তোবা গার্মেন্টসের সামপ্রতিক সংকটে দেশব্যাপী আলোচিত প্রতিষ্ঠানটির মালিক দেলোয়ার হোসেন আবার তার কারখানা চালু করতে চান। তিনি বলেন, জেল থেকে বের হওয়ার পরই অর্ডার পেতে শুরু করেছি। রবিবার ১ লাখ ৩১ হাজার ডলারের অর্ডার পেয়েছি। ঈদের আগে ২০ লাখ ডলারের অর্ডার পেয়েছি। আরো অর্ডার নিয়ে বায়ারদের সাথে আলোচনা চলছে। এখন ব্যাংক আর বায়ারদের পাশে পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।
তিনি বলেন, বায়ারদের কাছে আমার সুনাম নষ্ট হয়েছে। পুরনো বায়াররা পাশে থাকলে এবং ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে সহায়তা করলে কারখানা চালু করবো। প্রায় নি:স্ব অবস্থা থেকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাই। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বীমা কোম্পানির সহযোগিতা। তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে কর্ণফুলী বীমা কোম্পানির কাছে আমার ১৮ কোটি টাকা পাওনা। ওই টাকা পেলে চলার শক্তি পাবো। শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ধৈর্য্য ধরুন। বিপদে পাশে দাঁড়ান।
সামপ্রতিক সময়ে দেশব্যাপী আলোচনার সৃষ্টি করেছিলেন তোবা গ্রুপের ৫টি গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের বেতন না পাওয়ার ঘটনা। বাধ্য হয়েই ঈদের আগের দিন থেকে কারখানায় অনশনকারী শ্রমিকরা নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ১১ দিন পর দুই ধাপে তিন মাসের বেতন পেয়েছেন। শ্রমিকদের বেতন দেয়ার স্বার্থে কারাগারে থাকা দেলোয়ার হোসেন জামিন পান। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছিলেন তিনি। বহু চেষ্টার পর বর্তমান সংকট নিয়ে অবশেষে 'ইত্তেফাকে'র সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন। সোমবার মধ্যরাতে রাজধানীর একটি হোটেলে আলাপকালে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের পর একে একে সব হারানোর বর্ণনা দিয়েছেন। জানিয়েছেন, নিজের দায় আর সম্পদের কথা। বলেছেন সংকট আর সম্ভাবনা নিয়ে। এখনো আশা দেখছেন। বললেন, আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবো। জাইকা (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা) থেকে ১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে কথা হচ্ছে। আশাকরি পাবো।
তাজরীনে আগুন লাগার পর গত ২০ মাসে ৪৫ কোটি টাকা বেতন বোনাস দিয়েছেন বলে জানান দেলোয়ার হোসেন। গত ২০১৩ সালে ২০ লাখ ডলার এবং এ বছরের গত কয়েক মাসে ৫৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন। তবুও শ্রমিকদের ঠিক সময়ে বেতন না দিতে পারার জন্য গার্মেন্টস কর্মী থেকে মালিক হওয়া এই উদ্যোক্তা নিজের দায় স্বীকার করেছেন। বলেছেন, কারখানা চালু করতে পারলে আবার তাদের কাজে নেয়ার ইচ্ছা আছে। তারা দক্ষ। তিনি বলেন, তারা ৮ তারিখের পরই কাজ বন্ধ করে না দিয়ে একটা সপ্তাহ ধৈর্য্য ধরতে পারতেন। বেতন হতে হয়তো ১৫ বা ১৬ তারিখ লাগতো। শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করার পর সব অর্ডার বাতিল করতে হলো। তবুও শ্রমিকদের প্রতি ক্ষোভ নেই। তবে শ্রমিকদের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রের চেষ্টা চালিয়েছিল অভিযোগ করে তিনি বলেন, মিশু (শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু) তো আমার গার্মেন্টসের ট্রেড ইউনিয়নের সাথে জড়িত নন। অনেক বহিরাগত লোক কারখানায় ঢুকে মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি করে নিয়ে যায়। আমার শাশুড়িকে ১৫ দিন ধরে আটকে রেখেছে।
তবে তার সংকট তীব্র হওয়ার পিছনে নিজের কারাগারে যাওয়াকে বড় কারণ মনে করছেন। তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের মামলায় গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি কারাগারে যান। তিনি বলেন, 'জেলে যাওয়ার আগে প্রচুর অর্ডার ছিল। জেলে না গেলে এতদিনে দাঁড়িয়ে যেতাম। একেবারে পিক আওয়ারে জেলে ঢুকলাম। ৫৫ লাখ ডলারের (প্রায় ৪২ কোটি টাকা) সব অর্ডার মাইর গেল।' তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের সময় তার মোট ৮টি কারখানা চালু ছিল। অগ্নিকাণ্ডে তার ১২৫ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। এরপর সংকটে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কারখানার সংখ্যা কমিয়ে আনলেন না কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মনে করেছিলাম ব্যাংক পাশে থাকবে। তাজরীনের বীমার ১৮ কোটি টাকা পাবো। এখানে ধরা খেয়ে গেলাম।
সব সম্পত্তি বিক্রি করে দায় মিটবে?
তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, রাজধানী ঢাকা ছাড়াও আশুলিয়া, সাভারের অন্যান্য জায়গায় তার বেশ কিছু স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তি প্রায় সবই ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার দায় ১৩০ কোটি টাকার উপরে। সব সম্পত্তি বিক্রি করলে সব দায় শোধ প্রায় হয়ে যাবে বলে মনে করছেন। জানিয়েছেন, প্রাইম ব্যাংকে সম্পত্তি বন্ধক রেখে ৭৯ কোটি টাকার দায় রয়েছে। এছাড়া যমুনা ব্যাংকে ৩৩ কোটি টাকা এবং স্থানীয় পাওনাদাররা পাবে আরো ২০ কোটি টাকা। বাড্ডায় নিজের বাড়ি ছাড়াও আশুলিয়ায় ৩ বিঘা, সাভারে ৫ কাঠা ও তাজরীন গার্মেন্টসের পাশে আরো ৫ কাঠা, বাড্ডার আনন্দনগরে ১৬ কাঠা প্রাইম ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে। এর বাইরে ঢাকায় আরো ১১ কাঠা জমিও একই ব্যাংকের কাছে বন্ধক। অন্যদিকে যমুনা ব্যাংকে রয়েছে তাজরীন গার্মেন্টসসহ আশুলিয়া এলাকার ৪২ শতাংশ জমি।
ব্যাংকের বাইরে বাড্ডায় ফারইস্ট ও ইসলামী ফাইন্যান্সের কাছে বন্ধক ছিল সাড়ে ২৫ কাঠা। তোবা'র ৫ কারখানার শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য এই জমি ও কারখানার মেশিনপত্র বিক্রি করেছেন ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকায়। এর মধ্যে দুটি ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের পাওনা ৩ কোটি টাকা পরিশোধ হওয়ার পর তার থাকে ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তোবা'র ৫ কারখানার শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন পরিশোধ হয়েছে মোট (বিজিএমইএ'র পরিশোধিত অংশসহ) ৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাত্ এসব সম্পত্তি বিক্রি হওয়ার পর তার আরো প্রায় ৫১ লাখ টাকা দায়। তিনি বলেন, সংকটকালে তার প্রাডো, ল্যান্ড ক্রুজার, পাজেরো, প্রিমিও ও মালামাল আনা-নেয়ার জন্য কাভার্ডভ্যানসহ ৮টি গাড়িও বিক্রি করে দেন। কারখানার চলতি মূলধন সরবরাহের লক্ষ্যে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এক কোটি ৭ লাখ টাকা ঋণ করে ব্যয় করেন বলেও জানান তিনি।
গার্মেন্টসে নিজের দীর্ঘ সাড়ে ২৬ বছরের কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই সময়ের মধ্যে ১৫ বছর চাকরি করেছি। আর সাড়ে ১১ বছর নিজের প্রতিষ্ঠান চালিয়েছি। এই সময়ের মধ্যে একজন শ্রমিকও কোন দুর্ঘটনায় আহত হতে দেখিনি। কোন শ্রমিক বা কর্মকর্তা আমার প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার পর চলে যেতে চাননি। তাদের বেতন নিয়ে সমস্যা হয়নি। আমার উপর তাদের ক্ষোভ থাকলে নিশ্চয়ই বছরের পর বছর চাকরি করতেন না। কিন্তু এক তাজরীন আমার সব শেষ করে দিল। চোখের সামনে শ্রমিক গেল কারখানা গেল। তিনি বলেন, তাজরীন ছিল একেবারেই নতুন কারখানা। বড় বায়ার সিএন্ডএ'র অর্ডার নিয়ে কেবল উত্পাদনে গিয়েছিলাম। তখনই ঘটলো দুর্ঘটনা।