার্থীরা ভালো ভাবে আত্বস্ত করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, অনেক শিক্ষকও এ বিষয়ে পূর্ণ ধারণা পাননি।
তিনি বলেন, মফস্বলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ততটা সচেতন নন। স্থানীয় রাজনীতিও লেখাপড়া কম করার পিছনে ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, গ্রামের শিক্ষার প্রতি সরকারকে আরো বেশি নজর দিতে হবে।
গ্রামের কলেজগুলোতে নেই ভালো মানের শিক্ষার পরিবেশ। নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। মফস্বলের কলেজগুলোর ভরসা সরকারি কলেজ। কিন্তু সরকারি কলেজগুলোতেই নেই শিক্ষক। এমনও রয়েছে, যে এক বিভাগের শিক্ষক ক্লাস নেন অন্য বিভাগে। অনেক কলেজেই নেই ইংরেজি ও বিজ্ঞানের শিক্ষক। ফলে ওই কলেজগুলোর শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফলে পিছিয়ে থাকছে।
গ্রামের কলেজগুলো কেন পিছিয়ে আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক বলেন, গ্রামে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা কম। ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক বলতে গেলে পাওয়াই যায় না। ঢাকার সরকারি কলেজগুলোতেও শিক্ষক কম আছে। সৃজনশীল প্রশ্নের আলোকে পরীক্ষা হচ্ছে, পুরোপুরি আয়ত্ত করতে সময় লাগবে।
যশোর শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মোহাম্মদ আবু দাউদ জানান, এ বছর ইংরেজি প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এতে শিক্ষার্থীরা প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু যশোর বোর্ডে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর ইংরেজিতে ফলাফল খারাপ হওয়ার কারণেই এই ফল বিপর্যয় ঘটেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম বলেন, গতবার পদার্থ ও রসায়নে ঢাকা বোর্ড খারাপ করেছিল। এ বিষয়টি আমলে নিয়ে এ বিষয়গুলোর শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি নজর দেয়া হয়েছে। এ কারণে এবার ঢাকা বোর্ডে পাসের হার বেড়েছে। তিনি বলেন, পরীক্ষার সার্বিক মূল্যায়ন নিয়ে বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যানরা বসেছিলাম। কোথায় কী সমস্যা আছে তা খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
তবে সার্বিক পাসের হারে খুশি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, কোন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে ফেল করার জন্য পড়ান না। শিক্ষার্থীরা পাস করার জন্যই পড়ে। পাসের হার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে তা আধুনিক যুগের কোনো প্রশ্ন হবে না। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পাসের হার নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। আমি বলব, এটা আধুনিক যুগের প্রশ্ন হতে পারে না। কোন শিক্ষক তার ছাত্রকে ফেল করার জন্য পড়ান না। ছাত্ররাও ফেল করার জন্য পড়াশোনা করে না, পাস করার জন্যই পড়ে। কেউ কেউ বলেন, আমরা খাতা দেখার সময় নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলেছি, এভাবে নানাভাবে আমাদের বিব্রত করার চেষ্টা করেন। তবে আমরা বিব্রত হই না। কারণ নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয় না। এবার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলে ঢাকা বোর্ডের গণিত দ্বিতীয়পত্র ও ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। প্রশ্ন ফাঁসের প্রভাব ফলাফলে পড়েনি দাবি করেন শিক্ষামন্ত্রী।