পূর্ব বাংলা সরকারও খবর রাখে— আমি দু'একদিনের মধ্যে পৌঁছাব। গোয়েন্দা বিভাগ ব্যস্ত আছে, আমাকে গ্রেফতার করবার জন্য। আমিও প্রস্তুত আছি, তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই। লাহোর থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম, বোধহয় পেয়ে থাকবে। বাড়ির সকলেই আমার জন্য ব্যস্ত। ঢাকায়ও যাওয়া দরকার, সহকর্মীদের সাথে আলাপ করতে হবে। আমি গ্রেফতার হওয়ার পর যেন কাজ বন্ধ না হয়। কিছু অর্থের বন্দোবস্তও করতে হবে। টাকা পয়সার খুবই অভাব আমাদের। আমি কিছু টাকা তুলতে পারব বলে মনে হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কয়েকজন ভক্ত আছে, যাদের আমি জানি, গেলে একেবারে 'না' বলতে পারবে না। রানাঘাট এসে গাড়ি থামল অনেকক্ষণ। ভারতবর্ষের কাস্টমস অফিসাররা গাড়ি ও প্যাসেঞ্জারদের মালপত্র তল্লাশি করল, কেউ কোনো নিষিদ্ধ মালপত্র নিয়ে যায় কি না? আমার মালপত্রও দেখল। সন্ধ্যা হয় হয়, ঠিক এই সময় ট্রেন বেনাপোল এসে পৌঁছাল। ট্রেন থামবার পূর্বেই আমি নেমে পড়লাম। একজন যাত্রীর সাথে পরিচয় হল। তাকে বললাম, আমার মালগুলি পাকিস্তানের কাস্টমস আসলে দেখিয়ে দিবেন, আমার একটু কাজ আছে। আসতে দেরিও হতে পারে। অন্ধকার দেখে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। এখানে ট্রেন অনেকক্ষণ দেরি করল। গোয়েন্দা বিভাগের লোক ও কিছু পুলিশ কর্মচারী ঘোরাফেরা করছে, ট্রেন দেখেছে তন্নতন্ন করে। আমি একদিক থেকে অন্যদিক করতে লাগলাম। একবার ওদের অবস্থা দেখে ট্রেনের অন্য পাশে গিয়ে আত্মগোপন করলাম। ফাঁকি আমাকে দিতেই হবে। মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাছিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।
খুলনার অবস্থা আমার জানা আছে। ছোটবেলা থেকে খুলনা হয়ে আমাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। কলকাতায় পড়তাম, খুলনা হয়ে যেতে আসতে হত। রাত দশটা বা এগারটায় হবে এমন সময় খুলনায় ট্রেন পৌঁছাল। সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে আমার পাঞ্জাবি খুলে বিছানার মধ্যে দিয়ে দিলাম। লুঙ্গি পরা ছিল, লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেঁধে নিলাম। বিছানাটা ঘাড়ে, আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম। কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম, জাহাজ ঘাটের দিকে। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই। চিনতে পারল না। আমি রেলরাস্তা পার হয়ে জাহাজ ঘাটে ঢুকে পড়লাম। আবার অন্য পথ দিয়ে রাস্তায় চলে এসে একটা রিকশায় মালপত্র রাখলাম। পাঞ্জাবিটা বের করে গায়ে দিলাম। রিকশাওয়ালা গোপালগঞ্জের লোক, আমাকে চিনতে পেরে বলল, "ভাইজান না, কোথা থেকে এইভাবে আসলেন।" আমি বললাম, "সে অনেক কথা, পরে বলব। রিকশা ছেড়ে দাও।" ওকে কিছুটা বলব, না বলে উপায় নাই। গোপালগঞ্জের লোক, কাউকেও বলবে না, নিষেধ করে দিলে।
আমার এক ভাই ছিল, সে খুলনায় চাকরি করত। তার বাসায় পৌঁছালাম, ঠিকানা জানতাম। রিকশাওয়ালাকে দিয়েই আমার মামাকে খবর দিলাম। মামা খুব চালু লোক। সকাল ছয়টায় জাহাজ ছাড়বে। মামাকে জাহাজ ঘাটে পাঠিয়ে দিয়ে তার নামে প্রথম শ্রেণীতে দুইটা সিট রিজার্ভ করালাম যাতে অন্য কেউ আমার কামরায় না উঠে। আমার এক বন্ধু ছিল, জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করত, তাকে খবর দিলাম। সে বলল যে, জাহাজ ছাড়বার ঠিক দুই মিনিট আগে যেন আমি জাহাজে উঠি। জাহাজে ওঠার সাথে সাথে সে জাহাজ ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করবে। জাহাজ ঘাটেও গোয়েন্দাদের আমদানি আছে। দুঃখের বিষয় কুয়াশা পড়ায় জাহাজ আসতে দেরি হয়েছিল এবং ছাড়তেও দেরি হবে, প্রায় এক ঘণ্টা অর্থাত্ সকাল সাতটায়। মহাবিপদ! ছয়টায় তো একটু অন্ধকার থাকে, সাতটায় সূর্য উঠে যায়। মামা পূর্বেই মালপত্র নিয়ে উঠে কামরা ঠিক করে রেখেছে। আমি কাছেই এক দোকানে চুপটি করে বসেছিলাম। খুলনার গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা আমাকে চিনে। মামার সাহায্যে আমি প্যান্ট, কোট ও মাথায় হ্যাট লাগিয়ে অন্য রূপ ধরেছি। যখন দুইটা সিঁড়ি টেনেছে আর দুইটা বাকি আছে, আমি এক দৌড় দিয়ে উঠে পড়লাম। দেখলাম আমার বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে। উঠার সাথে সাথে ওই দুইটা সিঁড়িও টেনে নিল এবং জাহাজ ছেড়ে দিল। দুইজনের চোখে চোখে আলাপ হল, আমি আমার চক্ষু দিয়েই কৃতজ্ঞতা জানালাম।
এবার আশা হল, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব। আমি কামরাতেই শুয়ে রইলাম। খাবার জিনিস কামরায় আনিয়ে নিলাম। আমি যে জাহাজে উঠেছি অনেকে দেখে ফেলেছে। এই জাহাজই গোপালগঞ্জ হয়ে বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ যায়। গোপালগঞ্জের লোক অনেক ছিল। গোপালগঞ্জ টাউনে জাহাজ যায় না, তিন মাইল দূরে মানিকদহ নামক স্থানে নতুন ঘাট হয়েছে সেখানে থামে। নদী ভরাট হয়ে গেছে। মানিকদহ ঘাটে যখন জাহাজ ভিড়েছে, তখন আমি জানালা দিয়ে চুপটি করে দেখছিলাম। ঘাট থেকে রহমত জান ও ইউনুস নামে দুইজন ছাত্র, যারা খুব ভাল কর্মী— আমার চোখ দেখেই চিনতে পেরে চিত্কার করে উঠেছে। আমি ওদের ইশারা করলাম, কারণ খবর রটে গেলে আবার পুলিশ গ্রামের বাড়িতে যেয়ে হাজির হবে। রহমত জান ও ইউনুস বরিশাল কলেজে পড়ে। এই জাহাজেই বরিশাল যাবে। ওরা সোজা আমার কাছে চলে এল। জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। আমি ওদের বললাম, "তোমরা চিনলা কেমন করে?" ওরা বলে, "ও চোখ আমাদের বহু পরিচিত।" আমি বললাম, "পুলিশ খবর পেলে রাস্তায় গ্রেফতার করতে চেষ্টা করতে পারে।" ওরা বলে, "ভাইজান, এটা গোপালগঞ্জ, এখান থেকে ইচ্ছা না করলে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নাই।" গোপালগঞ্জের মানুষ বিশেষ করে ছাত্র ও যুবকরা আমাকে 'ভাইজান' বলে ডাকে। এমনও আছে, ছেলেও 'ভাইজান' বলে, আবার বাবাও 'ভাইজান' বলে ডাকে। গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ির নিকটবর্তী জাহাজ ঘাটে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সন্ধ্যার সময় আমাদের জাহাজ ঘাট পাটগাতি পৌঁছালাম। নৌকায় প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে। বাড়িতে পৌঁছালাম, কেউ ভাবতেও পারে নাই আমি আসব। সকলেই খুব খুশি। মেয়েটা তো কোল থেকে নামতেই চায় না, আর ঘুমাতেও চায় না। আব্বাকে বললাম সকল কথা। বাড়িতে পাহারা রাখলাম। বৈঠকখানায় রাতভর লোক জেগে থাকবে, যদি কেউ আসে আমাকে খবর দেবে। আমাদের বাড়ি অনেক বড় এবং অনেক লোক। এখন গ্রেফতার হতে আমার বেশি আপত্তি নাই। তবে ঢাকা যাওয়া দরকার একবার। বেশি দিন যে বাড়ি থাকা চলবে না, তা আব্বা ও রেণুকে বুঝিয়ে বললাম। বোধহয় সাত-আট দিন বাড়িতে রইলাম। বললাম, "বরিশাল হয়ে জাহাজ যায়, এ পথে যাওয়া যাবে না; আর গোপালগঞ্জ হয়েও যাওয়া সম্ভবপর নয়। পথে গ্রেফতার করে ফেলতে পারে। আমি গোপালগঞ্জের দুই ঘাট পরে জাহাজে উঠব। তারপর কবিরাজপুর থেকে নৌকায় মাদারীপুর মহকুমায় শিবচর থেকে জাহাজে উঠব। দু'একদিন আমার বড়বোনের বাড়িতে বেড়িয়ে যাব।" বড়বোনের বাড়ি শিবচর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল পথ। রেণু বলল, "কতদিন দেখা হবে না বলতে পারি না। আমিও তোমার সাথে বড়বোনের বাড়িতে যাব, সেখানেও তো দু'একদিন থাকবা। আমি ও ছেলেমেয়ে দুইটা তোমার সাথে থাকব। পরে আব্বা যেয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন।" আমি রাজি হলাম, কারণ আমি তো জানি, এবার আমাকে বন্দি করলে সহজে ছাড়বে না। নৌকায় এতদূর যাওয়া কষ্টকর। আমরা বিদায় নিয়ে রওয়ানা করলাম। দুইজন কর্মীও আমার সাথে চলল। একজনের নাম শহীদুল ইসলাম, আরেকজনের নাম সিরাজ। ওরা স্কুলের ছাত্র ছিল, আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। এখন দুইজনই ব্যবসায়ী। শহীদ আজও আমাকে ভালোবাসে এবং রাজনীতিতে আমাকে অন্ধভাবে সমর্থন করে। সিরাজ অন্য দল করলেও আমাকে শ্রদ্ধা করে। এরা কবিরাজপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল এবং রাতভর পাহারা দিয়েছিল। শীতের দিন ওরা এক কাপড়ে এসেছিল। রেণু নিজের গায়ের চাদর ওদের দিয়েছিল।
আমরা বোনের বাড়িতে পৌঁছালাম, একদিন দুই দিন করে সাত দিন সেখানে রইলাম। ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে। আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেণুকে বললাম, "এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দু'জন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন? আমার টাকার বেশি দরকার নাই। শীঘ্রই গ্রেফতার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না। তোমাদের সাথে কবে আর দেখা হয় ঠিক নাই। ঢাকা এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজোবোনের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনো আত্মীয়দের আমার জন্য কষ্ট হয়, তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব।"
রাতে রওয়ানা করে এলাম, দিনের বেলায় আসলে হাছিনা কাঁদবে। কামাল তো কিছু বোঝে না। শিবচরে জাহজ আসে না, চান্দেরচর যেতে হবে, প্রায় দশ মাইল। আমার বড়বোনের দেবর, আমারও বিশিষ্ট বন্ধু ও আত্মীয় সাইফুদ্দিন চৌধুরী সাহেব আমাকে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিল না। সবই তো ওকে বলেছি।