এবারের আগস্ট মাসটিতে বাংলাদেশের মানুষ শোক করছে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর জন্য নয়। শোক করছে গাজায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর জন্যও। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে, তার দুই পুত্রবধূ এবং শিশু রাসেলকেও। এই পাশবিক জিঘাংসা কেন, এ প্রশ্ন হত্যাকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কিনা, তাদের কারো কারো বিচারের সময়, এ কথা আমার জানা নেই। কিন্তু আন্দাজ করি জিজ্ঞেস করা হলে তার যা বলত, তার সঙ্গে খুব তফাত্ থাকত না গাজায় কেন শিশুদের মারা হচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তরে ইসরাইলি নেতারা যা বলছেন, তার সঙ্গে। মৌলিকভাবে এই উভয় হত্যাকারী দল বিশ্বাস করে একই পশুশক্তিতে, তাদের ভেতর বিছিয়ে আছে একই আদিম অন্ধকার। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, তারা ভেবেছিল, তাঁকে বিদায় করে দিতে পারলে এই দেশটি চলে যাবে তাদের অধিকারে। এই দেশ থেকে স্বাধীনতা আর একাত্তরের চেতনা বিলুপ্ত হবে। ইসরাইলি নেতারাও ভাবছেন, এক প্রজন্মের অসংখ্য শিশুকে হত্যা করলে, অসংখ্য আরো শিশুকে আহত ও পঙ্গু করে দিলে, তাদের মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে না দিলে আগামীর ফিলিস্তিনি জাতি পঙ্গু হয়ে বড় হবে। তারা খুব সহজেই স্বীকার করে নেবে ইসরাইলের বশ্যতা। আর গাজা পুরো দখলে নিলে পশ্চিম তীর আর অন্যান্য ফিলিস্তিনি অঞ্চল চলে আসবে তাদের কব্জায়। ইসরাইলের পতাকা বিনা বাধায় উড়বে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে।
জ্ঞানীরা বলে, ইতিহাসের একটা শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। উপনিবেশী শক্তি পৃথিবী তো কম দেখেনি, কিন্তু বড় বড় উপনিবেশী শক্তি যত বেশি বলপ্রয়োগ করেছে তত বেশি প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, তত তাদের ক্ষমতার ভিত টলেছে। একসময় নাজী জার্মানি শক্তিধর ছিল, তারা ষাট লাখ ইহুদিদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। একদিন হিটলারের ওই শক্তিধর দেশের গর্ব ধূলোয় মিশে গেছে। আজ ইসরাইল নেমেছে অত্যাচারীর ভূমিকায়। একদিন তাদের অহংকারও ধূলোয় মিশে যাবে। এটি আমাদের আন্দাজ নয়, এটি ইতিহাসের শিক্ষা। একাত্তরে পাকিস্তানীরা প্রবল শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছিল বাঙালি নিধনে। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে তারা মাঝরাতে হামলায় হত্যা করেছে। নয়টি মাস তারা হত্যাযজ্ঞে মেতেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যত গতি পেয়েছে, যত তীব্র হয়েছে বাঙালির প্রতিরোধ, তাদের দুর্গে ফাটল ধরেছে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অপমানের অশ্রু ঝরিয়েছে পাকিস্তানি বীরপুরুষ সেনাপতিরা। তাদের যারা দোসর ছিল বাংলাদেশে, তারা যে যার মতো গর্তে লুকিয়েছিল। তাদের সেসব গর্ত থেকে বের হতে দিয়েছিলেন পঁচাত্তর পরবর্তী শাসকেরা, এমনকি রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদারিত্ব করেছিলেন। তাদের এই হঠকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল বাঙালি জাতির সঙ্গে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও পরিপূর্ণ হয়নি। যারা নিজের দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল একাত্তরে, তাদের কয়েকজনকে হলেও শাস্তি পেতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত।
১৯৭৫-এর আগস্টে যখন এদেরই পক্ষ সমর্থনকারী একদল সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল, তারা ইতিহাসকে আমলে আনেনি। আনলে এই কাজ থেকে তারা বিরত থাকত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, স্বাধীনতার স্থপতিকে পৃথিবী থেকে
সরিয়ে দিয়ে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন করে চিরতরে পাকিস্তানী চিন্তা-চেতনার অনুগত করে রাখা। তারা ভেবেছিল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থ আর কোনো কোনো মহলের সমর্থন, পাকিস্তানী নানা সংস্থার সহায়তা এবং বাংলাদেশের প্রতি পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে একাত্তরে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। কিন্তু যে কাজটি পাকিস্তান রাষ্ট্র করতে পারল না, প্রায় আড়াই দশকের উপনিবেশী শাসন এবং নয়মাসের হত্যাযজ্ঞের পরও, একদল সশস্ত্র লোক কি করে ভাবল যে এটি তারা পারবে, একথা ভেবে আমি অবাক হই। ইতিহাসের সামান্য জ্ঞান থাকলেও তারা বুঝত, এটি অলীক কল্পনা। মাঝখান থেকে আমরা হারালাম বঙ্গবন্ধুকে।
২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন মানুষ। তৃণমূলে ছিল তার শেকড়। তিনি গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছেন, সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন, তাদের স্বপ্ন-সাধ আশা-বিশ্বাসকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছেন। ফলে তিনি খুব স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন, পাকিস্তানী উপনিবেশী শাসনের নিচে বাঙালিদের কোনো ভবিষ্যত্ নেই। বরং তাদের অবস্থা দিনে দিনে শোচনীয় হবে।
শহরের সচ্ছল জীবনে অভ্যস্ত রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এমনকি কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটা অস্বস্তির নাম। তারা ভাবতেন পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের একদিন চাঁদে পৌঁছে দেবে। পাকিস্তানের প্রচারযন্ত্র যে মিথ্যা ছড়াতো, তাতে তারা বিশ্বাস করতেন। তারা ভাবতেন, পাকিস্তান দুর্বল হলে ইসলাম বিপন্ন হবে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের মালিক যারা ছিল— সেই ভূমিস্বামী, ব্যবসায়ী, আমলা ও সামরিক বাহিনীর আচার-আচরণে ইসলামের কোনো প্রতিফলন ছিল না। একাত্তর-পরবর্তী পাকিস্তানেও ইসলামকে ব্যবহার করেছে এর মালিকরা। এতে ফল হয়েছে এই যে পাকিস্তানে জুমার নামাজের সময় মসজিদে বোমা ফেটে মুসল্লি মারা হয়। প্রায় প্রতি শুক্রবারে। মেয়েরা স্কুলে গেলে তাদের ও তাদের পরিবারদের গুলি করে মারা হয়।
বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তান নিয়ে শুরুতে আশাবাদী ছিলেন— সেই চল্লিশের দশকে। কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টির দু'একবছরের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এর চরিত্র, সনাক্ত করেছিলেন মুখোশের পেছনে এর আসল মুখটিকে। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই অনুধাবনের বিবরণ আছে। এর পর থেকেই শুরু হয়ে গেল তাঁর উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের প্রস্তুতি এবং পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর পুরোপুরি সংগ্রাম। ভাবতে অবাক লাগে, অনেক প্রবীণ অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ যেখানে একটা আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছাতে অনেক সময় নিলেন, চল্লিশে পৌঁছানোর অনেক আগেই তিনি তা করে ফেললেন। শুধু তাই নয়, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে একটি সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশের কর্তাব্যক্তি ও নানা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিভাবে আন্দোলন করা যায়, তার একটা রূপরেখাও তিনি করে ফেললেন।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা নিয়ে জনগণের কাছে হাজির হওয়ার অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানের উগ্র ধর্মতন্ত্র মানুষের জন্য নির্যাতনের পথ তৈরি করে। তিনি তার বিপরীতে ধর্মকে ধর্মের জায়গাতে রাখার, অর্থাত্ 'মানুষের কল্যাণে ধর্ম-রাষ্ট্র ক্ষমতার হাতিয়ার নয়' এই বিবেচনাকে তাঁর বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট করে দিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক পুঁজিবাদের বিপরীতে কল্পনা করলেন সকলের মঙ্গলের সহায়ক সমাজতন্ত্রকে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমরবাদ, স্বৈরাচার আর এলিট শ্রেণীর বিপরীতে তিনি আদর্শ মানলেন গণতন্ত্রকে। এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবি আধিপত্য এবং বাঙালিসহ সিন্ধু, বালুচ ইত্যাদি জাতিকে অবদমিত করে রাখার মতলবের বিপরীতে প্রতিষ্ঠা দিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে— যা পাকিস্তানী উপনিবেশী শাসনের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করতে আমাদের জোগাবে অহংকার, শক্তি ও উদ্যম।
আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানে যে চার মূল নীতি সংযোজিত হয়েছিল, তা হঠাত্ কল্পিত কিছু নয়; বরং সেই পঞ্চাশের দশক থেকে এগুলো নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভেবেছেন, নানান প্রেক্ষাপটে (বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় এখানে তিনি কাজে লাগিয়েছেন, যা তার গঠন পাঠন থেকে সংগ্রহ করেছিলেন) এগুলোকে দেখেছেন, বানিয়েছেন, তারপর এদেরকে নির্বিকল্প ভেবেছেন।
পঁয়ত্রিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনের প্রায় পনেরো বছরই বঙ্গবন্ধু কাটিয়েছেন কারান্তরালে। কিন্তু তাতে তাঁর সংকল্পে সামান্যতম স্খলন আসেনি। কারণ তিনি যে উদ্দেশ্যে সংগ্রামে নেমেছিলেন, তা কোনো ব্যক্তির বা দলের অথবা নির্দিষ্ট কোনো জনসমষ্টির স্বার্থে নয়, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি জাতিকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দেয়া। তাঁর সংকল্প ছিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে যতদূর যাওয়া যায়, যাওয়া। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতেও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা ছিল, কিন্তু পাকিস্তানীরা একে স্বীকার না করে নিজেরাই যে বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রামকে অনিবার্য করে তুলেছে, সেই ব্যাখ্যাটাও ছিল। তিনি তৃণমূলে সমর্পিত মানুষ ছিলেন— তৃণমূলের মানুষ সহনশীল। কিন্তু একবার তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে একটা বিশাল দেয়ালের মতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়। এই শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বঙ্গবন্ধু, এই শক্তিতেই তিনি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ বেয়েই সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছিল। এবং এই যাত্রার প্রজ্ঞাবান পথ প্রদর্শক ও কাণ্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এজন্য সারাবিশ্ব তাকে সম্মান জানিয়েছে। তিনি বিশ্বে বাঙালির সভ্যতা, সংস্কৃতি, সদাচার এবং একই সঙ্গে শৌর্য, পরাক্রম এবং সম্ভাবনার ছবিটি তুলে ধরেছিলেন। এজন্য হয়তো তাঁর ওপর এতটা রাগ ছিল পাকিস্তানীদের ও তাদের বাঙালি দোসরদের।
৩. বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশটা এখন আমাদেরই গড়তে হবে, কিন্তু সেটি সম্ভব তাঁর মতো তৃণমূলে ফিরে গেলে, দেশের স্বার্থটা প্রধান করলে, পুঁজিবাদী শোষণ থেকে সাম্যের ও সমন্বিত সামর্থ্যের একটা সমীকরণে ফিরে গেলে, যত উগ্রতা সে সবকে ছুঁড়ে ফেলে শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করলে, বাঙালি-আদিবাসী সকলের জাতীয়বাদী শুভ চিন্তা ও প্রকাশগুলোকে সমন্বিত করলে। এবং যত ব্যাপকভাবে আমরা তা করবো, তত শক্তিশালী হবে দেশটি, তত দ্রুত আমরা সোনার বাংলার গন্তব্যের দিকে যেতে পারব এবং এটিই হবে তাঁর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা।